বাংলা সাহিত্যে গোপাল হালদারের অবদান | বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে গোপাল হালদারের কৃতিত্ব ও ভূমিকা

বাংলা সাহিত্যে গোপাল হালদারের অবদান কৃতিত্ব


বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের আধুনিক যুগপ্রেক্ষাপটে যে কয়েকজন শিল্পী তাঁদের স্বকীয়তার সম্মুজ্জ্বলতা সহযোগে সমুপস্থিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট হলেন গোগাল হালদার। সাহিত্যসমালোচনার জগতে মার্কসীয় বিচার বিশ্লেষণ পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম। মার্কসের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক মতবাদের স্বীকৃতি দিয়ে বাংলা সমালোচনাতত্ত্ব গোপাল হালদার, বিনয় ঘোষ প্রমুখ শিল্পী নূতন চিন্তাচেতনার নবগিন্ত উদ্ঘাটন করলেন।


বাংলা সমালোচনার ইতিহাস সমীক্ষা প্রসঙ্গে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় প্রমুখের অবদান অবিস্মরণীয়। গোপাল হালদার এবং মার্কসীয় বিচার পদ্ধতিতে বাংলা সাহিত্য সমালোচনা প্রসঙ্গে অরুণকুর মুখোপাধ্যায় লিখেছেন– “সাহিত্য সমালোচনার নানা রীতির অন্যতম মার্কসীয় বিচারপদ্ধতি। এই পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয় রুশদেশে অক্টোবর বিপ্লবের পরে। মার্কসবাদ মূলতঃ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মতবাদ। এই মতবাদ সামাজিক স্তর বিন্যাস, রাষ্ট্রের উত্থানপতন, শোষক শোষিতে সংঘর্ষ ও শোষিতের শেষ বিজয়ে আস্থাবান। মার্কসবাদীরা কেবল সমাজ নয়, শিল্পকর্ম, সাহিত্যধর্ম—সবকিছুই এই কষ্টিপাথরে বিচার করতে চান। এই মতবাদের অন্যতম সিদ্ধান্ত Dialectical materialism দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ মার্কসপন্থীদের প্রধান আশ্রয়।... পরিচয় পত্রিকার আমলে অর্থাৎ ১৯৩০-এর পরে বাংলাদেশের চিন্তাজগতে মার্কসবাদের আলোচনা দেখা দিল। 'পরিচয়-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এ মতের অংশীদার হন নি, যদিও পরিচয়গোষ্ঠীর অনেকেই এই মতবাদ গ্রহণ করেছেন। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে অদ্যাবধি মার্কসীয় সাহিত্য সমালোচনা কোন বিশিষ্ট রূপ লাভ করে নি, অথচ শ্রী নীরেন্দ্রনাথ রায়, শ্রী গোপাল হালদার, শ্রী বিষ্ণু দে, শ্রী সরোজ আচার্য, শ্রী হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও শ্রী সুশোভন সরকারের মতো বুদ্ধিমান তীক্ষ্ণধী সমালোচকরা গোড়া থেকেই এই মতবাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন।'


বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাহিত্য সমালোচনার জগতে হাজির হয়ে গোপাল হালদার মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক জড়বাদকে বিশেষভাবে সর্বজনসমক্ষে তুলে ধরলেন। বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাপর্বে গোপাল হালদার, অরবিন্দ পোদ্দার প্রমুখ শিল্পীদের সম্পর্কে সমালোচক বলেছেন—“বাংলা সমালোচনায় অপর যে মতবাদ এ কালে দেখা দিয়েছে, তা হল বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী। কালমার্ক্স-প্রবর্তিত সাম্যবাদের আলোকে সাহিত্যকর্মের বিচার এখানে লক্ষ্য করা যায়। গোপাল হালদার, নীরেন্দ্রনাথ রায়, অরবিন্দ পোদ্দার, সীতাংশু মৈত্র প্রমুখ সমালোচকেরা এই পথের পথী। ... তারা বলেন যে, সাহিত্যে বাস্তবের বিজ্ঞানসম্মত চিত্র রচনাই তাঁদের অন্বিষ্ট। শিল্পিমানসের বিচার তাঁদের কাছে লেখকের ব্যক্তিসত্তার নয়, বস্তুসত্তার বিচার, কারণ শিল্পিমানস বস্তুবোধের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়।”


