বাংলা ভাষায় সংস্কৃত মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে? কাশীরাম দাসের কবি প্রতিভার পরিচয় দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের কারণ নির্দেশ করো।

কাশীরাম দাসের কবি প্রতিভা


মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি কাশীরাম দাস। রামায়ণের কবি কৃত্তিবাসের সঙ্গে এক সূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে কাশীরাম দাসের নাম। মধ্যযুগে বৈব সাহিত্যের কথা বাদ দিলে, কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারতের মতো অক্ষুণ্ণ গৌরব এবং জনপ্রিয়তা লাভ আর কোনও কাব্যের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বস্তুতঃ বাঙালির ব্যক্তি জীবন, সামাজিক আদর্শ ও নীতি কর্তব্যকে কাশীরাম যেভাবে প্রভাবিত করেছেন, তাতে তাঁকে কৃত্তিদাসের সমতুল্য বলে মনে হয়। অবশ্য কাশীরামের নামে প্রচলিত অষ্টাদশ পর্বে সুগ্রথিত বৃহৎ মহাভারতের কতটুকু তাঁর নিজের রচনা, কতটুকু তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বা জামাতার সংযোজনা কতটুকুই বা অন্য কবির লেখনীর ফসল, তা নির্ণয় সাধ্যাতীত। তিনি সপ্তদশ শতকের কবি হলেও, তাঁর জন্মস্থান, রচনাকাল এমনকি তাঁর কাব্যের সম্পূর্ণ অনুবাদের ইতিহাস রহস্যাবৃত।


কাশীরাম দাসের আত্মপরিচয়:

কাশীরাম দাসের পৈতৃক উপাধী দেব'। নিজ আত্মপরিচয় তিনি স্পষ্টই লিখেছেন—

ইন্দ্রাণী নামেতে দেশ পূর্বাপর স্থিতি।

দ্বাদশ তীর্থেতে যথা বৈসে ভাগীরথী।

কায়স্থ কুলেতে জন্ম বাস সিঙ্গিগ্রাম।

প্রিয়ঙ্কর দাস পুত্র সুধাকর নাম।।

(অর্থাৎ-বর্ধমানের ইন্দ্রাণী পরগণার সিঙ্গিগ্রামে কায়স্থকুলে কাশীরামের জন্ম। পিতার নাম কমলাকান্ত, কবিরা তিনভাই–কৃষ্ণদাস, কাশীরাম, গদাধর। ঠাকুরদা—সুধাকরের পিতা প্রিয়ঙ্কর ইত্যাদি।)


কবিবংশ ছিল বৈব ভাবাপন্ন। তাই বৈবোচিত বিনয়ে ‘দেব’ না লিখে ‘দাস’ লিখেছিলেন। কাশীরাম তাঁর গুরু অভিরাম মুখুটির আশীর্বাদে মহাভারত অনুবাদ করেন। শোনা যায় মেদিনীপুর জেলায় আওখগড়ের (আলিগর) জমিদার বাড়ীতে শিক্ষকতা করার সময় বহু কথক ও পণ্ডিতের মুখে মহাভারত আখ্যান শুনে তাঁর অনুবাদ কর্মের বাসনা জাগে।


কাশীরাম দাসের রচনাকাল:

প্রাপ্ত বিভিন্ন পুঁথি অনুযায়ী কাশীরামের কাব্যের রচনাকাল যথাক্রমে ১৫৯৫ খ্রীষ্টাব্দ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পুঁথি), ১৬০৪ ও ১৬০২ খ্রীষ্টাব্দ (যোগেশ চন্দ্র রায় বিদ্যা নিধি নির্দেশিত), ১৬১৩ খ্রীষ্টাব্দ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পুঁথির দ্বিতীয় পর্ব)। এই তথ্য থেকে অনুমান করা যায় কাশীরাম দাস ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মহাভারত বোধ হয় সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রচিত হয়ে থাকবে।


কাশীরাম দাসের এই মহাভারত রচনার শুরুর ইতিহাস যেমন অজ্ঞাত তেমনি এর সমাপ্তির পরিচয়ও রহস্যাচ্ছন্ন। কোনও কোনও পুঁথিতে পাওয়া যায় এমনি শ্লোক—

