রবীন্দ্রনাথের নাটক-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় | বাংলা নাট্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান ও কৃতিত্ব

বাংলা নাট্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান ও ভূমিকা


রবীন্দ্র প্রতিভা মূলত গীতিকবির প্রতিভা—তা তিনি নাটক গল্প, উপন্যাস যাই লিখুন না কৈন, নিজস্ব আবেগ, কল্পনা, স্বপ্ন ও তত্ত্ববাদ তার নাটকগুলিতে যে একটু প্রকটভাবে ধরা পড়বে তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে? তাই রবীন্দ্রনাথের নাটক, কাব্য নাটক, সাঙ্কেতিক নাটক—সবই কবি প্রত্যয়ের বাহন হয়ে উঠেছে একথা অনস্বীকার্য। নাটক রচনার জন্য তিনি আপন প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাব ভঙ্গি উদ্ভাবন করে নিয়েছিলেন। তাঁর নাটকের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল—


১) রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত কবি। সেইজন্যে তার গল্প, উপন্যাস যেমন কাব্যধর্মী হয়েছিল, তার নাটকগুলিও কাব্যাশ্রয়ে গঠিত হয়েছিল।


২) রবীন্দ্রনাথের নাটকে ঘটনার ঘনঘটা নেই। তার নাটকে ঘটনার আবর্ত যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা জীবনের দ্বন্দ্ব সংঘাত তেমন নেই। তাঁর নাটক গীতোচ্ছ্বাসময়, গীতি কবিতার আবেগে রঞ্জিত।


৩) যা দৃশ্য তাকে নাটকের বিষয়বস্তু না করে, বাস্তবকে পরিস্ফুট না করে তিনি কোন একটা ভাবকে রূপক রহস্যের সাহায্যে নাট্যরূপ দিতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্র নাট্য সাহিত্যে তাই দৃশ্যমানতা অর্থাৎ দৃশ্যত্ব লক্ষণ অপেক্ষা কাব্য লক্ষণই অধিকতর পরিস্ফুট।


৪) নাটকের থাকে ঘটনার দ্বন্দ্ব। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নাটকে বহির্ঘটনার দ্বন্দ্ব নেই। চরিত্রের সংঘাত নেই, আছে কোন একটি তত্ত্ব বা Idea-র অভিব্যক্তি। এটা তার নাটকের বিশিষ্ট লক্ষণ।


৫) ঘটনার উপর ততটা দৃষ্টি না দিয়ে চরিত্রগত সূক্ষ্ম ভাব রহস্যকে রূপদান করেছেন। নাটকে ভাবের দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রদর্শন রবীন্দ্রনাথের মূল লক্ষ্য ছিল। এই জন্যই তাঁকে নাটক রচনার নিমিত্ত একটি অভিনব ভঙ্গিমা ও বিষয়বস্তু ও অভিনবত্বের বিচারে রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। যথা—


রবীন্দ্রনাথের গীতিপ্রধান নাটক বা গীতি নাট্য:

  • ১) বাল্মীকি প্রতিভা (১৮৮১) 

  • ২) কালমৃগয়া (১৮৮২), 

  • ৩) মায়ার খেলা (১৮৮৮)


রবীন্দ্রনাথের মনস্তত্ত্বমূলক নাটক:

  • ১) প্রকৃতির প্রতিশোধ (১৮৮৪), 

  • ২) রাজা ও রানী (১৮৮৯),

  • ৩) বিসর্জন (১৮৯০), 

  • ৪) মালিনী (১৮৯৬) 

  • ৫) প্রায়শ্চিত্ত (১৯০৯), 

  • ৬) গৃহপ্রবেশ (১৯২৫), 

  • ৭) শোধবোধ (১৯২৬), 

  • ৮) তপতী (১৯২৯)।


রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাট্য বা নাট্যকাব্য:

  • ১) চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২), 

  • ২) বিদায় ও অভিশাপ (১৮৯২), 

  • ৩) গান্ধারীর আবেদন (১৯০০) 

