বাংলা সাহিত্যে চর্যাগীতির ঐতিহাসিক মূল্য নিরূপণ করো। পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের ভাবাদর্শ ও রচনা পদ্ধতির কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায় কি?

চর্যাগীতির ঐতিহাসিক মূল্য :


শুধু বাংলা ভাষা কেন, সমস্ত পূর্বভারতের নব্যভাষার প্রথম গ্রন্থ এই 'চর্যাচর্য বিনিশ্চয়'। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই পুঁথি আবিষ্কারও করে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের লুপ্ত সম্পদ উদ্ধার করেন। এই গ্রন্থটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অবশ্যই ঐতিহাসিক। ঐতিহাসিক গুরুত্বগুলি হল—

  • সামাজিক দলিল হিসেবে অত্যন্ত মূল্যবান।

  • বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনতত্ত্বের পরিচয়বাহী।

  • সাহিত্যিক তথা কাব্যগত তাৎপর্যের দিক।

  • ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্বের দিক।


সামাজিক দলিল মূল্যের দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক বিশেষ সময়ের বঙ্গদেশের সামাজিক ইতিহাসটি এই গ্রন্থের নানা পদে ভিন্ন ভিন্ন রূপক সংকেতের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। সেই সময়ের শবর, চণ্ডাল, ডোম ইত্যাদি অন্ত্যজ মানুষের খাদ্যবস্ত্র বাসস্থানের চিত্রে দেখি ভাত ছিল সে সময়ের প্রধান খাদ্য। লাউ (১৭), মাছ, মাংস (৬), তেঁতুল, দুধ (৩৩), মধুও তাদের খাদ্য ছিল। সেই সঙ্গে তৎকালিন ধনিক শ্রেণির জীবন যাপনের আভাস নানা পদে প্রকাশিত। বাসস্থানের চিত্রে দেখি ধনী দরিদ্র ভেদে কুঁড়ে ঘর কিংবা দু’মহলা তিনমহলা ঘরে মানুষ বাস করত। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে টালত ঘর মোর নাহি পড়বেষী। 'হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী'র—উল্লেখ যেমন আছে তেমনি ধনি ব্যবসায়ীরাও সেকালে আসর জমাত (৮,৪৯)। এ গ্রন্থ থেকে তৎকালের বিবাহ (১৯), শিকার (৬.২৩), দাবা খেলা (৯), নাট্যাভিনয় (১৭) ইত্যাদি উৎসবানুষ্ঠানের পরিচয় আমরা জানতে পারি। শুধু তাই নয়, তৎকালের আচার প্রথা, প্রেম-দাম্পত্য (২০) ইত্যাদি যাপন পদ্ধতিটিও মূর্ত আছে এখানে। এই গ্রন্থ পাঠে জানা যায় তৎকালের নদীমাতৃক বঙ্গদেশের (৫), পর্বত ও অরণ্যাশ্রিত (২৮,৬) বঙ্গদেশের পরিচয়টি। এক বিশেষ সময়কালের বঙ্গদেশের ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ইতিহাসটিকে চর্যাচর্য বিনিশ্চয় বহন করছে।


একদা বঙ্গদেশে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের ব্যাপক প্রচলন ছিল। কায়া সাধনাকে মূলধন করে বৌদ্ধ সাধক সম্প্রদায় দেহজ কামনা বাসনা থেকে মুক্তির যে তত্ত্বে দীক্ষিত ছিলেন তার ইঙ্গিতটি এই গ্রন্থের পদে পদে বিধৃত। সেই কারণে গ্রন্থটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যেমন্ডিত।


এই গ্রন্থ বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসের দিক নির্দেশক। কেননা এটিই বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের আদি নিদর্শন। বাংলা গীতিকাব্যের যে পৃথিবীব্যাপী গৌরব তার প্রাথমিক প্রয়াস এই চর্যাপদ। এদিক থেকেও নিঃসন্দেহে বলা যায় যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত এই গ্রন্থটি আমাদের নিকট একটা ঐতিহাসিক সম্পদ।


