বাংলা ছোটগল্পে সোমেন চন্দ্রের অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা ছোটগল্পে সোমেন চন্দ্রের প্রতিভা ও ভূমিকা

বাংলা ছোটগল্পে সোমেন চন্দ্রের অবদান ও স্থান


সোমেন চন্দ্র বাংলা ছোটোগল্পের ক্ষেত্রে একটি বিস্ময়কর নাম। সেই সঙ্গে অবশ্য-উচ্চার্য নামও। কিন্তু অবাক ব্যাপার—বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাস-রচয়িতারা গল্পোলোচনায় বসে, তার নাম—কেন জানি না, অধিকাংশই বেমালুম ভুলে গেছেন, উচ্চারণ করেননি। এটা, আমার মনে হয়, এক ধরনের পাপ। বর্তমানে যদিও, বিদ্বজ্জনেরা কেউ কেউ, সেমেন চন্দ্রের গল্পালোচনায় ব্রতী হয়ে সে-পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে শুরু করেছেন। এটা সাধু প্রয়াস। আজ—ক্ষণজীবী এই প্রতিভার মূল্যায়ন-পুনর্মূল্যায়ন চলছে। বাংলা ছোটোগল্পের ক্ষেত্রে এটি স্বাস্থ্যকর দিক৷ তাৎপর্যপূর্ণ দিকও।


সোমেন চন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প শিশু তপন' সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৭-এ। তাঁর বয়স তখন সতেরো


প্রথম গল্প ‘শিশু তপন' প্রকৃতপক্ষেই কিশোরের রচনা। যদিও সে কিশোর প্রতিভাবান—তবু তার দৃষ্টিভঙ্গী, সৌন্দর্যবোধ, পারিবারি সংস্কার এবং ট্রাজেডি-ধারণা—যা আসলে ট্রাজিক নয়, করুণ মাত্র—সবই লেখকের কৈশোরের প্রতি ইঙ্গিত করে।


দ্বিতীয় গল্পটি—'ভালো না লাগার শেষ'। এক শিক্ষিত আধুনিক দম্পতির প্রেমমধুর এক আখ্যান স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কর্মরত। স্ত্রীর উপর স্বামী কখনই জোর করবে না—এই শর্তে বিবাহ। বিরহিণী রমণী শেষপর্যন্ত আত্মাভিমান দূর করে এসে মিলিত হয় স্বামীর সঙ্গে। গভীরতর কোনো জীবনবোধ না-থাকুক, একটি মধুর প্রেমের গল্প হিসেবে রচনাটি নিটোল।

১৯৩৭-এর তৃতীয় গল্পটি ‘অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেকদিনের একদিন'—পরিণত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে-কোনো গল্পের পাশে দাঁড়াতে পারে।


১৯৩৮-এ সোমেন চন্দ্রের যে গল্পগুলি প্রকাশিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে আছে—‘স্বপ্ন’, ‘সংকেত’, ‘মুখোস’, ‘অমিল’, ‘রাণু ও স্যর বিজয়শঙ্কর’, ‘এক্স সোলজার’, ‘পথবতী’ ও ‘সত্যবতীর বিদায়’। এর মধ্যে ‘মুখোস' গল্পটি সাপ্তাহিক ‘নবশক্তি' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা গেলেও গল্পটির সন্ধান করা যায়নি।


অন্যান্য গল্পগুলিকে যদি বিচার করি বিষয়বস্তুর দিক থেকে, তাহলে দেখবো সংকেত এবং ক্ষীণভাবে ‘অমিল’ ছাড়া বাকি গল্পগুলিতে লেখকের উদ্দেশ্য কেবল মানুষকে দেখানো। বিচিত্র মানুষ। তার ভালোবাসা ও ভ্রান্তি, স্বার্থপরতা ও আত্মপ্রবঞ্চনা, স্নেহ ও দ্বন্দ্ব।


গল্পগুলির কাঁচা লেখা ও পরিণত লেখা মিশে আছে। ‘পথবর্তী’ গল্পে বংশমর্যাদায় উপযুক্ত নয় ব’লে মালতীর পিতা সুব্রতর সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিতে অস্বীকার করেন। ব্যর্থ প্রেমিক বিদায় নিয়ে চলে যায় ও অশ্রুসিক্ত প্রেমপত্র ছড়িয়ে দেয় হাওয়ায়। গল্পটির প্লট যে খুব সুচিন্তিত তা বলা যায় না।


এই বছরে প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করলো সাম্যবাদী দৃষ্টিকোণ, সমাজের শ্রেণীভেদ সম্পর্কে তীক্ষ্ণতর চেতনা। সরল ও একরৈখিক গল্প ‘অমিল’।


