অন্নদামঙ্গল : নূতন মঙ্গল | অন্নদামঙ্গল কাব্যকে "​নূতন মঙ্গল" অভিধায় অভিহিত

অন্নদামঙ্গল : নূতন মঙ্গল


‘অন্নদা মঙ্গল’ কাব্যের শুরুতেই দেবী সরস্বতীকে বন্দনা জানিয়ে কবি লিখেছেন— 

‘দয়া কর মহামায়া

দেহ মোরে পদছায়া

পূর্ণ কর নূতন মঙ্গল।” 

এবং পরে আর একবার জানালেন—

“নূতন মঙ্গল আশে

ভারত সরস ভাষে

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আজ্ঞায়।” 


নিজের রচনাকে এরূপ নূতন বলে উল্লেখ সব মঙ্গল কবিই করেননি। যাঁরা করেছেন তাঁদের সংখ্যা অত্যল্প এবং গভীর ভাবে মনোযোগ করলে দেখা যাবে তাঁরা তাদের কাব্যের অভিনব বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রেখে অত্যন্ত সচেতন ভাবেই এরূপ বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন নিজেদের কাব্য সম্বন্ধে। মুকুন্দরামের পূর্বে চন্ডীমঙ্গল কাব্য, ব্রতকথা ও পাঁচালী বিশেষত্বহীন রীতিতে লেখা হয়েছিলো। মুকুন্দরাম তাকে পূর্ণাঙ্গ পাঁচালী কাব্যের রূপদান করেছিলেন এবং ‘নৌতন মঙ্গল অভিলাষে’ অনেক পুরাণ বিচার করে সেই দেবী মাহাত্ম্য জ্ঞাপক কাব্যকে নতুন মহিমা দান করেছিলেন। সম্ভবত এই অর্থেই তাঁর কাব্য সে সময়ে ছিলো ‘নূতন মঙ্গল’। কিন্তু ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের অভিনবত্ব আরও নানা বৈশিষ্ট্যে অর্থপূর্ণ। ভারতচন্দ্রের কবিমানসের বিচিত্র্যমুখী মনোভাব তাঁর কাব্যকেও বহুতর নূতন গুণে ভূষিত করেছে, যে কারণে অন্নদামঙ্গল কাব্য বাংলার সুবিশাল মঙ্গল সাহিত্যে আজও একক ও অনন্য বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সাধারণত দেবদেবীর রূপকল্পনা, দেবী মহিমার ধারণা, কাহিনি পরিকল্পনা, চরিত্র নির্মাণ, জীবন চিত্রণ প্রভৃতি মঙ্গলকাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বলা বাহুল্য, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যেও এই সমস্ত লক্ষণ ও উপাদান বর্তমান, তথাপি তাঁর কাব্য কেন ‘নূতন মঙ্গল’ তা বিশেষ রূপে পর্যালোচনা সাপেক্ষ। মূলত ‘নূতন মঙ্গল অভিধা যথাবিহিত যোগ্যতা অর্জন করেছে অন্তরঙ্গ বিচারে।


