মধ্যযুগে ‘ভাগবত' অনুসরণে বাংলার কৃষ্ণকথার যে সব গ্রন্থ রচিত হয়েছিল তার স্তরানুক্রমিক পরিচয় দাও। এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কোনটিকে বলা যায় এবং কেন ব্যাখ্যা করো।

'ভাগবত' অনুসরণে বাংলার কৃষ্ণকথার গ্রন্থ


'ভাগবত' অনুসরণে বাংলার কৃষ্ণকথার যে সকল গ্রন্থ রচিত হয়েছিল তার বিবরণ নিম্নে দেওয়া হল—

(১) প্রাক্ চৈতন্যযুগ: মালাধর বসুর— 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়'।

(২) ষোড়শ শতকঃ রঘুনাথ ভাগবতাচার্যের— 'কৃষ্ণ প্রেম তরঙ্গিনী'। কবিশেখরের– 'গোপাল বিজয়'।

(৩) সপ্তদশ শতকঃ দ্বিজমাধবের— ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল কাব্য’। কৃষ্ণদাসের— 'মাধবচরিত' বা 'কৃষ্ণমঙ্গল'। কৃষ্ণদাসের (কাশীরামদাসের অগ্রজ)- ‘শ্রীকৃষ্ণবিলাস'। অভিরাম দত্তের— ‘শ্ৰীকৃমঙ্গল’। পরশুরাম চক্রবর্তীর— ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল। ভবানন্দের–‘হরিবংশ’।


প্রভৃতি গ্রন্থগুলি 'ভাগবত' অনুসরণে রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থরাজির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল—মালাধর বসুর, শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' কাব্যখানি।


কবি মালাধর বসু কৃত্তিবাসের রাম কথার মতো কৃষ্ণকথাকে প্রথম বাঙালি সমাজের সঙ্গে পরিচয় করাবার প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সুদৃঢ় নিষ্ঠা ও সহকারে তিনি ভাগবতী আদর্শকে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগের ভাগবত অনুবাদকরূপে তিনি পরবর্তী কবিদের অনুপ্রাণিত করেছেন। তবে মনে রাখতে হবে একাব্যের গঠনগত বিচারে মঙ্গলকাব্যের সঙ্গেই এর আত্মীয়তা বেশি। কোনও কোনও ‘মঙ্গল’-কবি যেমন চিরায়ত কাহিনিকে ঢেলে সাজিয়ে স্বাতন্ত্র্যের দাবী রেখেছিলেন মালাধর বসুর মধ্যেও সেই স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। এর কারণ মূলতঃ আনুগত্যের বদলে মৌলিক সৃষ্টির জন্য আকাঙ্ক্ষা ; লোকজীবন থেকে উপাদান সংগ্রহ করে বাঙালির ইচ্ছাপূরণের দিকে দৃষ্টিদান; মূলরচনার দুরূহতা এবং ভাগবতের অপেক্ষাকৃত অপরিচিত ভাবনা সম্পর্কে কবির সজাগ মনোভঙ্গী।


জাতীয় জীবনের আদর্শ রচনার প্রয়োজনে কবি মালাধর কাব্যের অনেক স্থানে যোগ করেছেন ‘নিজ মন উক্তি। ফলে ভাগবতের সংস্কৃত ভাষার ভূষণভার এখানে ঝরে গেছে। এবং ভাষা যেন ঘরোয়া সারল্যে পরিণত হয়েছে। উদ্ধব কর্তৃক কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন বৃত্তান্ত, রাসলীলায় পরদার গমন বিষয়ে নীতিমুখর সাবধান বাণী, শক্তিপূজা বর্ণনার আগ্রহ অংশে কবির নিজস্বতা, স্বাতন্ত্র্য বোধ বর্তমান। এছাড়া, সখাদের সঙ্গে কৃষ্ণের অন্ন ভক্ষণে, মথুরায় জলপাই গুয়াগাছ বর্ণনায়, পতাকার সঙ্গে হাঁসের পাতির তুলনায়, নিসর্গ চিত্রণে বাঙালির জীবন ও পরিবেশ সুস্পষ্ট। তাঁর কাব্যে পাই—

"পুত্রের জনম দিনে     কাজল দিল নয়নে

শূন্য ঘরে আছে শ্রীহরি।"