  • ৪) সতী (১৯০০), 

  • ৫) নরকবাস (১৯০০) 

  • ৬) লক্ষ্মীর পরীক্ষা (১৯০০) 

  • ৭) কর্ণকন্তী সংবাদ (১৯০০) প্রভৃতি।


রবীন্দ্রনাথের রূপক ও সাংকেতিক নাটক:

  • ১) শারদোৎসব (১৯০৮) 

  • ২) রাজা (১৯১০) 

  • ৩) অচলায়তন (১৯১২), 

  • ৪) ডাকঘর (১৯১২), 

  • ৫) ফাল্গুনী (১৯৯৬) 

  • ৬) গুরু (১৯১৮) 

  • ৭) রক্তকরবী (১৯১৬), 

  • ৮) মুক্তধারা (১৯২৫) 

  • ৯) কালের যাত্রা (১৯৩২)।


রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য:

  • ১) চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬), 

  • ২) চণ্ডালিকা (১৯৩৮), 

  • ৩) শ্যামা (১৯৩৯)।


রবীন্দ্রনাথের নৃত্যকাব্য:

  • ১) নটীর পূজা (১৯২৬), 

  • ২) চণ্ডালিকা (১৯৩৩), 

  • ৩) তাসের দেশ (১৯৩৩)।


রবীন্দ্রনাথের প্রহসন ও কৌতুকরস প্রধান নাটক:

  • (১) গোড়ায় গলদ (১৮৯২), 

  • ২) বৈকুণ্ঠের খাতা (১৮৯৭), 

  • ৩) শোধবোধ (১৯২৬), 

  • ৪) প্রজাপতি নিবন্ধ (১৯০৮) ও 

  • এর নাট্যরূপ চিরকুমার সভা (১৯২৬) প্রভৃতি।


রবীন্দ্রনাথের রূপক সাংকেতিক নাটক:

রবীন্দ্রনাথ যে বিচিত্র ধরনের নাটক রচনা করেছেন তার মধ্যে রূপক সাংকেতিক নাটকগুলি তার প্রতিভার চূড়ান্ত স্বাক্ষর বহন করে। এই শ্রেণীর নাটককে তিনি সামাজিক রাষ্ট্রিক, মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বকথার বাহন রূপে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। মানুষের অভ্যন্তর সত্তার এমন অনেক বক্তব্য থাকে যা আভাসে ইঙ্গিতে প্রকাশ করতে হয়। রূপক সাংকেতিক নাটকে রবীন্দ্রনাথ তাই করেছেন।

  • (১) শারদোৎসব (১৯০৮)

  • (২) অচলায়তন (১৯১২)

  • (৩) ফাল্গুনী (১৯১৬) 

  • (৪) মুক্তধারা (১৯২৫)

  • (৫) রাজা (১৯১০)

  • (৬) ডাকঘর (১৯১২)

  • (৭) রক্তকরবী (১৯১৬) 

  • (৮) কালের যাত্রা (১৯৩২)


“শারদোৎসব'—এক পুরোপুরি সাংকেতিক নাটক বলা যায় না। প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের মিলন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এখানে।


‘রাজা’ নাটকটি রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের তত্ত্বপ্রতিভূ। রাজা প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করেন না। তিনি অরূপ জগতের। কিন্তু রূপপিয়াসিনী রাণী সুদর্শনা রাজাকে রূপাসক্তির মধ্যে পেতে চান। কিন্তু পান না। যদিও রাজাকে উপলব্ধি করতে পারেন তার ভক্ত ঠাকুরদা এবং পরিচারিকা সুরঙ্গনা। অবশেষে রাণী একদিন রাজার অতি ভয়ঙ্কর রূপ ও মূর্তি দেখলেন এবং ভীত ও বিতৃষ্ণ হয়ে পালিয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে রূপ ও অরূপের দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন। রাণী শেষে তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। রূপের প্রতি তার ঘৃণ্য পিপাসা দূর হয়ে গেছে। রাজার মধ্যে অরূপের সন্ধান পেয়ে তিনি ধন্য হয়েছেন। সীমার মধ্যে অসীমকে কখনও বেঁধে রাখা যায় না। মাংসল রূপের জগতে কখনও অরূপের বাণীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা যায় না–রবীন্দ্রনাথ নাটকটিতে তা ব্যক্ত করেছেন।


