“ধর্মবোধের কথা বলতে গিয়ে চর্যাপদের সহজিয়া সাধকেরা প্রকৃতপক্ষে বাস্তব চর্চিত জীবনযাত্রার কথাই বলেছেন”—মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো।

চর্যাপদের মধ্যে একদিকে যেমন আচার সর্বস্ব বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মাচরণের প্রতি বিদ্রুপ এবং অবিশ্বাস প্রকাশিত অন্যদিকে তেমনি হিন্দু ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক দেহবাদের প্রতি আস্থা জ্ঞাপনও লক্ষ্য করা যায়। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন যানের প্রতি কোন না কোনভাবে সমর্থন জানানো হয়েছে। চর্যাপদে কোনভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে পুরোপুরি স্বীকার করা হয়নি। সিদ্ধাচার্যেরা মোটমুটি সকলেই বৌদ্ধতান্ত্রিক ধর্মপ্রদর্শিত আচার আচারণ পদ ও সাধনাকে জীবনচর্যা হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং সেই অনুযায়ী জীবনকে পরিচালনা করতে স্থির সিদ্ধান্ত নেন। তফাৎ শুধু 'যান' নিয়ে। চর্যাপদের বহুপূর্বে বৌদ্ধতান্ত্রিক ধর্মের মধ্যে একটা দেহবাদী আলাদা পথের সৃষ্টি হয়েছিল যা 'যান' নামে বিখ্যাত।


প্রথম শতকে বৌদ্ধ ধর্মের চতুর্থ ও শেষ সম্মেলনের অধিবেশনে মতভেদ প্রবল আকার ধারণ করেছিল। এতে ভগবান তথাগতের ধর্ম বরাবর দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায় তা হল—‘হীনযান’ ও ‘মহাযান'। হীনযানপন্থীরা প্রধানত বাহ্যবস্তুর বাস্তব সত্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। আত্ম নির্বাণই এই মতাবলম্বীদের মূল উদ্দেশ্য। সংসারের মধ্য দিয়ে নির্বাণ লাভই ছিল মূল উদ্দেশ্য এবং তা সুকঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে অর্জন করতে হয়। এই নির্বাণের মূল তাৎপর্য হল চৈতন্যমুলোচ্ছেদ করা। তবে নির্বাণের পর চিত্তস্বরূপের কীরূপ অবস্থা হয় তার নির্দিষ্ট কোনও ইঙ্গিত হীনযান শাস্ত্রে পাওয়া যায়নি।


মহাযান পন্থীরা কল্যানব্রতী বোধিসত্ত্বের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। এই বোধিসত্ত্ব হল জীবের কল্যাণের জন্য বুদ্ধদেবের জন্ম জন্মান্তর পরিগ্রহণ করা। এই মতের আচার্যরা মনে করতেন কতকগুলি বিশেষ 'পরিনীতা'রাই এ কাজে সাহায্য করেন। এঁদের কাছে জগৎ শূন্য, তাই এঁরা শূন্যবাদী নামে পরিচিত।


অষ্টম শতকের দিকে ভগবান তথাগতের ধর্ম অতি দ্রুত মন্ত্র সাধনার কবলে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি বৌদ্ধ উপশাখার সৃষ্টি হল যার নাম মন্ত্রযান। এইভাবে কালক্রমে কালচক্র যান, বজ্রযান, সহজযান প্রভৃতির সৃষ্টি হল। সব কিছুর মূল উদ্দেশ্য নির্বাণ লাভ। এই নির্বাণ লাভের অর্থ হল মহাসুখ।


সহজযানের চারটি ভাগ আছে—(১) প্রথমানন্দ, (২) পরমানন্দ, (৩) বিরামানন্দ, (৪) সহজানন্দ। সহজানন্দই হল মহাসুখ। এই মহাসুখ লাভের জন্য ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র পরিকল্পিত। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশেষ শারীরিক চর্চা ও সাধন প্রক্রিয়া আছে। বৌদ্ধ সহজিয়াদের রচিত কোনও সংস্কৃত গ্রন্থ নেই। যে তিব্বতীয় অনুবাদ পাওয়া যায় তাতে তাঁদের সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। তিব্বতে যারা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত তাঁরাই বিশেষভাবে সহজযান নামের প্রচারক।


এই সহজযান বিভিন্ন জায়গায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। যেমন—মগধ, বাংলা, ওড়িষা, কামরূপ প্রভৃতি। এই পদ্ধতির সঙ্গে একরকম দৈহিক প্রক্রিয়ার সম্পর্ক ছিল। এই মতের মধ্যে ছিল। বিভিন্ন আচার আচরণ, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র এবং নামপন্থা। হরপ্রসাদশাস্ত্রী আবিষ্কৃত চর্যাচর্য বিনিশ্চয় প্রধানত সহজিয়া মতের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিছু কিছু সিদ্ধাচার্যরা বজ্রযানেও আসক্ত ছিলেন। ইসলাম অভিযানের ফলে নির্যাতিত হিন্দু সমাজ পরাজয়ের বেদনা ভুলবার জন্য পৌরাণিক শাস্ত্র চর্চার অন্তরালে আশ্রয় নিয়েছিল। চর্যামান, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, দোঁহায় নিম্নবর্ণের উল্লেখ দেখা যায়। মন্ত্রযান অন্ত্যবাসীদের মধ্যে শেষ আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। উপরন্তু শাস্ত্রবাদী ব্রাহ্মণ্য সমাজ বেদবিরোধী নাস্তিক বৌদ্ধমতের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তাই এই মতাবলম্বীদের নিম্নশ্রেণির মধ্যে নিম্নশ্রেণির মানুষেরা আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল।


দেহচর্চার অনুশীলন পরবর্তীকালে বৈক্ষ্ণব সহজিয়া নামপন্থী, আউল, বাউল, সাঁই, দরবেশ প্রভৃতির লোকধর্মকে ও আচার আচরণকে কখনো প্রত্যক্ষভাবে কখনো পরক্ষোভাবে প্রভাবিত করেছিল। তন্ত্রে পঞ্চ ‘ম' কারের অন্তর্ভুক্ত মৈথুন তন্ত্রের গূঢ় তাৎপর্য ছিল। তন্ত্র ও তদানুসারী সাধন প্রক্রিয়ায় স্ত্রীলোকের বিশেষ ভূমিকা ছিল।