আদি সভা বন বিরাটের কত দূর। 

ইহা লিখি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর॥

অথবা মুদ্রিত কাশীদাসী মহাভারতের বন পর্বে পাওয়া যায়।

“ধন্য হল কায়স্থ কুলেতে কাশীদাস। 

তিন পর্ব ভারত যে করিল প্রকাশ।।"

এই সমস্ত উল্লেখ থেকে অনুমিত হয় যে, কাশীরাম আদি, সভা, বন, ও বিরাট পর্বের কিয়দংশ রচনা করে পরলোকগত হন। এছাড়া প্রাপ্ত তথ্যের সূত্রে মনে হয়, কবির ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরাম, পুত্র ঘনশ্যাম ও জামাতা নানা প্রসঙ্গ যোগ করে কাশীরাম দাসের এই অষ্টাদশ পর্বের মহাভারত সম্পূর্ণ করেন।


কাশীরাম দাসের কবিকৃতি:

কাশীরাম দাসের মহাভারত তিন শতাব্দী ধরে সারা বাংলাদেশে প্রচলিত। বর্ণজ্ঞানহীন ব্যক্তি থেকে শুরু করে কৃতবিদ্য পন্ডিত সমাজের সর্বত্রই কাশীরাম কৃত্তিবাসের মতো সমান শ্রদ্ধা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে এসেছেন। অথচ তাঁর নামে প্রচলিত মহাভারতের গোড়ার দিকে চারটি পর্ব ছাড়া অবশিষ্ট বিপুলায়তন রচনা তাঁর নয়। ব্যাস ভারত ও জেমিনি ভারতের কাহিনির প্রভাবে কাশীরামের মহাভারতের কাহিনি পর্যায় বিন্যস্ত হয়েছে। কবি যদিও সর্বত্র আক্ষরিক অনুবাদ করেননি, কোনও কোনও স্থানে মৌলিক গল্প গ্রথিত করেছেন, (শ্রীবৎস চিন্তার কাহিনি) তবুও মূল মহাভারতীয় কাহিনির রস তাতে প্রায় কোথাও খর্ব হয়নি।


কৃত্তিবাসের রচনায় যেমন একটা সরল পাঁচালীর লক্ষণ আছে কাশীরামের রচনা অনুরূপ পাচালী জাতীয় হলেও, তাঁর ভাষা ভঙ্গিমায় ক্লাসিক তৎসম শব্দের আধিক্য গ্রন্থন নৈপুণ্য বিশেষ প্রশংসনীয়। তাঁর সংস্কৃত জ্ঞান সম্পর্কে একসময় পন্ডিতদের মনে সংশয়ের মেঘ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু রচনা রীতির প্রসন্ন আলোকপাতে সে সংশয় কেটে গিয়েছিল, যেমন— ভীষ্ম পর্বে ঘোর সংগ্রামের বর্ণনা

“... দেখি মহাকাশে ভীষ্ম অন্য ধনু লয়।

গগন ছাইয়া বীর বাণ বরিষয়।। 

নাহি দেখি দিবাকরে রজনী প্রকাশ।

শূন্য পথ রুদ্ধ হইল না চলে বাতাস।”

আবার পিতামহের অস্তগমনের সংবাদ উপমার সুপ্রয়োগে পাঠককে বিস্মিত করে

“শিয়র করিয়া পূর্বে পড়িল সে বীর। 

আকাশ হইতে যেন খসিল মিহির।।

এখানে বিরুদ্ধ পক্ষের জয়ের উল্লাস ছাপিয়ে কৌরব শিবিরে সূর্যাস্তের বিষণ্ণ কালো ছায়া কীভাবে নেমে এসেছে, সেই ভাবটি যেন ইঙ্গিতে ব্যক্ত হয়েছে। তাছাড়াও দেখা যায় লক্ষ্যভেদী অর্জুনের বীরোচিত রূপের আলঙ্কারিক বর্ণনা

“মহাবীর্য যেন সূর্য জলদে আবৃত। 

অগ্নি অংশু যেন পাংশু জালে আচ্ছাদিত।

মনে হয় এই জনে বিন্ধিবেক লক্ষ্য।।”


এইভাবে অনুবাদ কর্মে মহাভারতের রস ও ধ্বনিঝংকার কাশীদাস যথাসাধ্য রক্ষা করেছিলেন। তাঁর রচনা অনেকাংশে মূলানুগ ও সংস্কৃত নির্ভর; কিন্তু তা কোথাও দুর্বোধ্য ও নীরস হয়ে ওঠেনি। তাঁর বর্ণনার গতি তরল জলস্রোতের মত অবাধ সরল, ছন্দোময়