বাংলা ভাষার জন্ম ইতিহাসের নিরিখে চর্যাচর্যনিশ্চয়ের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। বৈদিক ভাষা, প্রাকৃত ভাষা, অপভ্রংশ ভাষার স্তর পেরিয়ে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা রূপে বাংলা ভাষার যে বিবর্তন সূত্র তার নিদর্শন এই চর্যাপদই।


চর্যাপদে ভাবাদর্শ ও রচনা পদ্ধতির প্রভাব :

চর্যাপদে বজ্রযান ও সহযানের গূঢ় ধর্ম, সাধনপ্রণালী ও দর্শনতত্ত্ব নানা ধরনের রূপক প্রতীক ও চিত্রকল্পের দ্বারা আভাস ইঙ্গিত ব্যঞ্জিত হয়েছে। চর্যাসাধনার মূল কথা হল— দেহমুক্তির সাধনা। সেখানে বলা হয়েছে মানবদেহের চারটি চক্র বর্তমান সম্ভোগচক্র, ধর্মচক্র, কণ্ঠচক্র, মহাসুখ চক্র। সাধকেরা চক্রের আবর্তনকে জয় করে মস্তিষ্কে অবস্থিত মহাসুখ চক্রে পৌঁছতে পারলে সিদ্ধিলাভ করত। অর্থাৎ সহজানন্দে অবস্থান করত। নাথপন্থী সাধনাতেও প্রায় একই রকম সাধন পদ্ধতি অনুসৃত হত। এই মতে নাভিতে বর্তমান থাকে অমৃত বিন্দু। সেই অমৃত বিন্দুকে ঊর্ধ্বমুখে প্রবাহিত করে মস্তিষ্কে অবস্থিত সূর্য শক্তিতে তুলতে পারলে সাধক সিদ্ধিলাভ করত। বাংলা দেশের আউল-বাউল সাধনাও সমভাবে সাধন প্রক্রিয়ার কথা ব্যক্ত। এখানে বলা হয়েছে দেহে আছে ষড়চক্র। এখানেও একটার পর একটা চক্র অতিক্রম করে মাথাতে অবস্থিত পদ্মশক্তিকে জাগিয়ে সিদ্ধিলাভের কথা বলা হয়েছে। শক্তি সাধনার ক্ষেত্রে দেখি মেরুদণ্ডের নীচে অবস্থিত কুলকুণ্ডলিনী শক্তি উপরে প্রবাহিত করে মস্তিষ্কে অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ধর্ম সাধনার ক্ষেত্রে চর্যাপদে কামনা বাসনা থেকে মুক্ত করে দেহকে সহজানন্দে নির্বাচনের যে কথা বলা হয়েছে তাই পরবর্তীকালের বিভিন্ন সাধক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটু ভিন্ন মাত্রায় বিবর্তিত।


নাথপন্থী ও গোরক্ষপন্থী সাধকেরা চর্যা সাধনার ঐতিহ্য অনুসারী। চর্যাগীতির চন্দ্র সূর্য, গঙ্গা, যমুনা, দেহনগরী প্রভৃতি রূপক নাথ পন্থীর উপর চর্যাগীতির গুরুত্বকে তুলে ধরে। সদগুরু অথবা পরমগুরু বোঝাতে 'নাথ' কথাটি চর্যাগানে এবং ‘দোহাকোষে’ আছে।


চর্যাপদের প্রভাব শিবসঙ্গীতে ও শাক্ত পদাবলীতেও রয়েছে। আবার বৈব মরমীয়া সহজ সাধকদের মধ্যেও রয়েছে। চর্যার প্রভাব বাউল গানেও পড়েছে। কাহ্ন বলেছেন ‘তো বিনু তরুণি নিরন্তর নেঁহে/বোহি কি লভবই ঐ ন–বি-দেঁহে। নীচের দুইটি বাউল ছড়াতে চর্যার এ জাতীয় প্রভাব স্পষ্ট :

“টলে জীব অটলে ঈশ্বর 

তার মধ্যে খেলা করে রসিক শেখর"

তুলনীয় কাহ্নপদের ২৮ সংখ্যক পদ :

“তইলো ডোম্বী সঅল বিটলিউ 

কাজন কারণ সমহর টালিউ।”

বাউল সাধনার পাশাপাশি আউল সাধনায় তথা ফকিরি সাধনার ইঙ্গিতটিও বিকশিত।