‘ডাকঘর’ এই নাটকের ভাববস্তু বড় চমৎকার। বালক অমল ব্যাধিতে শয্যাগত। সে ঘরের সংকীর্ণ সীমা এবং বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে অসীমলোকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। বাহিরের সীমাহীন জগৎ তাকে প্রতিনিয়ত ডাকে। শুয়ে শুয়ে সে অসীম লোকের রাজার কথা ভাবে। তার ধারণা রাজা তাকে চিঠি পাঠাবে। তার এই অসম্ভব কল্পনা পাকাবুদ্ধির সংকীর্ণ মানুষেরা ঠাট্টা করে। অমলের রোগ বাড়ে, যন্ত্রণা বাড়ে। অসীমের পিয়াসি এই বালক তবু বিশ্বাস হারায় না। অসীমের সত্য দর্শনে তার মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তারপর একদিন রাজার ডাকঘর স্থাপিত হয়—এ হল ভগবানের বহিঃপ্রকাশ—এই ই বিশ্ব। অমল মুমূর্ঘু মানবতার প্রতীক। ডাকঘর অসীম ঈশ্বরের প্রতীক। অমল আশা করে রাজা প্রেরিত একটি চিঠির। সে চিঠি তাকে সীমার গণ্ডি থেকে দূর-সূদূরে নিয়ে যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাতে–বদ্ধ মানবাত্মা মুক্ত মানবাত্মায় পরিত্রাণ পেতে চায়। অমল তাই চেয়েছিল। সে মুক্ত মানবাত্মার প্রতীক হয়ে তাই অসীমের বুকে মিশে গেল।


‘মুক্তধারা’ উত্তরকূটের রাজা একটি পরিত্যক্ত শিশুকে ঝর্ণাতলে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে রাজ পরিবারে পালন করেন। ইনিই মানুষের মুক্তদাতা অভিজিৎ। বিভূতি যন্ত্রদানবের সহায়তায় মুক্ত জলধারাকে বন্দী করে শিব তরাইয়ের মানুষদের কৃত্রিম জলকষ্ট দিয়েছিল। অভিজিং যন্ত্রে আঘাত হেনে ঝরণার রুদ্ধ জলধারাকে মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু যন্ত্রের পাল্টা আঘাতে তিনি প্রাণ হারালেন। যন্ত্রের চেয়ে মানুষ বড়—সে কথা মানুষকে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। অভিজিৎ সেই শহীদ মানুষের প্রতীক।


‘রক্তকরবী’ কর্ষণজীবী এবং অ-কর্ষণজীবীর দ্বন্দ্ব দেখানো হয়েছে এই নাটকে। কর্ষণজীবী সভ্যতার প্রতীক নন্দিনী, আর অ-কর্ষণজীবী সভ্যতার প্রতীক রাজা। নন্দিনী রাজাকে মরা সোনার তালের জগৎ থেকে ফসলের বৈচিত্র্যের মধ্যে পেতে চেয়েছিল। রাজা বদ্ধ আত্মা এবং অ-বিদ্যা দ্বারা আচ্ছন্ন। নন্দিনীর ডাকে সে নিজেই তার যক্ষপুরীর কারাগার ভেঙে মুক্ত আলোয় এসে দাঁড়িয়েছে। এতদিন সে ছিল নিঃসঙ্গ এখন মানুষের মাঝখানে তার পাকা ঠাই হল।


