বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর অবদান | বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা

বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব


সমালোচক হরেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় তাঁর দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্র’ গ্রন্থে বলেছেন “বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভা ছিল বহুমুখী—সেই জন্য তিনি একাধারে কবি, শিল্পী, সমালোচক, সাহিত্যিক ঔপন্যাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, দার্শনিক, সামাজিক ও সমাজবেত্তা ছিলেন।” বঙ্কিমচন্দ্র বহুমুখী ও বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী ছিলেন সে বিষয়ে কোন সংশয় নেই। শিল্পী বঙ্কিম ও তাত্ত্বিক বঙ্কিম কারো সঙ্গে কারো বিরোধ নেই। তা একে অপরের পরিপূরক। বস্তুত আমাদের দেশে তো দূরের কথা, বিদেশেও এমন যৌগিক প্রতিভা কদাচিৎ দেখা যায়। গত শতকের শেষ পাদ পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন বাংলা সাহিত্যে দ্রোণাচার্য। তাঁর সারস্বত সাধনায় ‘কারায়িত্রী প্রতিভা’ ও ‘ভাবয়িত্রী প্রতিভা’, দুইয়েরই সমান প্রভাব দৃশ্যমান। বঙ্কিমচন্দ্র মধুসূদনের মতো ইউরোপ ভ্রমণ না করলেও জ্ঞান চর্চার সূত্রে মানস ভ্রমণে তাঁর মন হয়েছিল প্রতীচ্য বিদ্যা-নিষার্ত। রুশো, জন স্টুয়ার্ট, মিল, ভলতেয়ার প্রমুখ বহু মনীষীর চিন্তা উৎপাদনে সংগঠিত হয় তাঁর প্রবন্ধের রাজপ্রাসাদ, রোমান্টিক যুগের ইংরেজ গদ্যের প্রত্যক্ষত ও ঋজুতা, কর্মের বৈচিত্র্য, কবিতার কারুকার্য খুব সম্ভবত এই জ্ঞাত প্রাজ্ঞ প্রবন্ধ শিল্পীর অজানা ছিলনা। তাই তা ‘বঙ্গদর্শন' পত্রিকার দৈহিক সৌষ্ঠব বর্দ্ধন বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছিল। প্রতিমুহূর্তে অভিনব সুর ঝংকারে ধ্বনিত হয়েছিল সম্পাদকীয় কলমে। যা আজও বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনকে পরিপুষ্ঠতা দান করে আপস বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।


বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ :

বঙ্কিমচন্দ্রের সমগ্র প্রবন্ধ নিবন্ধ ও সমালোচনামূলক রচনাগুলিকে মূলত চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। যেমন—(ক) দর্শন ইতিহাসধর্মী প্রবন্ধ (খ) বিজ্ঞানমূলক প্রবন্ধ (গ) সাহিত্যধর্মী প্রবন্ধ, (ঙ) ব্যক্তিমূলক প্রবন্ধ।


দর্শন ও ইতিহাসধর্মী প্রবন্ধ : এই পর্যায়ে যে সকল প্রবন্ধগুলি বিশেষ উল্লেখ্য তা হলো— বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬), সাম্য (১৮৭৯), প্রবন্ধ পুস্তক (১৮৭৯) কৃষ্ণচরিত্র (১৮৮৬), বিবিধ প্রবন্ধ ১ম-১৮৮৮, ২য়-১৮৯২), ধর্মতত্ত্ব (১৮৮৮), শ্রীমদ্ভাগবত (মৃত্যুরপর প্রকাশিত ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগে পূর্ণ। কিন্তু কোথাও যুক্তি বাহুল্যে রূঢ়তা ক্লান্ত নয়। জীবন্ত জাতীয়তাবোধ ও দৃঢ়বদ্ধ স্বদেশিকতাই এগুলির ধ্রুবপদ। বস্তুত জীবন লইয়া কি করিবে?” এই উজ্জ্বল প্রশ্ন তাঁর আশৈশব, এই উজ্জ্বল প্রশ্নের উত্তর সন্ধানেই তার সমগ্র জীবন শেষে স্বদেশী পূজায় ধর্মের খোঁজে উৎসর্গীকৃত। তাঁর ভাবয়িত্রী প্রতিভা মানবধর্ম সমাজধর্ম প্রভৃতির সঙ্গে ধর্ম চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শেষে হিন্দু ধর্মের ভাবনায় কেন্দ্রীভূত হয়। তাঁর ঈশ্বর পুরাণ প্রতীম অলৌকিক পুরুষ নয়, তা মানুষেরই প্রতিরূপ। উল্লেখ্যনীয় কৃষ্ণচরিত্রে জাতির কালাপাহাড়ী সঙ্কটে কৃষ্ণকে আদর্শ মানুষ ও অনুশীলনতত্ত্বের জীবন্ত বিগ্রহরূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন।


