শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের নাট্যগুণ

শ্রীকৃষ্ণ-কীর্ত্তনের নাট্যগুণ


প্রাচীন গ্রীক মনীষী অ্যারিষ্টটল কর্তৃক নির্দেশিত হয়েছে। নাটকের ‘সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য’ পরবর্তীকালে হয়তো তা থেকে আংশিক বিচ্যুত হয়ে নাটক লেখা হচ্ছে। তবুও বলতে হয় কাহিনিবৃত্ত, চরিত্র, সংলাপ, নাটকীয় সংঘাত ইত্যাদি বিষয়ই যে নাটকের ক্ষেত্রে মুখ্য তা অ্যারিষ্টটল নির্দেশ করেছিলেন। তাই তাঁর বিচার বিশ্লেষণকে পাথেয় করে শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন কাব্যকে এই আলোকে আলোকিত করা যেতে পারে। শুরুতেই একে জেনেছি ‘শ্রীকৃষ্ণকীৰ্ত্তন কাব্য' নামে ; তবু এর বর্ণনা রীতি ও বৈশিষ্ট্যই প্রমাণ করে, নাটকীয় গুণ এর মধ্যে বিদ্যমান। এর যেমন আছে একটি নিটোল কাহিনি, কয়েকটি চরিত্রের সমাবেশ, তেমনি নাটকের মূল উপাদান যে ‘সংলাপ’ তাও দেখা যায় বিভিন্ন চরিত্রের বাক্য বিনিময়ের মধ্যে। তা ছাড়া যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাত নাটকের উৎকর্ষতাকে প্রমাণ করে তা প্রতি মুহূর্তে এ কাহিনিতে দৃষ্ট হয়। কাব্যের আঙ্গিক বিশ্লেষণ করে ‘চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ এর লেখক সতীশ চন্দ্র রায় বলেছিলেন—'কৃষ্ণকীর্ত্তনে নাটকীয় ঘটনারই প্রাধান্য দেখা যায়। কবি রাধা কৃষ্ণ ও বড়াইর সরস ও সতেজ উক্তি প্রতুক্তি দ্বারাই শ্রেষ্ঠ নাট্য কাব্যের ন্যায় সকল রস ও ভাবগুলি ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। নাটকীয় উৎকর্ষে শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয়।”


শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন কাব্যখানি রচিত হয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের বিরাগ ও অনুরাগকে অবলম্বন করে। গোপের রাখাল বালক, কুলবধূ রাধার প্রণয় লাভে উন্মুখ ; বড়াই উভয়ের যোগসূত্র রচনা করেন। প্রথম থেকে রাধা কৃষ্ণের প্রতি বিরূপ, তথাপি কৃষ্ণ দুর্বার, বলপূর্বক রাধাকে সম্ভোগে নিয়োজিত করে। ধীরে ধীরে রাধার মনে কৃষ্ণানুরাগ সঞ্চারিত হয়। রাধা কৃষ্ণ প্রেমে যখন উন্মাদিনী, কর্তব্যের দোহাই পেড়ে দূতী বড়াইয়ের নিকট রাধাকে রেখে কৃষ্ণ মথুরা যাত্রা করে। শুরু হয় রাধার কৃষ্ণ বিরহ। এই বিরহে কাব্যের যবনিকা ঘোষিত হয়েছে। নাটক রচনার ক্ষেত্রে যে একটা নিটোল কাহিনির আবশ্যক তা এই কাব্যে পরিস্ফুট।


