মঙ্গলকাব্য ধারায় শিবায়ন কাব্যের বিশিষ্টতা | মঙ্গলকাব্য ধারায় শিবায়ণ এর গুরুত্ব

মঙ্গলকাব্য ধারায় শিবায়ন কাব্যের স্বতন্ত্র


প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে শিব একটি বিচিত্র চরিত্রের দেবতা, একদিকে তিনি ভস্ম বিভূষিত, শ্মশানচারী, যোগীবাহ, আর একদিকে তিনি উমাকাস্ত। কামকে ভস্মীভূত করেছেন তিনি। কখনো কখনো কামাধীন হয়েছেন। তিনি ভিখারী, কিন্তু তাঁর সহধর্মিনী অন্নপূর্ণা ষড়ৈশ্বর্য শালিনী। একদিকে তিনি ধ্যান স্তিমিত, ত্রিগুণাতীত আর একদিকে সর্বধ্বংসী মহাকাল। তাঁর প্রলয় নৃত্যের তালে একদিকে নবজীবন উচ্ছিত হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে তিনি সবকিছুকে নিমেষের মধ্যে ধ্বংস করেন। কিন্তু বাংলা দেশে মধ্যযুগে শিব দুর্গাকে অবলম্বন করে কতকগুলি আখ্যানকাব্য রচিত হয়েছিল যা অনেকটা মঙ্গলকাব্যের মত। এগুলি শিবায়ন নামে পরিচিত, কোন কোন মঙ্গলকাব্যের গোড়ার দিকেও শিবদুর্গার গৃহস্থালীর গল্প আছে। আবার অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত শক্তি পদাবলীতে শিবের যৎকিঞিৎ প্রসঙ্গ আছে। বাংলার শিবকাহিনী বিষয়ক শিবায়নকাব্যগুলি বড় বিচিত্র। এতে পৌরাণিক মহেশ্বরের চেয়ে কৃষক শিবের চিত্রই বেশি ফুটেছে। বলতে গেলে সমগ্র ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মসাধনায় শিবের বিশেষ প্রভাব দেখা যায়।


শিবায়ন কাব্যের সংজ্ঞা:

মধ্যযুগে বাংলাদেশে শিব দুর্গার দরিদ্র সংসার জীবন কল্পনা করে মঙ্গল কাব্যের অনুসরণে যে আখ্যান কাব্য লেখা হয়েছিল সেইগুলি শিবায়ন নামে পরিচিত।


শিবায়ন কাব্যের বৈশিষ্ট্য

শিবায়ন কাব্যের দুটি অংশ। প্রথম অংশে আছে শিবের পৌরাণিক মহিমা কীর্তন। যেমন দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস, সতীর দেহ ত্যাগ। এর পর মেনকা ও হিমালয়ের গৃহে উমারূপে জন্মগ্রহণ, মহাদেবের সঙ্গে তাঁর বিবাহ। এই পর্যন্ত পৌরাণিক কাহিনি প্রায় সমস্ত শিবায়নেই এক ধরনের।


দ্বিতীয়াংশে আছে কৃষিজীবী শিবের প্রাত্যহিক সংসার জীবনের চিত্তাকর্ষক ঘটনা প্রসঙ্গ। দারিদ্রের জন্য হরপার্বতীর কলহ, চাষবাস করে দারিদ্র ঘোচাতে শিবের প্রয়াস ভৃত্য ভীমের সঙ্গে জমি প্রস্তুত করা, বীজ বপন, ধান্য চারার পরিচর্যা, শিববিরহে দুর্গার কষ্ট, শিবকে বাগ্নিী বেশে ছলনা করবার জন্য শিবের কৃষিক্ষেত্রে দেবীর যাত্রা, বৃদ্ধ শিবের বাদিনী আসক্তি, তরুণী পরস্ত্রীর আসঙ্গ লোভে শিবের হাঁটু জলে নেমে মাছধরা, দেবীর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, ব্যাপার বুঝে চিন্তিত মুখে শিবের কৈলাসে ফিরে এসে লাম্পট্যের অভিযোগে দেবী কর্তৃক বিশেষ ‘আপ্যায়ন লাভ', অভিমানে দেবীর সপুত্র কন্যা পিত্রালয়ে গমন, মহাদেবের শাঁখারীর ছদ্মবেশে শ্বশুর বাড়ী যাত্রা, সেই দুই বেশে দেবীকে শাঁখা পরানো, তারপর যথাকালে দুজনের পুনর্মিলন, বৃদ্ধ হরের নবযুবকের মতো ব্যবহার, তারপর স্ত্রী সন্তানাদিসহ প্রসন্ন মনে কৈলাসে ফিরে আসা শিবায়নের দ্বিতীয়াংশে এই লৌকিক কাহিনী সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।