বিজ্ঞানধর্মী প্রবন্ধ : বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ে স্মরণীয় প্রবন্ধগ্রস্থ হলো বিজ্ঞান রহস্য (১৮৭৫), এর অন্তর্গত আশ্চর্য সৌরৎপাত, আকাশে কত তারা আছে? ধূলা, গগন পর্যটন, চঞ্চল জগৎ, কতকাল মনুষ্য? জৈবাসিক, পরিমাণ রহস্য এবং চন্দ্রলোক। এ সকল প্রবন্ধের দ্বারা তিনি শিক্ষিত জনকে সতর্ক করে বলেন: “বিজ্ঞানের সেবা করিলে বিজ্ঞান তোমার দাস, যে বিজ্ঞানকে ভজে, বিজ্ঞান তাহাকে ভজে। কিন্তু যে বিজ্ঞানের অবমাননা করে বিজ্ঞান তার কঠোর শত্রু।” তবে তাঁর আগ্রহ মূলতঃ জ্যোতিবিজ্ঞানেই যেন নিবদ্ধ। যেমন ‘আকাশে কত তারা আছে'। রচনায় বিস্ময় ভরা জিজ্ঞাসাঃ এ আশ্চর্য কথা’ যে বুদ্ধিতে ধারণা করিতে পারে? যেমন পৃথিবী মধ্যে এক কণা বালুকা, জগৎ মধ্যে এই সমাগরা পৃথিবী তদপেক্ষাও সামান্য, রেণুমাত্র বালুকার বালুকাও নহে।” এখানে বিজ্ঞানের রহস্য সাহিত্যের তুলিতে চিত্রিত। আবার দৃশ্যাত্মক বর্ণনার আভাস মেলে ‘ধূলা’ প্রবন্ধেঃ “ছায়া মধ্যে রৌদ্র না পড়িলে রৌদ্রের ধূলা দেখা যায় না। কিন্তু রৌদ্রমধ্যে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোকের রেখা প্রেরণ করিলে ঐ ধূলা দেখা যায়।


সাহিত্যধর্মী প্রবন্ধ : তৃতীয় পর্যায়ের প্রবন্ধগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য : বিবিধ প্রবন্ধ‌ (১ম খণ্ড ১৮৮৮) এর অন্তর্ভুক্ত, উত্তরচরিত, গীতিকাব্য, প্রকৃত ও অতিপ্রাকৃত, বিদ্যাপতি ও জয়দেব, ‘বাঙ্গালার জন্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ প্রভৃতি রচনাংশ। প্রাচীন সাহিত্য সমালোচনায় প্রচলিত রীতি থেকে মুক্তি ভিন্ন আধুনিক সাহিত্য সমালোচনা অসম্ভব। বঙ্কিমচন্দ্র তাই এ সকল প্রবন্ধে একটা অভিনব পদ্ধতির দ্বারা ক্রম অগ্রসর হয়েছেন। গীতিকাব্য, প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন— ‘যাহা অবক্তব্য তাহাতে গীতিকাব্যের অধিকার।' কিংবা সকলই নিয়মের ফল, সাহিত্যও সিস্টেমের ফলমাত্র।” এ সকলই মনে হয় শাশ্বত ও চিরন্তন অভিব্যক্তি। 'শকুন্তলা-মিরিন্দা, দেশদিমনা, প্রবন্ধটিতে তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনায় প্রবন্ধ দৃষ্টান্তে স্বীকৃত, “Comparison and analysis are the chief tools of the crictic" (T. S. Eliot)। আবার ঈশ্বর গুপ্তের সমালোচনায় তার রসবাদী মনের সরস দিকটি উদঘাটিত হয়েছে। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের সমালোচনায় তেমনি তাঁর অখণ্ড মানব স্বভাব ধর্ম সুপরিস্ফুটঃ “রুচির মুখ রক্ষা করিতে গেলে, ছেঁড়া তোরাপ, কাটা আদুরী, ভাঙা নিমচঁাদ আমরা পাইতাম।” “বাংলার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন' বাংলা সাহিত্যের প্রথম ম্যানিফেস্টো (ইস্তাহার)। এখানে যুগনায়ক প্রাবন্ধিকের সমাজ সচেতন মনের পরিচয় উদ্ঘাটিত। ‘লোকরহস্য’ প্রবন্ধ গ্রন্থটি ক্ষুদ্র বা অনুরচনার সমষ্টি। কিন্তু ভাবে ও ভাষায় আন্তরিক। 'ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুল' যা আজও সমগ্র মনুষ্য জীবনকে সুপথে পরিচালনার প্রথম হাতিয়ার।