আধুনিক সাহিত্য সমালোচনার জগতে গোপাল হালদার তার নিজস্ব কীর্তি-খ্যাতির অনন্যতার উজ্জ্বল সাক্ষ্য তুলে ধরেছেন। বহু বিচিত্র ধারার শিল্প প্রতিভার প্রকাশ তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য সম্পনে দেখা গেওে মূলত আধুনিককালের একজন বিশিষ্ট সমালোচক হিসাবেই তিনি তাঁর খ্যাতির অনন্যতাকে আদায় করে নিয়েছেন। আধুনিক সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্বে গোপাল হালদার বাস্তবিক পক্ষে অসাধারণ প্রতিভাবান অতুলনীয় এক সার্থক শিল্পী।


সময়কাল ১৯০২ সাল আবির্ভূত হলেন বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী গোপাল হালদার। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সক্রিয় থেকে তাঁর লেখনি থেমে যায়। এই সময়কালের মধ্যে বিচিত্র ফসলে বঙ্গসাহিত্য সরস্বতীর ডালি ভরেছেন তিনি। তার সৃষ্টি সমীক্ষার মাধ্যমে শিল্পসত্তার বিবিধ দিককে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না।


বিবেকানন্দ-বঙ্কিমমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তিনি সাহিত্যসাধনার ক্ষেত্রে মানববাদী চিন্তাচেতনাকে বলিষ্ঠরূপে তুলে ধরলেন। প্রবন্ধসম্ভার ছাড়াও তিনি উপন্যাস আত্মজীবনীমূলক সৃষ্টির দ্বারা সাহিত্য সরস্বতীর অঙ্গন ভরেছেন। সমালোচক ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর মূল্যায়নে—সৃষ্টি সম্পদের স্মরণে বলেছেন—“আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাবন্ধিক গোপাল হালদার (১৯০২–১৯৯৬) বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। বিবেকানন্দের ‘অভীঃ’ মন্ত্রে আর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্রে কৈশোরেই দীক্ষিত গোপাল হালদার রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশ সমাজের’ চিন্তায় মুক্তির পথ অন্বেষণে রত থাকলেও শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে, আত্মজিজ্ঞাসায় অস্থির গোপাল হালদার সর্বকালের সর্বমানবের মুক্তির জন্য মার্কসীয় দর্শনকেই সত্য বলে মনে করেছেন। প্রথম জীবনে ভারতীয় ভাষাতত্ত্বের গবেষণায় রত থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি বিচিত্র পথে চরণচারণা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতির রূপান্তর, বাজে লেখা, এ যুগের যুদ্ধ, বাঙালী সংস্কৃতির রূপ, বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা, ইংরেজী সাহিত্যের রূপরেখা বাংলা সাহিত্য ও মানবস্বীকৃতি, সতীনাথ ভাদুড়ী সাহিত্য ও সাধনা, বাঙালীর আশা, বাঙালীর ভাষা ইত্যাদি। এছাড়া তিনি উপন্যাস ও আত্মজীবনীমূলক, আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থের রচয়িতারূপেও খ্যাতিমান হয়ে আছেন।”