‘রাণু ও স্যার বিজয়শঙ্কর’ গল্পটি সরল ও বক্তব্যমূলক হলেও বিজয়শঙ্করের দ্বন্দ্ব ও তার প্রতি লেখকের সহানুভূতিও লক্ষ্যণীয়। মানুষকে সাদা-কালো ভাগে ভাগ করার যান্ত্রিকতা সোমেন চন্দ্র প্রথম থেকেই বর্জন করে চলতে পেরেছিলেন।


এই ধারার শ্রেষ্ঠ গল্প ‘সংকেত’। সংগ্রামী বিশ্বাসকে গল্পে প্রতিষ্ঠিত করা অথচ গল্পের শিল্পগুণ অক্ষুণ্ণ রাখা—এই দু’দিক মিলিয়ে দিতে কম লেখকই পারেন। এ ধরনের গল্পে এক জাতীয় ঋজুতা কাঙ্ক্ষিত অথচ তা স্লোগানে পর্যবসিত হওয়াও কাম্য নয়।


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারানোর নাতজামাই’ বা ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী' গল্প দুটিতে। ‘সংকেত’—পাশে দাঁড়াবার যোগ্য গল্প। তাই সোমেন চন্দ্রের সুবিখ্যাত গল্প’ ‘ইঁদুর’ মনে রেখেও হয়তো বলা যায় বিশেষ পরিকল্পনাটির শর্ত মেনে নেবার পর ‘সংকেত' গল্পটির নির্মাণ আচার্য রকমভাবে নিখুঁত।


‘সত্যবতীর বিদায়’ গল্পটি অন্যরকম। রূপহীন, বিত্তহীন, প্রৌড়া সত্যবতী ধনী সপত্নীপুত্রের গৃহে আশ্রয়প্রার্থী।


সত্যবতী সেই গৃহে আশ্রয় পায়, কিন্তু কী এক অব্যক্ত-প্রতিহিংসা-বশে সপত্নীপুত্রের শিশু ছেলেমেয়েগুলিকে সে সন্ত্রস্ত করে তোলে ভূতের গল্প শুনিয়ে।


এই পর্বের অবিস্মরণীয় গল্প ‘স্বপ্ন’। আবার মনে পড়ে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দুই-গল্পকার মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও জগদীশ গুপ্তকে।


তার ‘দিবসের শেষে’ কিংবা ‘হাড়' গল্পে সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা নিয়তির কাছে মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণের আবহও ফুটিয়েও তোলা হয়েছে। সোমেন চন্দ্রের গল্পের পুরো ব্যাপারটাই বৈজ্ঞানিক অথচ তাঁর লিখনরীতি যেন মানুষের চরিত্রকেই তার নিজের নিয়তি করে তালে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হলুদ পোড়া' গল্পের সঙ্গে এ গল্পের একটা প্রাথমিক তুলনা চলতে পারে। কিন্তু সোমেন চন্দ্রের গল্পটিতে জীবন বাসনার তীব্রতা যখন অকম্পিত রেখায় মৃত্যুতে গিয়ে শেষ হয় তখন আমরা এক ট্রাজিক-চেতনার স্বাদ পাই যা সাধারণভাবে বাংলা ছোটগল্পে খুব সুলভ নয়।


গল্পটিতে তারাশঙ্করের একাধিক গল্পের ছাপ আছে। বিশেষত, বৈষ্ণবদের এই শ্রেণীর মধ্যে প্রেম-সম্পর্ক বিষয়ে যে বিশেষ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী ও ভাষাভঙ্গী প্রচলিত তার সুন্দর রূপায়ণ গল্পটিতে দেখি।


‘দাঙ্গা' গল্পটিকে সাম্প্রদায়িক সংজ্ঞাত সম্পর্কিত শ্রেষ্ঠ গল্প মনে করেছেন অনেকেই। সাম্প্রদায়িক বিরোধের এই নিরর্থক রক্তপাতের দিকে ইঙ্গিত করে গল্পটি।


‘ইঁদুর’ গল্পটি বহুপঠিত। সঙ্গত কারণেই এ-গল্পকে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা রূপে অভিহিত করা হয়। একটি ছোটগল্পের আকারের মধ্যে লেখক দেখিয়েছেন একটি বিশেষ সমাজে মধ্যবিত্তশ্রেণীর সমগ্র অবস্থাটির সংহত প্রতিফলন। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্গত বিত্তহীন অক্ষম যে মধ্যবিত্তশ্রেণীকে তিনি দেখান, তারা সর্বতোভাবে আত্মপ্রবঞ্চক। গল্পটির শেষবিন্দুতে লেখক সত্যের ছবিই রেখেছেন, স্বপ্নের ছবি নয়।