“পর্বত নড়িতে কোথা বায়ুর শকতি। 

না পারিল চলিবারে ভীম মহামতি।।"


বলাবাহুল্য এইরূপ রচনা সহজবোধ্য বলেই এ কাব্য সর্বজনধন্য। আবার সেই সঙ্গে ধ্রুপদী কাব্যের ওজঃ কান্তি বজায় রেখে তৎসম শব্দ ও অলঙ্কারের কারুকার্য দেখা যায় এইসব পংক্তিতে- “অনুপম তনুশ্যাম নীলোৎপল শোভা”/“শ্রীবৎস কৌস্তভশোভা শোভিত হৃদয়”/ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস” ইত্যাদি।


পারিবারিক আদর্শের রূপায়ণে কৃত্তিবাসের সঙ্গে কাশীরামের যেমন আছে পার্থক্য তেমন মিলও বিস্তর। কৃত্তিবাসের কাব্যে যেখানে করুণরসের আধিক্য সেখানে কাশীরাম দাসের কাব্যে ও বীর রস দুয়েরই প্রাধান্য। সভাপর্বে দ্রৌপদী ও হিড়িম্বার যে কলহ বর্ণিত হয়েছে, তা বাঙালি সমাজের দুই সতীনের কলহ স্মরণ করিয়ে দেয়। সভাস্থলে দ্রৌপদীর সঙ্গে হিড়িম্বা আসন গ্রহণ করলে দ্রৌপদী সপত্নী সুলভ ঈর্ষা বশে কটুভাষায় হিড়িম্বাকে গালি দিয়েছে

“কি আহার কি বিচার কোথায় শয়ন।

কোথায় থাকিস তোর না জানি কারণ।”

উত্তরে হিড়িম্বাও চুপ করে থাকেনি

“অকারণে পাঞ্চালি করিস অহংকার।

পর নিন্দা নাহি দেখ ছিদ্র আপনার।।”

অতঃপর হিড়িম্বা পুত্র ঘটোৎকচের বিশেষ প্রশংসা করলে ক্রুদ্ধা পাঞ্চালী বলে

“পুত্রের করহ গর্ব খাও পুত্রমাথা।”

এই দ্বন্দ্ব যখন তুঙ্গে তখন

“আপনি উঠিয়া কুন্তী দোঁহে সান্ত্বনাইল।”


গঙ্গার পবিত্র বারিধারার মতো মহাভারতের রসধারা বাঙালি জীবনে কাশীরাম প্রবাহিত করেছিলেন তাইতো মাইকেল মদুসূদন দত্ত তাঁর— ‘কাশীরাম দাস’ কবিতায় লিখেছিলেন

“সেইরুপে ভাষাপথ খননি স্ববলে,

ভারত রসের স্রোত আনিয়াছ তুমি 

জুড়াতে গৌড়ের তৃষা সে বিমল জ্বলে।

নারিবে শোধিতে ধার কভু গৌড়ভূমি।।”


পরিশেষে বলা যায়, কাশীরাম দাস চৈতন্য পরবর্তী যুগে আবির্ভূত হয়ে ব্যাস বা জেমিনিকে সম্মুখে রেখে সংক্ষেপে মহাভারতের যে চার পর্বের ভাবানুবাদ করেছিলেন, তা বাঙালির মনোজীবনকে গঠন করতে বিশেষ সাহায্য করেছে। একথা সত্য যে, মধ্যযুগে মহাতারত রচনাকার হিসাবে সঞ্জয়, কবীন্দ্র পরমেশ্বরাদির অধিক জনপ্রিয়তা ছিল, কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বিশেষত ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতেও কাশীরাম দাসের মহাভারত সারা বংলাদেশেই বিপুল বিস্তার লাভ করলে সঞ্জয় প্রভৃতি পূর্ববর্তী মহাভারতকারদের গ্রন্থ বিবর্ণ পুঁথিপত্রের মধ্যে বন্দি হয়ে রইল। স্বচ্ছন্দ সরল পয়ার ত্রিপদীতে বৈষ্ণবীয় ভক্তি রসের পটভূমিকায় সংস্কৃত মহাভারতকে বাংলা ভাষায় প্রচার করে কাশীরাম কৃত্তিবাসের মতোই অমরত্ব লাভ করেছেন।