বাংলা সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহ এর অবদান | বাংলা সাহিত্যে হুতোম প্যাঁচার অবদান

বাংলা সাহিত্যে হুতোম প্যাঁচার ভূমিকা


কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-৭০) খুবই ক্ষীণায়ু ছিলেন, মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে প্রয়াত হন। অত্যল্প সময়ের মধ্যে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। সমাজ সংস্কারে, শিক্ষা বিস্তারে, সংবাদপত্রের সম্পাদনায় ও পরিচালনায়, নানাবিধ দেশহিতৈষণা ও অজস্র দানকর্মে তিনি সেকালের সমাজের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন। 'বিদ্যোৎসাহিনী সভা’, ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’, ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ'-এর তিনি প্রতিষ্ঠাতা মধুসূদন-কৃত ‘নীলদর্পন’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদের প্রকাশক রেভারেণ্ড লঙ অভিযুক্ত ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হলে তিনি সে অর্থের ব্যয়ভার নিজে বহন করেছিলেন। তাঁর আর এক কীর্তি সেকালে কয়েকজন বিখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের দিয়ে মহাভারত অনুবাদ করিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয় করে সেই গ্রন্থ জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ। শিক্ষা— বিশেষত নারীশিক্ষার বিস্তার ও নারী শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠার কাজেও তিনি দুহাতে অর্থ ব্যয় করে গেছেন।


এতো গেল তার ব্যক্তিত্বের মহত্ত্বের দিক। অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যের সেবায়ও তাঁর অবদান অদ্যাপি স্মরণ করা হয়। তিনি অনেকগুলি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন, যদিও প্রসিদ্ধ ব্যঙ্গ গদ্যরচনা 'হুতোম প্যাচার নক্শা'-র জন্য তিনি সেকালেই সুবিদিত হননি, বাংলা গদ্যের চলিত রীতিভঙ্গি স্থাপনের জন্য ‘হুতোম পেঁচার নকশা’র সঙ্গে তিনি বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। 'বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’ ছাড়া তিনি ‘সর্বতত্ত্ব প্রকাশিকা' নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের 'বিবিধার্থ সংগ্রহে’র সম্পাদক রূপে তিনি বিশেষ সুখ্যাত হয়েছিলেন। কিছুদিন ‘পরিদর্শক' নামে একটি দৈনিক সংবাদপত্র পরিচালনা করেও যশস্বী হয়েছিলেন।


'হুতোম প্যাচার নক্শা'র লঘু চলিতরীতির গদ্য এবং সমসাময়িক সমাজের হাস্যতরল চিত্র বা নকশা রচনায় নয়, সিরিয়াস (serious) ধরনের গদ্যেও তার যথেষ্ট হাত ছিল। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতা, গীতার অনুবাদ, 'বঙ্গেশবিজয়’ নামে অসমাপ্ত প্রভৃতিতে তাঁর এই প্রকার গদ্যের পরিচয় মিলবে। তবে এসবে তিনি একটু সংস্কৃতঘেঁষা গুরুভার রচনা-রীতি ব্যবহার করেছেন। এ ভাষায় বিদ্যাসাগর-অক্ষয়কুমার দত্তের প্রভাব আছে।