সোমেন বেশ কয়েকটি প্রেমের গল্প লিখেছিলেন। কিন্তু তরুণ-চিত্রের কোনো আবেগ উচ্ছ্বাস সেখানে প্রাধান্য পায় না। প্রেমকে বেঁচে থাকার অন্যতম ইতিবাচক রূপ হিসেবেই দেখেছিলেন তিনি। 'ভালো না লাগার শেষ’ গল্পে প্রেম-অনুভব সুন্দরভাবে পরিবেশিত, কিন্তু গতানুগতিক। তার চেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘মরুদ্যান’ গল্পের দূর-সম্পর্কের আশ্রিত রুনুর সঙ্গে তার বীণাদির সম্পর্ক।


‘একটি রাত’ গল্পের বীণার সঙ্গে সুকুমারের দেখাই হয় না। তবু সুকুমারের প্রতি ভালোবাসা যেভাবে লেখক দেখিয়েছেন তার চেয়ে ভালোভাবে বুঝি প্রকাশ করা যেতো না।


সোমেন চন্দ্রের গল্পের কথনরীতি বিবৃতিমূলক এবং প্লট মোটের উপর গল্প-আশ্রয়ী হ’লেও তা খুব প্রবলভাবে ঘটনা-আশ্রয়ী নয়। তাঁর গল্পকে খানিকটা আবহ-নির্ভর বলা যায়। সেই আবহ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার'-এর মতো প্রেমবোধ বা কারুণ্যবোধে লিরিক্যাল হয়ে ওঠে না।


‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর মতো রহস্য আবহময় গল্পও লেখেননি তিনি। বরং বলা যেতে পারে তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্পগুলিতে—যেমন, ‘অন্ধ শ্রবিলাসের অনেকদিনের একদিন’, ‘দাঙ্গা’, ‘ইঁদুর’, ইত্যাদি গল্পে প্রধান হয়ে ওঠে একটি টেনশন-এর আবহ।


সোমেন চন্দ্রের বিবৃতিধর্মী কথনরীতির মধ্যেও কিছু রকমফের লক্ষ্য করা যায়। অনধিক ত্রিশটি গল্পের মধ্যে মাত্র চারটি গল্পে তিনি ব্যবহার করেছেন উত্তম পুরুষের বাচন। ‘শিশু তপন’ (১৯৩৭) সোমেন চন্দ্রের প্রথম প্রকাশিতল গল্প। এখানে বিষয়—একটি বালিকার দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু এবং তার ফলে সঙ্গী বালকের শোক। গল্পটির একজন কথক আছেন, যিনি ঘটনাটি ঘটে যাবার অনেকদিন পরে গল্পের পাঠক ও শ্রোতাদের গল্পটি বলেছেন।


এরপর লেখক তার সবশুদ্ধ ছাব্বিশটি প্রাপ্ত গল্পের মধ্যে আর দুটি মাত্র গল্পে এক কথক চরিত্রকে নিয়ে এসেছেন। দুটি গল্পেই কিন্তু সেই কথক গল্পের অন্তর্গত এক চরিত্রও হয়ে উঠেছে, আগের দুটি গল্পের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেনি। এরপর লেখক তাঁর সবশুদ্ধ ছাব্বিশটি প্রাপ্ত গল্পের মধ্যে আর দুটি মাত্র গল্পে এক কথক চরিত্রকে নিয়ে এসেছেন দুটি গল্পেই কিন্তু সেই কথক গল্পের অন্তর্গত এক চরিত্রও হয়ে উঠেছে। আগের দুটি গল্পের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেনি।


গল্পে ব্যবহৃত গদ্যের ক্ষেত্রে সোমেন চন্দ্র সাধু বাংলা গদ্য ও চলিত বাংলা গদ্য দুইই ব্যবহার করেছেন। তিনের দশকের শেষ পর্যন্ত, এমনকি চারের দশকের প্রারম্ভেও গল্প উপন্যাসের মাধ্যম হিসেবে সাধু-গদ্য অপ্রচলিত হয়নি। আবার চলিত ভাষায় প্রচলিত হয়েছে। সোমেন চন্দ্র দু’টি রীতিতেই অভ্যস্ত ও অনায়াস ছিলেন। গল্পের বিষয় বা অভিপ্রায়-ভেদে গদ্যের রীতি যে পরিবর্তিত করেছিলেন, তা মনে হয় না।


স্বাভাবিকভাবেই প্রথমদিকে লেখা গদ্যে সাধুরীতি ও পরের দিকে লেখা গদ্যে চলিত রীতি প্রযুক্ত হয়েছে। সংলাপ অংশে তিনি সবসময়েই চলিত বাংলা ব্যবহার করেছেন। তবে, প্রথম দু'একটি গল্পে সংলাপের ভাষায় আড়ষ্টতা ও অস্বাভাবিক আবেগের স্পর্শ আছে। প্রথম কয়েকটি গল্পের পরেই তা থেকে সর্বাংশে মুক্ত হতে পেরেছিলেন তিনি।