চর্যাপদের ভাষা | চর্যায় ধর্মমত

চর্যাপদের ভাষা


চর্যাপদের গানগুলি যখন আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর হাতে আসে তিনি তার ভাষা দেখে নিশ্চিত ছিলেন যে, চর্যাপদের ভাষা বাংলা ছাড়া অন্য কিছু নয়। সেই জন্যই চর্যাপদের‌ পরিচয় প্রসঙ্গে তিনি বিনা দ্বিধায় বলেছেন, চর্যাপদের কবিতাগুলি 'হাজার বছরের পুরাণ‌বাঙ্গলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা' ও 'বৌদ্ধ সহজিয়া মতের অতি পুরান গান। তিনি এগুলিকে বাংলা গান বলার সময় ভাষাতত্ত্বের বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে বিচার করেন নি। কারণ প্রচলিত অর্থে তিনি ভাষা বিজ্ঞানী ছিলেন না। তবে তিনি কি কারণে চর্যাগীতির ভাষাকে বাংলা বলেছিলেন তা আলোচনা সাপেক্ষ। তিনি সুস্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছেন, যে সমস্ত বাগ্‌ভঙ্গী এবং প্রকাশভঙ্গী বাংলা ভাষার নিজস্ব বিশেষত্ব—সেই সমস্ত শব্দের বাগভঙ্গী এবং প্রকাশ পদ্ধতি চর্যাপদে উজ্জ্বল ভাবে উপস্থিত।


ভাষা বিজ্ঞান অনুসরণ করে কেবল চর্যাগানের ভাষাকেই প্রাচীনতম বাংলা ভাষার নমুনা বলে গ্রহণ করা যায়, তবে দোহা ও ডাকার্নব তন্ত্রের ভাষা যে শৌরসেনী অপভ্রংশের অন্তর্ভুক্ত তাতে সন্দেহের অবকাশ স্বল্প। খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দীর দিকে যখন বাংলা ভাষা মাগধী অপভ্রংশের খোলস ত্যাগ করে স্বাতন্ত্র্যে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে সৌরসেনী প্রাকৃত অপভ্রংশই ছিল শিষ্ট ভাষা। পূর্ব ভারতের নানা অঞ্চলে অবশ্য মাগধী অপভ্রংশ থেকে জাত বাংলা, মৈথিলি, অসমীয়া, উড়িয়া প্রভৃতি স্থানীয় ভাষাগুলি প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিল। এই সময় গৌড়বঙ্গের লেখকগণ নবসৃষ্ট বাংলা ভাষা ও অপভ্রংশে একই সঙ্গে রচনা কর্ম নির্বাহ করেছিলেন। তাই সরহ, কাহ্ন, তিল্লো,— যাঁরা বাংলায় পদ রচনা করেছিলেন, তাঁরা আবার শৌরসেনী অপভ্রংশের দোহা রচনা করেছিলেন। কিন্তু চর্যার ভাষা যে সৃজ্যমান বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন তা অস্বীকার করার উপায় নেই।


চর্যাপদের ব্যাকরণে বাংলা ভাষার পুরো প্রভাব লক্ষণীয়। কারণ চর্যাগীতির মধ্যে ব্যবহৃত ভাষার শব্দ রূপের গঠনে একবচন ও বহুবচনের তফাৎ নেই। আবার সম্বন্ধ বোঝানো ছাড়া স্ত্রীলিংঙ্গ ও পুংলিঙ্গেরও তফাৎ নেই।


শৌরসেনী সেকালে পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে একমাত্র শিষ্টভাষা বলে স্বীকৃত হয়েছিলো। বাংলা দেশেও শৌরসেনী অপভ্রংশের বেশ আধিপত্য ছিল। অনুমিত হয়, চর্যার রচনাকারেরা পশ্চিমা অপভ্রংশ রচনা করতে বেশি অভ্যস্থ ছিলেন, তাই এই বাংলা পদেও কিছু কিছু পশ্চিমা অপভ্রংশে অনুপ্রবেশ করেছে। কিন্তু তাই বলে বিভিন্ন পণ্ডিত চর্যার ভাষাকে যেভাবে হিন্দির অন্তর্গত করতে চান, তাও যুক্তি সঙ্গত নয়, এতে কয়েকটি ওড়িয়া ও মৈথিলি শব্দ আছে, কারণ কোনো কোনো চর্যাকার উড্ডীয় অর্থাৎ ওড়িষা এবং মগধে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সুতরাং দু চারটি ওড়িয়া বা মৈথিলী শব্দ থাকা অস্বাভাবিক নয়, সংকলনটি নেপালে পাওয়া গেছে। উত্তর বিহার ও নেপালের ভৌগোলিক অবস্থানের মধ্যে নৈকট্য লক্ষ্য করা যাবে, তাই এতে দু একটি মৈথিলী পদও স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু পদান্বয়, শব্দযোজনা ও ধ্বনিতত্ত্ব বিচারে চর্যার ভাষাকে বাংলা ভাষার আদিরূপ বলে গ্রহণ করতে হবে।