মঙ্গল কাব্যের সঙ্গে শিবায়ন কাব্যের পার্থক্য

১। মঙ্গলকাব্যের মত শিবের পূজা ও মাহাত্ম্য প্রচার শিবায়ন কাব্যে দেখা যায় না। কোন অনিচ্ছুক ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে বা প্রলোভন দেখিয়ে শিবভক্তে পরিণত করার চেষ্টা বা কোন শাপভ্ৰষ্ট দেবদেবীর সাহায্যে পূজা প্রচারের পরিকল্পনা এখানে দেখা যায় না।

২। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে যেখানে বাণিজ্য বা শিকার পেশার পরিচয় পাওয়া যায়। সেখানে শিবায়ন কাব্যে পাওয়া যায় চাষবাসের কথা।


কবিগণ : সপ্তদশ শতাব্দীতে মোট দুজন কবির নাম পাওয়া যায়— শঙ্কর কবিচন্দ্র ও রামকৃষ্ণ রায়। এছাড়া আছে। রামের ভট্টাচার্য, ও রামচন্দ্র কবিচন্দ্র।


রামেশ্বরের কবি প্রতিভা:

শিবায়ন কাব্যধারায় সবচেয়ে খ্যাতিমান কবি, নাম- রামেশ্বর ভট্টাচার্য (চক্রবর্তী)। শিবায়ন ছাড়া তাঁর খ্যাতি সত্যপীরের ব্রতকথা লেখার কারণেও প্রতিষ্ঠিত। কবির জন্মস্থান মেদিনীপুর জেলার ঘাটালের অন্তর্গত বরদা পরগণার যদুপুর গ্রাম। “সমকন বরদাবাটী যদুপুর গ্রাম। বেদজ্ঞ পণ্ডিত পিতামহের নাম গোবিন্দ চক্রবর্তী। ব্রাহ্মণের যজন যাজনের জন্য 'ভট্টাচার্য' পদবী গ্রহণ। পিতার নাম লক্ষণ, মাতার নাম পার্বতী, দুই পত্নী—সুমিত্রা ও পরমেশ্বরী। কবির জন্মকাল পুঁথি প্রকাশক ড. পঞ্চানন চক্রবর্তীর মতে, ১৬৭৭ খ্রীষ্টাব্দে। তাঁর এই অনুমানের কারণ, ভূস্বামী শোভা সিংহের ভ্রাতা হেম বা হিম্মৎ সিংহের হাতে কবির নিগ্রহ এবং কর্নগড়ে রামসিংহের সভায় আশ্রয় লাভ, সম্ভবতঃ ১৬৯৭-৯৮ খ্রীষ্টাব্দের ঘটনা। রামসিংহের পুত্র যশোবন্ত সিংহের রাজসভায় সভাকবির সম্মান পেয়েছিলেন কবি রামেশ্বর। কবির গুরু বংশের রোজনামচার ভিত্তিতে ড. চক্রবর্তী আরো মনে করেন ১৭৪৫ খ্রীঃ কবির তিরোধান হয়। ড. পঞ্চানন চক্রবর্তীর মতে রামেশ্বরের উপাধি ছিল—কবিকেশরী। কেননা সত্যপীরের একটি পুঁথিতে আছে—