এ রূপ ছবি, অথবা যশোদার মুখে বাংলা বাকরীতিতে বাংলা মায়েরই অভিমান অঙ্কিত হয়ে যায়—“মিথ্যা না দুসিয় পুত্রখানি” কথায়। বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি বাঙালির, স্নেহবাৎসল্য তাঁর কাব্যে লভ্য।


ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্দের কাহিনিসূত্র অবলম্বনে রচিত একাব্যের মাহাত্ম্য গুণে আকৃষ্ট হয়ে স্বয়ং চৈতন্যদেব প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিলেন। তার জন্যে যে এই কাব্য বৈষ্ণুব সমাজে শ্রদ্ধা লাভ করেছিল তা অনুমান করা যেতে পারে। কাব্যটির কাব্য গুণের জন্য নয়, জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল ভিন্ন কারণে। যেমন—(১) এটি ভাগবতের অনুবাদ গ্রন্থ, যে ভাগবত সারা ভারতের ভক্ত সমাজের শ্রদ্ধার আসনলাভ করেছিল। (২) মধ্যযুগের আদিপর্বে এটি হচ্ছে ভক্তের রচিত আখ্যানকাব্য, কৃত্তিবাস, বড়ু চণ্ডীদাস প্রধানত—কবি। কিন্তু মালাধর প্রধানত ভক্ত। কবিত্ব শক্তি যেমনই হোক না কেন প্রশংসাই তাঁর প্রাপ্য। (৩) 'নন্দনন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ' মালাধরের এই উক্তিটি শ্রীচৈতন্যকে অত্যন্ত মুগ্ধ করেছিল এবং ওই ‘প্রাণনাথ' শব্দদুটি পরবর্তীকালে বৈষ্ণুব ভক্তদের নতুন পথা নির্দেশ করেছিল। কাজেই শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যাংশে তত উৎকৃষ্টতা অর্জন না করলেও গৌড়ীয় বৈষ্ণুব সমাজে বেশ সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল। এমনকি কুলীন গ্রাম মালাধরের বাসভূমি বলে চৈতন্যদেব এই গ্রাম ও গ্রামবাসীদের বিশেষ সম্মান করতেন। তাইতো কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর চৈতন্য চরিতামৃতে লিখেছেন :

কুলীন গ্রামের ভাগ্য কহনে না যায়।

শূকর চরায় ডোম সেহো কৃষ্ণ গায়।।


ভাগবতের কঠিন অংশকে সাধারণ শ্রোতার কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে কবি মালাধর বসু সচেষ্ট হয়েছিলেন। উদ্দেশ্য—“লোক নিস্তারিতে যাই পাঁচলি রচিয়া।” তাই এই ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ ভাগবতের পরবর্তী অনুবাদগুলিকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং এর দ্বারাই বাঙালি সমাজ ভাগবত ও কৃষ্ণলীলার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। মালাধর সরল বাংলা ভষায় ভাগবত প্রচার করেছিলেন। ক্রমেই বাঙালি জীবন ও সমাজে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ সমাদর লাভ করেছিল। কবি মালাধর ভাগবতের যেমন প্রথম অনুবাদক তেমনি শ্রেষ্ঠ অনুবাদক। তাঁর পরে যাঁরা ভাগবত অনুসরণে কৃষ্ণলীলা কাব্য রচনা করেছিলেন, তাঁরা প্রায় কেউই সার্থকতা অর্জন করতে পারেন নি। কারণ যে গুণের জন্য আপামর বাঙালির কাছে মালাধর কবি হিসাবে শ্রদ্ধেয়, সেই ‘বাঙালি ভাব’ পরবর্তী অন্যান্য কবিদের মধ্যে অনুপস্থিত। তাই অন্যান্য কবিগণ মালাধরের জ্যোতিতে প্রায় ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে। এককথায় বাংলা অনুবাদ কাব্যে মালাধর বসুর সম্মানীয় আসন লাভ প্রধানতঃ তাঁর বাঙালিয়ানায়। প্রকৃতপক্ষে তার কাব্য সর্বজনবোধ্য বলেই তিনি সর্বজন ধন্য। অতএব গৌড়ীয় বৈষ্ণুব সাধনা ও সাহিত্যের ইতিহাস জানতে হলে—‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’কে তার আদি উৎস বলে গ্রহণ করতে হবে।