এখন প্রশ্ন হল—চর্যার ভাষা কোনও অঞ্চলের রাঢ় অথবা বঙ্গাল? এতে যেহেতু নাসিক্য ধ্বনির বাহুল্য আছে সেই হেতু এ ভাষাকে ‘বঙ্গালবাদী' বলা চলে না, এছাড়াও এতে অনেক ভাষা বৈশিষ্ট্য আছে যা এভাষাকে রাঢ় ভাষার মধ্যেই স্থান দেবে। চর্যার আচার্যেরা কামরূপ, ‘সোমপুরী' বিক্রমপুর-যেখান থেকেই আসুন না কেন, আশ্চর্যের বিষয় এরা সকলেই রাঢ় অঞ্চলের ভাষারীতি গ্রহণ করেছিলেন। এই বৈশিষ্ট্য দীর্ঘ সহস্র বৎসরের মধ্য দিয়ে একই গতিতে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। চর্যাগানের পরবর্তী যুগেও পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার প্রভাব সত্ত্বেও মধ্যযুগ এবং আধুনিক কালের বাংলা পদ্যগদ্য রীতি রাঢ়ভাষা রীতিকেই বরমাল্য দিয়েছে। পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব বাংলা ভাষায় প্রাচীন মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের বিশেষ কিছুই লেখা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের ভাষাই সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ভাষায় পরিণত হয়েছে এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।


সর্বোপরি, চর্যার ভাষাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে—'সন্ধ্যাভাষা' হিসাবে আখ্যাত করেছেন সে সম্পর্কে কিছু বলা আবশ্যক। হরপ্রসাদবাবু সন্ধ্যাভাষার অর্থ করেছেনঃ—“আলো আঁধার ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না, যাঁহারা সাধন ভজন করেন, তাহাঁরাই সে কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই।” 'আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই'—এই বাক্যের তাৎপর্য বোধ হয় এই সহযিয়া সাধনার দেহাশ্রিত অংশ স্ত্রী সাহচর্যে সম্পন্ন হয়। সুতরাং ওই দলের মধ্যে যাঁরা নেই তাঁদের এ তত্ত্ব বুঝবার আবশ্যকতাই বা কী? ‘কতক বুঝা যায়, কতক বুঝা যায় না'—এই বাক্যের মধ্যে অদীক্ষিতের কথা বলা হয়েছে। দীক্ষিত ও তত্ত্বজ্ঞের কাছে এ ভাষা আলো আঁধার ভাষা নয়। সর্বশেষে, মহামোহপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রীর অভিমত উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেনঃ “সম-ধা ধাতু থেকে সন্দা পদ নিষ্পন্ন হয়েছে, এর অর্থ— অভিপ্রেত, উচ্ছিষ্ট, আভিপ্রায়িক বচন।" তাঁর মতে— 'সন্ধ্যা' লিপির প্রমাদ মাত্র।


চর্যায় ধর্মমত

চর্যাপদে একদিকে যেমন আচার সর্বস্ব বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মাচরণের প্রতি বিদ্রুপ এবং অবিশ্বাস প্রকাশিত, অন্যদিকে তেমনি আবার তান্ত্রিক দেহবাদের প্রতিও প্রচ্ছন্ন এবং প্রকাশ্য আস্থা জ্ঞাপনের কোনও বাধা ছিল না। বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন যানের প্রতি কোনও না কোনও ভাবে সমর্থন জানানো হয়েছে। তবে চর্যাপদ কোনোভাবেই আচার সর্বস্ব হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে পুরোপুরি স্বীকার করেনি। সিদ্ধাচার্যরা সকলেই মোটামুটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্ম প্রদর্শিত আচার আচারণ, পথ ও সাধনাকেই জীবনচর্যা হিসাবেই গ্রহণ করতেন এবং সেই অনুযায়ী জীবনকেই পরিচালিত করতেন–তফাৎ শুধু ‘যান' নিয়ে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে হিন্দুতান্ত্রিক দেহবাদের যে পরিচয় আছে সেটা এসেছে প্রধানত সামাজিক কারণে, হিন্দু বৌদ্ধ আদর্শের পারস্পরিক সমন্বয়ের ফলে। নতুন করে হিন্দুতান্ত্রিক দেহবাদের প্রতি সমর্থন সিদ্ধাচার্যরা জানাননি—চর্যাপদ রচনার অনেক পূর্বেই সে সমন্বয় হয়েছে এবং সেই সমন্বয়ের ফলে বৌদ্ধতান্ত্রিক ধর্মের মধ্যে একটা দেহবাদী আলাদা 'যান'ই সৃষ্টি হয়েছে।