“উদ্দেশের অষ্টাঙ্গে দ্বিজ করিল প্রণাম।

কহে কবি কেশরী কেশর কোণিরাম।।"


আনুমানিক ১৭১২ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে কাব্যটি রচিত হয়। রামেশ্বরের ‘শিবকীর্তন' কাব্য সাতটি পালা সংযুক্ত। তৃতীয় পালার মাঝামাঝি পর্যন্ত কাহিনি পদ্মপুরাণ কন্দ পুরাণ এবং কালিদাসের কুমার সম্ভব কাব্যের পৌরাণিক উপাদান নির্ভর—যেমন সৃষ্টি ও উৎপত্তি বর্ণনা, দক্ষ যজ্ঞ ও সতীর দেহত্যাগ, দক্ষের ছাগমুণ্ড লাভ, মদন ভষ্ম, রতিবিলাপ, গৌরীর তপস্যা প্রভৃতি প্রসঙ্গ। তৃতীয় পালায় হরগৌরীর বিবাহ বর্ণনার পর থেকে কাহিনীর গতিমুখ লৌকিকতার পথে চলেছে। 'পুরাণখণ্ডে’ তাঁর কাব্যের বিশেষ কোন বৈচিত্র নেই, কেবল পুরাতনের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু এই লৌকিক অংশে দরিদ্র শিবের গার্হস্থ্য জীবন, দাম্পত্য কলহ, চাষবাস, মাছ ধরা প্রভৃতি বর্ণনার বাস্তবতার পরিচয় পাওয়া যায়। শুধু কৃপণ শিবের দারিদ্র্যের বস্তুচিত্র নয়, বিয়ের পর কন্যা-বিদায়ের মুহূর্তে কন্যার জননীর জামাতার প্রতি উপদেশ :

“কুলীনের পোকে আর কি বলিব আমি।

আঁট্যু ঢাক্যা বস্ত্ৰ দিও পেট ভরাভাত। 

প্রীত কর যেমন জানকী রঘুনাথ।।”


রামেশ্বরের রচনায় অনুপ্রাসের আতিশয্য এবং তৎসম শব্দের বহুল উপস্থিতে দেখা যায়, যা ত্রুটি রূপে গণ্য—

ঠাকুরানীর ঠেকিতে ঠাকুর ঠেক্যা হন।

“কাণ্ডের লাগিয়া কান্দ্যা কাকুবাদ করে।"


কিছু কিছু বাক্য বিন্যাসে কবির কৃতিত্ব পরিস্ফুট : “দিনে হও ব্রহ্মচারী রাতে গলাকাটা।" 'অনর্থের বীজ অর্থ মত্ততার ঘর।' “নামের নিমিত্ত লোকে নানা কর্ম করে।” ইত্যাদি। রামেশ্বরের কাব্যের রুচি অনেক স্থানেই শুচি স্নিগ্ধ নয়। যেমন কোঁচপল্লীতে শিবের যাত্রা বর্ণনা যা বুদ্ধ হর ও দুর্গার বাসর বর্ণনার অংশ। এছাড়া, বগ্দিনী বেশী দেবীকে দেখে হরের কামোন্মত্ততার মধ্যে গ্রাম্য মনোভাব লক্ষ করা যায়।


এ কাব্যের দ্বিতীয় অংশ থেকে অনুমান করা চলে, আর্যেতর অস্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত আদি বঙ্গবাসীদের সমাজ যখন মূলত কৃষিনির্ভর ছিল, তখন সেই দূরস্থিত অতীতের কৃষক সমাজে যে ধরণের কৃষিদেবতার পরিকল্পনা হয়েছিলো বহু শতাব্দী পরেও তার ক্ষীণ ধ্বংসাবশেষও এদেশে বজায় ছিল। পরবর্তী কালে পৌরাণিক শিব এবং আদিম কৃষি সংস্কৃতির অমার্জিত স্থূল দেবতাকে সংমিশ্রিত করে শিবায়ন কাহিনীগুলি গড়ে উঠেছে।