‘বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা’ তাঁর অসাধারণ এক গ্রন্থ। এ গ্রন্থের ভূমিকাতে তিনি সমালোচনার মূল সত্যকে তুলে ধরেছেন। ‘বাঙলা সাহিত্য ও মানবস্বীকৃতি' গ্রন্থে প্রাবন্ধিক আধুনিক সাহিত্যের স্বরূপ সমীক্ষা করে সাহিত্য, স্বাধীনতা ও মানবতার উপর বিশেষভাবে আলোকপাত করেছেন। লেখক, সাহিত্যিক, সমালোচক, সাংবাদিক, ভাষাতত্ত্ববিদ এমন কি সক্রিয় একজন রাজনীতি সচেতন কর্মী হিসাবেও তাঁর পরিচিতির ছাড়পত্র মেলে। সার্বিক সমীক্ষায় তাই তাঁর সম্পর্কে সমালোচকের স্মরণীয় মন্তব্য— “আধুনিক সাহিত্যের মূল প্রকৃতি কী এবং বাংলা সাহিত্যে তার প্রকাশই বা কীভাবে হয়েছে—ইত্যাদি গোপাল হালদারের আলোচিত বিষয়। তিনি শিল্পসংস্কৃতি, ভারতীয় ও বাঙালী সংস্কৃতির রূপ সম্পর্কে বহু আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধাবলী হলো—সংস্কৃতির গোড়ার কথা, ইতিহাসের ভূমিকা, বিজ্ঞানের জগৎ, বাঙালী সংস্কৃতির রূপরেখা, বাঙালী মুসলমান ও মুসলিম কালচার, বাঙালী সংস্কৃতির সংকট, বাঙলার ভাষা সমস্যা, বাঙলার বাস্তব রূপ ইত্যাদি। সংস্কৃতি জিজ্ঞাসার জন্যই গোপাল হালদার স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। গোপাল হালদার লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীরূপে সুপরিচিত। ... সংস্কৃতি-সাহিত্য ইত্যাদি বিচারে গোঁড়ামির প্রশ্রয় না দিয়ে তিনি মুক্তমনা আধুনিক মননের পরিচয় দান করেছেন।” বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে সমালোচক গোপাল হালদার, বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর বিশেষত্বের দিককে স্পষ্ট স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। বাঙলার আর্থ-সামাজিক চালচিত্রের রূপায়ণে তিনি অদ্বিতীয় শিল্পীর সম্মানে বিভূষিত।


জীবনবাদী সমালোচক গোপাল হালদার। সমালোচনার যে রীতিকে তিনি গ্রহণ করেন তার মাধ্যমে তার জীবনবাদী মানসিকতার দিকটিই স্পষ্ট হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বস্তুবাদী চেতনার আলোকে প্রাবন্ধিক গোপাল হালদার তার প্রবন্ধের জগৎকে সমৃদ্ধির শীর্ষালোকে উন্নীত করেন। সমালোচকের কথা দিয়ে সমালোচক গোপাল হালদারের সমীক্ষায় বলা যায়—“গোপাল হালদারের সমালোচনার রীতিতে ‘জীবনবাদী’ মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে বলেই মনে হয়। Art for Life Sake—এই শাস্ত্রই তাঁর সমালোচনার শাস্ত্র বলেই গ্রহণ করতে হয়। .…....... জীবনবাদী সমালোচকমাত্রই জীবনের রুক্ষ-কোমল, নীতি-দুর্নীতি, ভাল-মন্দ, প্রেম-কাম, ত্যাগ স্বার্থ নিয়ে জীবনের সুরসংগতি তাকেই অন্বেষণ করেন। গোপাল হালদারের সমালোচনা বীতিটিকে জীবনবাদী সমালোচনা বলে ধরে নেওয়া যায়।”