‘ফাল্গুনী’-তে রবীন্দ্রনাথ জীবন ও মৃত্যু, শীত ও বসন্ত, জরা ও যৌবনের দ্বৈত সত্তার পারস্পরিক সম্পর্কের পটভূমিকায় এক নতুন ঋতু নাট্যের পরিকল্পনা করেছেন। একদল তরুণ গুহার জরাকে ধরে আনার পণ করে এবং ধরে আনে। কিন্তু দেখে তারা ধরে এনেছে তাদের সর্দারকে যিনি যৌবন ও বসন্তের প্রতীক।


রূপক সাংকেতিক নাটকে রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য:

রবীন্দ্রনাথের রূপক সাংকেতিক নাটকগুলি একটি স্বতন্ত্র পথ ধরে এগিয়েছে। এই নাটকগুলি বিশ্লেষণে একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়— তা হল নাটকগুলি রূপক না সাংকেতিক, নাকি রূপক এবং সাংকেতিকতার মিশ্রণ? এককথায় এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ কিছু সংকেত এবং প্রতীক নাটকে ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে। কিন্তু সংকেত বা প্রতীকগুলো নাটকের শেষে পৌঁছে সংকেত বা প্রতীক হয়ে থাকেনি। সংকেতগুলে ধীরে ধীরে রূপক পরিণামের দিকে অগ্রসর হয়েছে। অর্থাৎ সাংকেতিক ব্যঞ্জনায় গূঢ় রহস্যময়তার সমাধান নাটক শেষে দেওয়া হয়েছে। দানা বাঁধা রহস্য অস্তিমে চির জ্যোতির্ময় সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। নাটকের প্রথমে যে অপূর্ণতা, বিনষ্টি, শঙ্কা ও ব্যর্থতা তা শেষে জীবন প্রত্যয়ে আস্তিক্যবাদী হয়েছে। আসলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঔপনিষদিক। আনন্দে, বিশ্বাসী, তিনি অধ্যাত্মবাদী কবি সাধক, পরমপ্রাপ্তির ভাবরসে তাই তাঁর নাটক শেষ হয় রহস্য দূরীভূত হয়। যেমন ‘রক্তকরবী’ নাটক। এই নাটকে বহু প্রতীক, বহু সংকেত রহস্যময় বাতাবরণ তৈরী করে আমাদের এক অতি ভয়ঙ্কর জগতের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আমরা দেখি—


যক্ষ্মপুরী : আধুনিক কালের একশোষণ কারাগার, গ্রহণ লাগা এই পুরীতে যা বসুন্ধরা কাঁদছে। ক্ষুধা মারছে চাবুক। তৃষ্ণা মারছে চাবুক। সাধারণ মানুষের কোন অস্তিত্ব নেই। সবাই একএকটি সংখ্যায় পরিণত।


রাজা : রাজার মকরের দাঁত সে কামড়ে ধরে। মানুষকে খেয়ে সে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। উচ্ছ্বাস পরায়ণ, ধনতান্ত্রিক যন্ত্রব্যবস্থার প্রতীক সে।


নন্দিনী : সে ‘রক্তকরবী'-র ঝঙ্কার। সে রাতে আলোর মশাল। যক্ষপুরীতে সে প্রাণের প্রকাশ হয়ে উঠেছে। মৃত্যু তাকে আঘাত করতে পারে না। সে মাটি থেকেই যেন পাকা ফসলের গান নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।


কিন্তু এই নাটকের শেষে দেখি রাজা, নন্দিনী নেমে এসেছে একই সঙ্গে পথে। তাদের ব্যবধান ঘুচে পথ এক হয়ে গেছে। মানুষ রাজা সব মানুষের স্রোতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। শোষক-শোষিতের কোন ব্যবধান থাকেনি। এই নাটকের প্রতিটি চরিত্রের সংলাপই যেন একেকটি সংকেত। কিন্তু নাটক শেষে সংকেতের অর্থ বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। অর্থাৎ তার সাংকেতিক নাটকে রূপক ধর্মেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই নাটকগুলি বাংলা সাহিত্যে তো বটেই বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় কীর্তি হয়ে থাকবে।