কোনও নাট্য ঘটনা উপস্থাপিত হয় কয়েকটি চরিত্রের সমাবেশে। এ কাব্যে, রাধা, কৃষ্ণ, বড়াই তিনটি মুখ্য চরিত্র ব্যতীত পাই—নারদ, রাধার শাশুড়ী, গোপিনীগণের পরিচয়। এ সকল চরিত্রগুলি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধারক ও বাহক। হয়তো মনুষ্য মন রাধা কৃষ্ণকে দেব মহিমায় অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে কারণ, হিন্দু শাস্ত্র কর্তৃক নির্দেশিত ‘রাধাকৃষ্ণ’ আর কেউ নন স্বয়ং লক্ষ্মী ও নারায়ণ, তবুও গভীর মনোযোগ সহকারে চণ্ডীদাসের এই কাব্যখানি পাঠ করলে মনে হবে রাধা পদাবলীর রাধা নন, তিনি আমাদের চোখে দেখা রক্তমাংসের মানবী, যিনি বিবাহিতা হয়ে নপুংসক স্বামীর কারণেই জীবন সম্ভোগ বক্তৃিতা। অন্তরের রুদ্ধ যন্ত্রণাকে নিরশনের জন্যে গোপের রাখাল বালক কৃষ্ণকেই শেষপর্যন্ত জীবনে গ্রহণ করেছিলেন। আর কৃষ্ণ তাঁর স্বভাব সুলভ পদ্ধতিতে যে সমস্ত কাজ করেছে তা অশ্লীলতার চরম পর্যায়ে উন্নীত হলেও তাকে আমাদের বলিষ্ঠ চরিত্র বলেই মনে হয়। ধর্মীয় সংস্কার ও আদর্শবাদকে পরিহার করে উভয় চরিএকে বিশ্লেষণ করলে মনে হবে, এই দুই চরিত্রই সুগভীর জীবন জিজ্ঞাসা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার অনুপম সৃষ্টি।


দ্বন্দ্ব বা সংঘাত নাটকের প্রাণ, তা অনুরণিত হতে থাকে চরিত্রের সংলাপ ও কাহিনি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে, শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তণের জন্ম খণ্ডকে বাদ দিলে প্রায় সর্বত্রই এর অস্তিত্ব প্রকটিত। বিশেষ করে ‘দানখণ্ডটি’ নাটকীয় উপাদানে সর্বশ্রেষ্ঠ। কৃষ্ণ যখন রাধাকে বলে—

“তোর রূপ দেখি মোর চিত নহে থির। 

প্রাণ যেহ্ন ফুটি জাত্র বুক মেলে চীর।।”

প্রত্যুত্তরে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে রাধা বলে—

“যার প্রাণ ফুটে বুক ধরিতেঁ না পারে।

গলাত পাথর বান্ধী দাহে পসী মরে।”

এই উক্তি প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে যে নাটকীয় মুহূর্তটি আবিষ্ট হয়ে আছে তা বড়ই বিস্ময়কর। এমন অসংখ্য চিত্র শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের সর্বত্রই নিহিত।


বাস্তবধর্মিতা নাটকের আরও একটা মহৎ গুণ। শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের বিভিন্ন পাত্রপাত্রী বিশেষ করে এর নায়ক-নায়িকার দ্বন্দ্ব, কলহ, বিরূপতা, রাগ-অনুরাগ, পরিশেষে প্রিয় বিরহে নায়িকার যন্ত্রণাভোগ, অত্যন্ত বাস্তবানুগ হয়ে উঠেছে।


নাটকের যাবতীয় ঘটনাই উপস্থাপিত হয় দৃশ্য পটের মধ্য দিয়ে। আর ভূমিকা অংশের মধ্য দিয়ে নাটকের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইঙ্গিত দেওয়া হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের জন্ম খণ্ডটিকে আমরা ভূমিকা রূপে মেনে নিতে পারি, কারণ এখানেই রাধা কৃষ্ণের জন্ম বৃত্তান্ত এবং তাঁদের বড়ো হয়ে ওঠার যাবতীয় ঘটনাই নিহিত। ‘তাম্বুল খণ্ড'কে প্রথম দৃশ্য রূপে চিহ্নিত করা যায়, এখান থেকেই কাহিনির নায়ক নায়িকার মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে যাত্রা শুরু। তাছাড়া শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের প্রত্যেকটি খণ্ডে যে সমস্ত শ্লোক ব্যবহৃত হয়েছে তা অত্যন্ত কৌশলে একটি খণ্ডের সঙ্গে আরেকটি খণ্ডের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করেছে, তাই এগুলিকে মঞ্চ নির্দেশক রূপে আখ্যাত করা যেতে পারে।