বাংলা সাহিত্যে গোপাল হালদার সৃষ্টিশীল প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক এবং খ্যাতিমান সমালোচকরূপে স্বীকৃতির ছাড়পত্র আদায় করে নিয়েছেন। সাহিত্য সংস্কৃতি বিচারের ক্ষেত্রে তাঁর মতো বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি বাস্তবিকপক্ষে বিরলদৃষ্ট। তথ্য সমৃদ্ধির দ্বারা তিনি প্রবন্ধগুলিকে যুক্তিপরম্পরা করে পরিবেশন করেন সুন্দররূপে। বাঙালী সাহিত্য সাধনা, ধর্মসাধনা, জ্ঞানসাধনা, সংগীত-চিত্রকলা, বিজ্ঞানভাবনা, ইতিহাস চর্চায়—এককথায় সব দিক দিয়ে যে এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে—সেকথা গোপাল হালদার পাঠকসমাজকে স্পষ্টরূপে অবগত করিয়েছেন। সংক্ষিপ্ত বাক্যবন্ধে বলিষ্ঠ বক্তব্যে তিনি তাঁর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। প্রবন্ধগুলির মধ্যে তিনি পর্যাপ্ত তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে বহুক্ষেত্রে তার সৃষ্টিকে তথ্য ভারাক্রান্ত করে তুললেও তার সমালোচনা গ্রন্থের সৃষ্টিসম্পদে উপভোগ্য রমণীয়তা ও স্বাদুতার দিক উপলব্ধিতে কোন অন্তরায় সৃষ্টি হয় নি। সৃষ্টির মধ্যে তিনি মৌলিকতার প্রোজ্জ্বল দীপশিখাকে সমুজ্জ্বল রেখেছেন। তার সৃষ্টিসমীক্ষা সম্পর্কিত দিকের পর্যালোচনায় সমালোচকের ভাবনা—“গোপাল হালদার বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যে সৃষ্টিশীল প্রাবন্ধিক ও সমালোচকরূপে খ্যাতিমান হয়ে আছেন। ....... তার সাহিত্য সংক্রান্ত আলোচনাগুলি সমালোচনামূলক প্রবন্ধহলেও মৌলিকতার সিদ্ধিতে দীপ্যমান। – জাতীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে আস্থাশীল ও প্রত্যাশা সম্পন্ন গোপাল হালদার সাধারণ শিক্ষার ব্যাপক ও সর্বজনীন ব্যাপ্তি, সাহিত্যের সর্বাঙ্গীন বিকাশকেই বাঙালী সংস্কৃতি বলে মনে করেন। তাঁর প্রত্যয়বান চিত্তবৃত্তির প্রকাশ প্রবন্ধসাহিত্যে তাঁকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। গোপাল হালদারের বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক বোধ, পরিচ্ছন্ন মনন, গোঁড়ামিহীন দৃষ্টিভঙ্গি, বৈজ্ঞানিক চেতনা ও শোষণবিরোধী সমাজতান্ত্রিক আদর্শনিষ্ঠার উজ্জ্বল পরিচয় বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে তাঁকে গৌরবময় আসন দান করেছে।”


সমালোচক গোপাল হালদার সংস্কৃতি সচেতন সৃজনশীল বিদগ্ধমননশীল বিশিষ্ট শিল্পীরূপে সম্মানিত। মানবসত্তার মহত্ত্ব অন্বেষণে তিনি আজবীন ব্রতী। তার শিল্প সাধনার মূলে জীবন সত্যের এবং মানব সত্যের অন্বেষণ প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে নিরন্তর। সমালোচক গোপাল হালদারের সৃষ্টি সমীক্ষার আলোকে তার যথাযথ মূল্যায়ন প্রসঙ্গে সমালোচকের কথা দিয়েই বলা যেতে পারে– “তার [গোপাল হালদারের] প্রবন্ধাবলীতে জীবনের যে বিশেষ দৃষ্টি প্রতিফলিত হয় তা হোল মানবসত্তার আত্মান্বেষণ। তাঁর জীবনদৃষ্টিই সৃষ্টিমূলক ও সমালোচনামূলক প্রবন্ধে প্রকাশিত। তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্য হলো তার কালের তাঁর দেশের বিশেষ মানব আধারে সকল দেশের জীবনসত্যের ও মানবসত্যের স্বরূপ সন্ধান। বাঙালীর ভাষা-সংস্কৃতির বস্তুবাদী বিশ্লেষক পণ্ডিতরূপেই গোপাল হালদার খ্যাতিমান। রবীন্দ্রনাথের ন্যায় মানুষের প্রতি বিশ্বাসে অবিচলিত থাকার সাধনা গোপাল হালদারের জীবনের মূলমন্ত্র।”