দেবী অন্নপূর্ণার রূপ ও স্বভাব মহিমাতেই অভিনবত্বের লক্ষণ সুস্পষ্ট। দেবী অন্নপূর্ণা শিব গৃহিণীরূপে প্রসন্ন কৌতুকময়ী দেবী। বিবাদ পরায়ণ আত্মপ্রতিষ্ঠান্বেষণী মঙ্গল দেবীদের থেকে তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি পুরাকাল থেকেই পরমা প্রকৃতি দেবী হিসাবে পুরাণে প্রতিষ্ঠিত, তাই লৌকিক মঙ্গল দেবীর মত দেব মণ্ডলে নিজের স্থান করে নেবার প্রচন্ড উগ্র শক্তির অলৌকিক লীলায় অপর দেবতার সঙ্গে কোন সংঘর্ষে তাঁকে লিপ্ত হতে হয়নি। বরং মানুষের যথার্থ ভক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে গোড়ার সুতীব্র কঠিন শক্তির দেবী চণ্ডী থেকে উত্তরোত্তর মধুর, কোমল চরিত্রে উত্তীর্ণ হয়েছেন। মাতা অন্নপূর্ণারূপে ভিখারীর গৃহলক্ষ্মীরূপে, বিচ্ছেদ বিধুর পিতামাতার কন্যারূপে— 'মাতা, পত্নী ও কন্যা, এই ত্রিবিধ মঙ্গলসুন্দর রূপে বাঙালির ঘরে রস সঞ্চার করেছে। মঙ্গলদেবীর মতো আত্মপ্রতিষ্ঠার নূতন করে প্রয়োজন নেই বলেই কাশীর অন্নপূর্ণা পুরীর রত্ন প্রতিমায় দেবীর অধিষ্ঠানের জন্য শিব এবং দেবতাদেরও কঠিন তপস্যা করতে হয়েছে। দেবী অবশেষে দৃষ্টি-সুধা বৃষ্টিতে দেবতা ও ঋষিগণকে মুগ্ধ করেছেন। এইজন্যই পরমা প্রকৃতি অন্নপূর্ণার করুণা সকলের উপরেই যেন সমানভাবে বর্ষিত হয়। – 'জগৎ জননী মাতা সবারে সমান।'


দেবতার শাপভ্রষ্ট হওয়া অকারণ নয়। বসুন্ধর ও নলকুবেরের অপরাধ ও শাপভ্রষ্টতা দেবীর ইচ্ছাধীন ছিল না। তেমনি দেবী মর্ত্যে থেকে অনুগ্রহ করতে চাইলেন, তাকে অনুগ্রহ করার কারণও তিনি জানালেন, জগতে আপন মহিমা তিনি প্রকাশ করলেন সবচেয়ে দুঃখী জনের দুঃখ দূর করে। স্বাভাবিকভাবেই আপন জনেরও ন্যায় অন্যায় বিচার করেন‌ তিনি। যেমন বিচার করেছেন ব্যাসের অহংকারাচ্ছন্ন সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক ভক্তিকে। দেবী অন্নপূর্ণা যখন পিতাপুত্রকে অন্ন পরিবেশন করে আনন্দময় গৃহিণীপনার খেলারসে পরিপূর্ণ, তখন সেই আনন্দের সংসারে ব্যাসের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দাবী নিতান্তই বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। অনাবিল মাধুর্যকে বিক্ষুদ্ধ তিক্ততায় বিষাক্ত করে তোলাকে অন্যায় বলে মনে করেছেন দেবী। তবে কোনও মঙ্গলদেবী যে কথা কখনো বলেননি এর পূর্বে দেবী অন্নপূর্ণা জানালেন সেই সর্বধর্ম সমন্বয়ের দর্শনের কথা—

“হরি হর বিধি তিন আমার শরীর।

অভেদ যে জন ভজে সেই ভক্ত বীর।”


মঙ্গলকাব্যে এতখানি উদার মহিমান্বিতা দেবী এর আগে দেখা দেননি। তাই শুধু নামে এক নূতন দেবীর মাহাত্ম্যজ্ঞাপক কাব্য হিসাবেই অন্নদা মঙ্গলকাব্য ‘নূতনমঙ্গল’ নয়। মঙ্গল ভক্তি ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভক্তি চিন্তাভাবনার কাব্য হিসাবেই ভারতচন্দ্রের এ কাব্য—'নূতন মঙ্গল’।