সে যা হোক, ‘হুতোম প্যাচার নক্শা'-ই তার অক্ষয় কীর্তি। এটির ১ম-২য় খণ্ড একত্রে প্রকাশিত হয় ১৯৬৫-তে। এই গ্রন্থে চলিত গদ্যভাষা ব্যবহার করে কালীপ্রসন্ন বাংলা ভাষায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটালেন। বইটি আদ্যুপান্ত চলিত ভাষায় লেখা। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় একে ‘কলকেতাই চলতি বুলি’ (‘অর্থাৎ Calcutta Cockney') বলেছেন। গ্রন্থটি কতকগুলি চিত্র বা নক্শার সমষ্টি। সকালের কলকাতার সমাজের অভিজাত মধ্যবিত্ত ও সাধারণের মধ্যে অনেক প্রকার দুর্নীতি ছিল। নূতন শহরের একটা ভীষণ অন্ধকার দিক ছিল। কালীপ্রসন্ন সেই অন্ধকারের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন এবং ‘হুতোম প্যাচা’ ছদ্মনামে সেই চিত্রগুলি হুবহু বর্ণনা ও অঙ্কন করেছেন। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় সেই কলকাতার চিত্রের সংক্ষিপ্তসার সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে: "সে যুগের কলকাতার ধনী মধ্যবিত্ত ও সাধারণ সমাজ কি পরিমাণে হজুগপ্রিয় ছিল, হুল্লোড়ের ধুলোট-উৎসবে কতটা মাখামাখি করত, উৎসব-অনুষ্ঠানে জঘন্য ব্যাপার কত অবলীলাক্রমে অনুষ্ঠিত হত,—শিক্ষিত যুবক, ঘোর ব্রাহ্ম, নাসিকাধ্বনিকারী বৈষ্ণব বাবাজী, অলিন্দবিহারিণী স্থূলঙ্গিনী বারবধু, চড়ক, গাজন, দুর্গোৎসব, মাহেশের রথ, চাকৱে বাবু, মোসাহেব পরিবৃত মাংসের স্তূপ অর্থাৎ জমিদার, পথের ভিখারী, কেরানি, দোকানী, হাটুরে, পুরুতঠাকুর, জুতো পায়ে নবীন নাগর ইত্যাদি কলকাতার সংযাত্রার নানাবিধ রংদার ব্যাপার ছদ্মনামী হুতোম আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন।"


‘হুতোমে’র পূর্ববর্তী টেকচাঁদ (প্যারীচাদ) চলিত ভাষার পথ খনন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার ভাষা অবিমিশ্র চলিত ছিল না; সাধু ও চলিত দুই রীতিতে সে-ভাষা-ছাঁদ তৈরি হয়েছিল অর্থাৎ তা ছিল গুরুচণ্ডালি। কিন্তু কালীপ্রসন্নের গদ্যভাষা একেবারে চলতি মৌখিক বুলি। প্রমথ চৌধুরী পরবর্তীকালে একটি সুন্দর সাহিত্যিক গদ্যভাষার আদর্শ সৃষ্টি করেছিলেন,—কিন্তু সে ভাষা চলিত সর্বনাম-ক্রিয়াপদ-সমন্বিত মার্জিত সাধু ও তৎসম ভাষা-ঋদ্ধ উচ্চাঙ্গের গদ্য, উৎকৃষ্ট শ্রেণীর মনন-প্রধান রচনার আধার। তবে প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলি’-গদ্যে কালীপ্রসন্নের গদ্যের মৃদু আভাস হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়। আসলে ‘হুতোমি’ ভাষা বোধহয় একালেও অনুসরণীয়, – তা বাংলা গদ্যভাষার যতই নমনীয়তা (flexibility) বেড়ে থাক।


‘হুতোম প্যাচার নক্শা'য় উপন্যাসের লক্ষণ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। লেখক সচেতনভাবে উপন্যাস লিখতে চেষ্টা করেননি তা ‘নক্শা' বলে অভিহিত করা থেকেই বুঝে নেওয়া যায়। সুতরাং, প্যারীচাদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর সঙ্গে এর তুলনা অসমীচীন। হুতোম সেকালের কলকাতার নক্শা বা চিত্র এঁকেছেন মৌখিক কথ্যভাষার তুলিতে, কিন্তু ‘আলালে’ উপন্যাস রচনার একটা চেষ্টা ছিল হয়তো, – 'আলালে' কিছু কিছু উপন্যাস-লক্ষণও খুঁজে পাওয়া যাবে। আসলে চলিত ভাষা-রীতির প্রধান কারিগর হিসাবে কালীপ্রসন্নকে গণ্য করতে হবে। হয়তো তাঁর গদ্যের সঙ্গে পরবর্তীকালের বিবেকানন্দের গদ্যের তুলনা চলে। বিবেকানন্দও ‘কলকেতাই চলতি বুলি’ তার চিন্তা-ভাব-আবেগপ্রধান গদ্যরচনায় ব্যবহার করেছিলেন।