যানগুলির মূল বক্তব্য :

রাজা কণিষ্কের সময়ে অর্থাৎ প্রথম শতকে বৌদ্ধ সঙ্গীতির চতুর্থ ও শেষ সম্মেলন হয়। এই অধিবেশনে মত পার্থক্য এমন প্রবলাকার ধারণ করে যে ভগবান তথাগতের ধর্ম বরাবরের জন্য দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল— হীনযান ও মহাযান। হীনযান প্রধানত বাহ্য বস্তুর বাস্তব সত্তায় বিশ্বাসী। আত্মনির্বাণই এই মতাবলম্বীদের একমাত্র উদ্দেশ্য। সংসারের মধ্য দিয়ে নির্বাণ লাভই এর প্রধান লক্ষ্য। হীনযানীরা মনে করতেন সুকঠোর বিষয়ের অনুসরণ করে নির্বান লাভ করতে হবে। নির্বাণ এর মূল তাৎপর্য চৈতন্যের মূলোচ্ছেদ। নির্বাণের পর চিত্ত স্বরূপের কী অবস্থা হয় তার কোনও ইঙ্গিত হীনযান শাস্ত্রে পাওয়া যায় না।


জাতকমতে বুদ্ধদেব জীব কল্যাণের জন্য বহু জন্ম জন্মান্তর পরিগ্রহ করেছিলেন। তাঁর এই অবস্থাগুলিকে বোধিসত্ত্ব বলা হয়। মহাযান পথীরা এই কল্যাণব্রতী বোধিসত্ত্বের প্রতি লক্ষ্য নিবন্ধ করলেন। এই মতের প্রথম আচার্যেরা মনে করতেন, কতকগুলি বিশেষ ‘পারমিতা’র (করুণা মৈত্রী প্রভৃতি) সাহায্যে এই বোধিসত্ত্ব অবস্থা লাভ করা যায়। এঁদের কাছে জগৎ শূন্যস্বভাব, তাই এরা শূন্যবাদী নামে পরিচিত।


উক্ত দুটি শাখায় বৌদ্ধধর্মের বিবর্তন স্তব্ধ হয়নি। খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর দিকে ভগবান তথাগতের ধর্ম অতি দ্রুতবেগে তন্ত্রমন্ত্রের কবলে পড়ল এবং আর একটি বৌদ্ধ উপশাখার আবির্ভাব হল—মন্ত্রযান—অর্থাৎ কালচক্রযান, বজ্রযান, সহজযান। কালচক্রানের 'কা অর্থে কারণ, ‘ল’ অর্থে-লয়। 'চ' অর্থে চঞ্চল 'চিত্ত' ব্রু অর্থে ক্রমবর্দ্ধন বা সন্ততি অর্থাৎ কালচক্রযানের সমবাদী অর্থ হল—প্রজ্ঞা ও উপায়ের সংশ্লেষ জনিত শূন্যতাবোধ। বজ্রযানের ‘বজ্র’ শব্দের বৌদ্ধ তান্ত্রিক অর্থ –শূন্যতা, এবং সহজ যানের পরম লক্ষ্য অদ্বয় মহাসুখ উপলব্ধি। এই মতে নির্বাণের অর্থ মহাসুখ।


সহজযানের সুখতত্ত্বের চারটি স্তর (ক) প্রথমামন্দ, (খ) পরমানন্দ, (গ) বিরমানন্দ (ঘ) সহজানন্দ। চিত্তের তুরীয় অবস্থা অর্থাৎ সহজানন্দই মহাসুখ, এই মহাসুখ লাভের জন্যই ব্রহ্মণ্য তন্ত্র পরিকল্পিত বিশেষ বিশেষ শারীরিক চর্যা বা সাধন প্রক্রিয়া আছে। বৌদ্ধ সহজিয়াদের রচিত কোনও সংস্কৃত রচনা পাওয়া যায়নি। যে তিব্বতী অনুবাদ পাওয়া গেছে তাতে তাদের পরিচয় পাওয়া যায়। তিব্বতে যারা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত, তাঁরাই বিশেষভাবে সহজ যানের প্রচারক।


খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দীর মধ্যে এই সহজযান মগধ, ওড়িষা বাংলায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এক ধরনের দৈহিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে এই মতের সংযোগ ছিল বলে ব্রাহ্মণ্য তন্ত্র, নাথ পথ, এবং আরও অনেক লৌকিক আচার আচারণ এই মতে আশ্রয় পেয়েছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় আবিষ্কৃত 'চর্যাচর্য বিনিশ্চয়' প্রধানত সহজিয়া মতের উপর প্রতিষ্ঠিত। অবশ্য কিছু কিছু সিদ্ধাচার্য ব্রজ্যানেও আসক্ত ছিলেন। ইসলাম অভিযানের ফলে হিন্দুসমাজ পরাজয়ের বেদনা ভুলবার জন্য পৌরাণিক শাস্ত্রচর্যার অন্তরালে আশ্রয় নিয়েছিল। ফলে এই সমস্ত রহস্যাচারী মন্ত্রযান সমাজের মানুষেরা অস্ত্যবাসীদের মধ্যে শেষ আশ্রয় নিয়েছিল। উপরন্তু শাস্ত্রবাদী ব্রাহ্মণ্য সমাজ বেদ বিরোধী নাস্তিক বৌদ্ধমতের ঘোরতর শত্রু ছিলেন, তাই এই মতবলম্বীদের নিম্নশ্রেণির মধ্যে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল। সে রণে চর্যাগান ও প্রাকৃত অপভ্রংশ দোহায় নিম্নবর্ণের এত উল্লেখ দেখা যায়।


অবশ্য আক্ষরিক অর্থের চেয়ে চর্যার রূপকথাই বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই দেহ চর্যার অনুশীলন বৈষ্ণব সহজিয়া, নাথপন্থ, আউল বাউল, সাঁই দরবেশের প্রভৃতি লোকধর্ম ও আচার আচারণকে, কখনো প্রত্যক্ষভাবে কখনো পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তন্ত্রে পঞ্চ'ম' কারের অন্তর্ভুক্ত মিথুন তত্ত্বের নিশ্চয় গূঢ় তাৎপর্য ছিল, কিন্তু সহজিয়া মতে এর স্থূল বহিঃপ্রকাশ অস্বীকার করা যায় না। তন্ত্রসাধন প্রক্রিয়ায় স্ত্রীলোকের বিশেষ ভূমিকা ছিল, যার আধ্যাত্মিক অর্থ যাই হোক না কেন, তাতে সহজেই কামের পিচ্ছিল বিকার প্রবেশ করেছিল। কিন্তু বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈক্ষ্ণব সহজিয়া ও বাউল সম্প্রদায়ের কৃত্যে ও অনুশীলনে 'কায়াসাধনার বিশেষ ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশে প্রধানত পালযুগেই বজ্রযান সহজযান প্রভৃতি নানা যান উপমান জনচিত্তে প্রভৃত প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং একদা সংস্কৃত প্রাকৃত অপভ্রংশে এই মতবাদ অবলম্বন করে বহু সাহিত্য সৃষ্টি হয়। আদিযুগের বাংলা ভাষায় এই মতের বহু শ্লোক ও পদ স্থান পেয়েছে। বাংলা পরবর্তী কালের বৌদ্ধধর্মের ইতিবৃত্ত অনেকটা এই মতের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত।


চর্যাপদে এই ধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ অব্যাহত। কারণ সাধকরা ধর্মের উপর জোর দিয়েছিলেন বেশি। এছাড়া, সিদ্ধাচার্যদের অধিকাংশ ছিলেন বাঙালি। বাঙালি চরিত্রের প্রধান বিশেষত্ব সংস্কার মুক্ত হওয়া, গোঁড়ামী বর্জন করা। এই দ্বিবিধ গুণের জন্যেই প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে চর্যাপদের মানবতাবোধ জাত সমন্বয়ের দিকে ফলেছে পদক্ষেপ। যে গুণের জন্যে উপনিষদ ধর্মব্যাখ্যা হয়েও দর্শন ও কাব্যের সামগ্রী, চর্যাপদের সঙ্গে উপনিষদের গুণগত বিরাট পার্থক্য থাকলেও—চর্যাপদও সেই একই গুণের জন্য ধর্মগ্রন্থ হয়েও কাব্যগীতি। এই ধর্ম ও কাব্যের দুর্লভ সমন্বয় বাংলা সাহিত্যে প্রথম হয়েছে চর্যাপদে। সেই জন্যেই বাংলা কাব্যের উষালগ্নে চর্যাপদের এত গুরুত্ব।