ভারতচন্দ্র মুকুন্দরামের মতো দেবীনির্ভর ভক্ত কবি নন। রাজসভার নাগরিক মননের কবি ভারতচন্দ্র তীব্র আত্ম সচেতন কবি ছিলেন। ফলে মঙ্গলকাব্যের ভক্তি পরিমণ্ডলে তিনি অনিবার্যভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিচারের আলো; তাঁর কাব্যে আধ্যাত্মিকতার প্রতি পদক্ষেপে দেখা দিয়েছে ধর্মীয় ন্যায় অন্যায়ের বিশ্লেষণ। বুদ্ধিদীপ্ত কবি নির্দ্বিধায় আলোকপাত করেছেন মিথ্যা ধর্মাচারের দূষিত ক্ষত-সমূহের উপর। ফলত 'অন্নদা মঙ্গলকাব্য হয়ে উঠেছে সাধারণ সুখ দুঃখে মঙ্গলদেবীর কৃপা করুণা বর্ষণের কাব্যের চেয়ে, মানুষেরই আধ্যাত্মিক চৈতন্য সাধনের ও উচ্চতর ব্যক্তিত্ব বিকাশের কাব্য। কাব্যের আস্বাদ হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ নূতন। আর এই নূতন ভাববৃত্তে কবিও স্বয়ং তাঁর আপন চৈতন্যের অভিপ্রায়, লক্ষ্য ও প্রার্থনাকে ব্যক্ত করেছেন। কাজেই অন্ন ক্ষুধার তীব্র জ্বালায় হতজ্ঞান হয়ে ব্যাসদের কাশীতে অভিশাপ দিলেও, তাঁর আসল ব্যর্থতা ও ট্র্যাজেডি হল তাঁর ব্যক্তিত্বের পরাজয়। আত্মবিশ্বাসী আত্মসচেতন কবি অসঙ্কোচে স্বাধীনতা গ্রহণ করেছেন—বাৎসল্য ভক্তির কাব্যে কামরসায়ন কাব্য বিদ্যাসুন্দরকে সংযুক্ত করেছিলেন। একদিকে উদগ্র কামার্ততার জন্য তিনি অভিশপ্ত করেছেন বসুন্ধর ও নলকুবেরকে, আবার পুরস্কৃতও করেছেন বিদ্যাসুন্দরের কামকলা ও সাধনাকে। একদিকে তীব্র ব্যঙ্গে বিদ্রুপে বিদ্ধ করেছেন দুর্বল মানুষের অক্ষম প্রবৃত্তির কুশ্রীতাকে, অপরদিকে সাথর্ক করে তুলেছেন মনুষ্যত্ব সাধনার দুর্মর শক্তিকে। এটাও তো মঙ্গলকাব্যের আঙিনায় একপ্রকারের নূতনত্ব।


বস্তুত ললিত সুছন্দে, জীবন রসের বাণীমূর্তি রচনাই কবির ছিল মুখ্য অভিপ্রায়। কলাবিদ্ কবি কাব্যরচনাকে গ্রহণ করেছিলেন শিল্প সাধনা হিসাবে, কিন্তু প্রথার দুর্মরতার কথা যেহেতু খুব ভালোই জানতেন কবি এবং সেই মধ্যযুগে যেহেতু ভক্তিময় পাঁচালী কাব্যে অধ্যুষিত ছিলো বাংলার লোকমানস, সেহেতু মঙ্গলকাব্যের বেশেই উপস্থিত করেছিলেন তিনি এই মনুষ্যত্ব মহিমাজ্ঞাপক কাব্যকে। দেখিয়েছেন, যেখানেই প্রকৃত মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানেই এসে নেমেছে দেবতার আশীর্বাদ। আর যেখানেই লঙ্কিত হয়েছে মনুষ্যত্ব, সেখানেই পড়েছে দেবতার অভিশাপ। এমনকি স্বয়ং শিবও সেই ন্যায়ের শাসন থেকে মুক্ত হতে পারেননি, ন্যায়ের ব্যতিক্রমে নিরন্ন শিবেরও ভিক্ষা মেলেনি কোথাও ৷ একই নিয়মে, অন্নপূর্ণার নিন্দায় মুখর জাহাঙ্গীরের উপর যেমন ভয়ংকর বিপৎপাত ঘটিয়েছেন, তেমনি আপন ভক্তের তপস্যাকেও বিফল করে দিয়েছেন, ছলনার দ্বারা। সমগ্র মঙ্গল সাহিত্যে এমন জটিল দ্বন্দ্বময় কাহিনি আর নেই। দেবী স্বয়ং তাঁর ভক্তকেই ছলনা করেছেন মানবিক ন্যায় লঙ্কিত হয়েছে বলে, অন্নদামঙ্গল কাব্যের নূতনত্বের এর চেয়ে বড়ো প্রমাণ নেই। তাই সামান্য দ্বিধা থাকেনা ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলকে 'নূতনমঙ্গল' অভিধায় বিভূষিত করতে।