সংস্কৃত নাটকে বিভিন্ন পাত্র-পাত্রীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে যে বিদূষক চরিত্রটি পরিকল্পিত হয়ে থাকে বড়াই তার অনুরূপ। বড়াই একবার কৃষ্ণের দূতী হয়ে রাধার কাছে, আরার রাধার দূতী হয়ে কৃষ্ণের কাছে গেছে উভয়ের কর্তব্য সাধনের উদ্দেশ্যে। আপাত দৃষ্টিতে বিদুষকের সঙ্গে বড়াই চরিত্রের কোনও মিল না থাকলেও উভয়ের কর্তব্য সাদৃশ্যের জন্যই বড়াইকে আমাদের বিদুষক রূপে মেনে নিতে কোনও দ্বিধা থাকতে পারে না।


যে কোনও নাট্য উপস্থাপনায় কাহিনিকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যে গতি বা action এর প্রয়োজন শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে তাও দৃষ্ট হয়। জন্মখণ্ডের পর তাম্বুল খণ্ড থেকে এর কাহিনি শুরু। কৃষ্ণ রাধার উপর অনুরাগ বশত তাকে পাওয়ার জন্য প্রথম থেকেই তৎপর। মাধ্যমরূপে বড়াই এসে উপস্থিত। তাম্বুল খণ্ডে কৃষ্ণের প্রণয় প্রত্যাখ্যাত হলেও দানখণ্ডেই রাধার প্রতি কৃষ্ণের প্রতিশোধ গ্রহণ, নৌকা খণ্ডেই মিলন। বৃন্দাবন খণ্ড পর্যন্ত কাহিনি দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেছে। নাটকের অন্যতম মূল উপাদান যে ‘সাসপেন্স’ তা প্রায়ই প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে বানখণ্ডে মূর্ছিতা রাধাকে দেখে প্রত্যেকের মন উৎকণ্ঠায় ভরে যায়। আবার 'রাধা বিরহে' কৃষ্ণের জন্য রাধার আর্তনাদ শুনে মনে হয় জগতের শাশ্বত চিরস্তন মানব হৃদয়ের বিরহ যন্ত্রণাই রাধার মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে যেমন শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতি ও বিষয় আছে তেমন আছে গতিময়তা, যা অতি দ্রুত পরিণতির দিকে ধাবমান।


এছাড়া নাটকের ক্ষেত্রে সঙ্গীত হল একটা অপরিহার্য বিষয়, মূলত নাটক সম্পূর্ণতা লাভ করে সংগীত সংযোজনের মধ্য দিয়ে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে লেখক প্রতি খণ্ডে (প্রথম ও মধ্যাংশে) সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগ-রাগিনী নির্দেশ করেছেন। যেমন পাহাড়ী গুজ্জরী, কোড়া, ধানুষী ইত্যাদি। এ থেকে মনে হওয়াই স্বাভাবিক শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনে বিশেষ বিশেষ নাট্য লক্ষণগুলি গভীরভাবে প্রকট।


অশিক্ষিত দুই গ্রাম্য মানব-মানবীকে নিয়ে লেখক তাদের মনস্তত্ত্বকে গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করে এ গ্রন্থ প্রণয়ন করলেও তা যে দর্শকের দরবারে নাট্যায়ণের মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত হতো এবং দর্শকরা গভীর আগ্রহ সহকারে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নাট্যরূপ উপভোগ করতেন তারও প্রমাণ মেলে। বিশেষ করে এই গ্রন্থের দান খণ্ডে। যে সমস্ত প্রবাদ প্রবচনগুলো ব্যবহৃত হয়েছে তা দর্শকদের কাছে বড় আকর্ষণীয়। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য এই প্রসঙ্গে বিশেষ স্মরণযোগ্য— “বড়ু চণ্ডীদাস গ্রাম্য সমাজের জন্য তাঁহার কাব্য লিখিয়া ছিলেন বলিয়া ইহার মধ্যে নাটকীয়তা আরও তীক্ষ্ণভাবে প্রকট পাইয়াছে। ইহার কাব্য গুণকে ছাড়াইয়া ইহার নাট্যগুণই প্রধান হইয়া উঠিয়াছে।।”