ব্যক্তি ধর্ম যুগ প্রবন্ধ : ব্যক্তিধর্মী প্রবন্ধের শুভ সূচনা বঙ্কিমের হাতে। এই ব্যক্তিধর্মী প্রবন্ধ তথ্য বিভিন্ন এবং যুক্তিরিক্ত ব্যক্তিরস এবং ব্যক্তির স্বগত গুঞ্জনরণই সেখানেই মুখ্য। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্ত’ এই দৃষ্টান্তে বিশ্বসাহিত্যে দুঃষ্প্রাপ্য মনোহর। প্রকাশকাল (১৮৭৫) এর তিনটি অংশ কমলাকান্তের দপ্তর (১৪টি প্রবন্ধ), কমলাকান্তের পত্র, (৫টি নিবন্ধ), কমলাকান্তের জবানবন্দী, কমলাকান্তের মধ্যে পাণ্ডিত্যের যে পরিচয় মেলে, তা খুব অকিঞ্চিৎকর নয়। কিন্তু তা যেন উপরিপাওনা। আসপ্রাপ্তি সাহিত্য স্রষ্টা, স্বাদেশিক, কবিমনের বহু বিচিত্র রামধনু ব্যক্তিত্ব। আমার মন, একা, বিগল প্রভৃতি প্রবন্ধ মনুষ্য জীবনের চরম সত্যের আধার। এক কথায় বিষয়ের দিক থেকে কমলাকান্তের মন বহুস্পর্শী।


বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান :

  • প্রচ্ছন্ন পরিহাস সরস, ভাষার প্রসাদগুণ, কাব্যধর্মিতা বঙ্কিম প্রবন্ধের কালজয়িতার স্মারক।

  • শব্দ চয়নে উদারতা ও পরিমিতি বোধ যেমন তাঁর গদ্যে লক্ষ্য করা যায়, তেমনই শব্দ মোহ ও প্রভাতি মাধুর্যের বিপদ থেকে আত্মরক্ষা প্রবণতা ও অনায়াস লক্ষণীয়।

  • দুরুচার্য শব্দ, বৃথা অনুপ্রাস, অস্পষ্টতা ও অর্থাভাস বর্জনের চেষ্টা তার লেখনীতে প্রকাশিত।

  • প্রশ্নাত্মক বাক্য ব্যবহারের দ্বারা পাঠকমনে ঔৎসুক্য ও সংশয় জাগ্রত রাখার কৌশল ও তার গদ্যরীতির মধ্যে দেখা যায়।

  • সংযোজক অসমাপিকা কি ক্রিয়াপদের সংখ্যা হ্রাস ও সমাপিকা ক্রিয়াপদের অধিক ব্যবহারে বাক্যে দ্রুততা সৃষ্টি।

  • অন্তরঙ্গ বর্ণনা ভঙ্গির দ্বারা পাঠকের সঙ্গে রচয়িতার ব্যক্তি সম্পর্ক স্থাপন।

  • নাটকীয় আকস্মিকতার দ্বারা পাঠক চিত্তকে সচকিত করার চেষ্টা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য সমূহ দেখা যায়।


পরিশেষে স্বীকার করতেই হয়, সাহিত্যে অঙ্গনে বঙ্কিমচন্দ্রের এই ক্রম উত্তরণের মূলে তার ‘বঙ্গদর্শনের সম্পাদনাকালে বঙ্কিম সুযোগ পেয়েছিলেন বৈচিত্র্যময় সাহিত্য রচনা ও প্রকাশের। এই সম্পর্কে সমালোচক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য অনুসরণ করে আমরাও বলতে পারি, বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রকাশের পূর্বে কী ছিল আর পরে কী পেলাম। তা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে আমরা মুহূর্তেই অনুভব করতে পারলাম। কোথায় গেল সেই অন্ধকার, সেই একাকার, সেই সুপ্তি—কোথায় গেল সেই বিজয় বসন্ত, গোলের কাওয়াশি, বালক ভুলানো কথা, কোথা থেকে এলো এত আলোক এত আশা, এত সঙ্গীত, এত বৈচিত্র্য বঙ্গদর্শন যেন তখন আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার মতো। কত বাক্য, নাটক, উপন্যাস, কত প্রবন্ধ সমালোচনা, বাংলাদেশকে যেন একেবারে মুখরিত করে তুলল। বাংলা সাহিত্য অকস্মাৎ যেন বাল্যকাল থেকে যৌবনে উপনীত হলো। এ সকল প্রশংসার একমাত্র উত্তরাধিকারী হলেন সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক সম্পাদক সব্যমানী বঙ্কিম।