বাঙলা নাট্য-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের দানের মূল্য | রবীন্দ্রনাথের সাঙ্কেতিক নাটকসমূহের বিষয়ে ধারাবাহিকতা | রবীন্দ্র নাট্যসাহিত্যের বৈচিত্র্য বৈশিষ্ট্য নির্দেশপূর্বক ইতিহাস

রবীন্দ্রনাথের রূপক সাঙ্কেতিক নাটক


‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ নিজের নাট্যাভিনয়-প্রবণতার কথা উল্লেখ করে গেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরই তাকে নাটক রচনা এবং অভিনয়-চর্চায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কবির অফুরন্ত সৃষ্টিশক্তিও বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজতে চেয়েছে। আর তারই একটা অন্যতম পথ নাটক রচনা। রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলােকে মােটামুটিভাবে ছটি শ্রেণীতে বিভক্ত করে নেওয়া যায়-


  • (ক) গীতিনাট্য- 'বাল্মীকি প্রতিভা' (১৮৮১), 'কালমৃগয়া' (১৮৮৮), 'মায়ার খেলা' (১৮৮৮) এর অন্তর্গত; 

  • (খ) মনস্তাত্ত্বিক ও প্রচলিত রীতিসম্মত নাটক- 'প্রকৃতির প্রতিশোধ' (১৮৮৪), 'রাজা ও রানী' (১৮৮৯), 'বিসর্জন' (১৮৯০), 'মালিনী' (১৮৯৩), 'প্রায়শ্চিত্ত' (১৯০৯), 'গৃহপ্রবেশ' (১৯২৫), ‘শােধবােধ’ (১৯২৬), 'তপতী' (১৯২৯);

  • (গ) কাব্য প্রধান নাটক- 'সতী (১৮৯২), বিদায় অভিশাপ' (১৮৯৩), 'চিত্রাঙ্গদা' (১৮৯৭), 'গান্ধারীর আবেদন (১৮৯৭), নরকবাস' (১৮৯৭), লক্ষ্মীর পরীক্ষা' (১৮৯৭), কর্ণ কুস্তী সংবাদ (১৯০০); 

  • (ঘ) নৃত্যনাট্য- 'চিত্রাঙ্গদা' (১৯০৬), 'চণ্ডালিকা' (১৯৩৮), 'শ্যামা' (১৯৩৯); 

  • (ঙ) রূপক ও সাংকেতিক নাটক- ‘রাজা’ (১৯১০), 'অচলায়তন' (১৯১২), 'ফাল্গুনী' (১৯১৬), 'অবুপরতন' (১৯১০), 'শারদোৎসব' (১৯২৪), 'মুক্তধারা' (১৯২৫), 'রক্তকরবী' (১৯২৬), 'ডাকঘর' (১৯৩২), 'কালের যাত্রা' (১৯৩২);

  • (চ) কৌতুকরস প্রধান নাটক- 'গাড়ায় গলদ' (১৮৯২)পরবর্তী সংস্করণে এটি ‘শেষরক্ষা’ (১৯২৮) নামে প্রকাশিত, ‘বিকুণ্ঠের খাতা' (১৮৯৭), 'চিরকুমার সভা' (১৯২৬)—এটি 'প্রজাপতির নিবন্ধ' উপন্যাসের নাট্যরূপ। এই বিভাগ থেকে রবীন্দ্রনাথের নাটকের প্রকরণ-বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যাবে।


গীতিনাট্য

রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী বাঙলা নাটক ছিল বাহ্যিক সংঘাত এবং ঘটনাড়ম্বরের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত নাট্যরীতির অনুসরণে নিজের প্রতিভাকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। স্বকীয় জীবনচেতনার উপযুক্ত নাটকীয় আঙ্গিক নির্মাণের পরীক্ষায় তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন এবং দুঃসাহসিক, ব্যবসায়িক রঙ্গমঞ্চের সাফল্যের প্রতি ভূক্ষেপহীন। নাটক রচনার প্রথম পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ নাটকের শিল্পমাধ্যম হিশেবে সঙ্গীতের সার্থকতা পরীক্ষা করে দেখেছেন। কবির প্রথম গীতিনাট্য 'বাল্মীকি প্রতিভা', 'কালমৃগয়া', 'মায়ার খেলা' প্রভৃতি রচনার পাত্রপাত্রীদের সংলাপ, ভাব পরিবর্তন, চরিত্রবৈশিষ্ট্যের স্ফুরণ, ঘটনার পরিণতি ইত্যাদি সকল কিছুর অবলম্বন সঙ্গীতপ্রবাহ; এই গীতিসর্বস্বতায় নাটকের একটা ক্ষীণ, অস্পষ্ট সুদূর ছায়া লক্ষিত হয় মাত্র।


রীতিসম্মত নাটক

দ্বিতীয় স্তরের নাটকগুলােতে প্রচলিত নাটকীয় আঙ্গিকের অনুসরণে মানসদ্বন্দ্বের রূপায়ণের চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এই যুগের নাটক রচনায় সঙ্গীতের মাধুর্য এবং গীতিকবিতাসুলভ আবেগােচ্ছাস থেকে রবীন্দ্রনাথের শিল্পীমানস সম্পূর্ণরূপে মুক্ত না হলেও তিনি প্রচলিত নাটকের গঠনকৌশলকে মােটামুটিভাবে অনুসরণ করেছেন। 'প্রকৃতির প্রতিশােধ' সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, এটি এমন একটি নাটক যা গানের ছাঁচে ঢালা নয়। 'প্রকৃতির প্রতিশােধ'-এর নায়ক সন্ন্যাসী শুষ্ক, কঠোর বৈরাগ্যের কৃচ্ছতার সাধনায় সংসারের স্নেহ-প্রেমের বন্ধনকে অগ্রাহ্য করতে চেয়েছে, জীবন মমতার উৎসরূপিণী একটি বালিকাকে প্রত্যাখ্যান ও পরিত্যাগ করে অন্তর্বন্দ্বে ন্ত্রণাক্ষুক্ধ হয়েছে, অবশেষে স্নেহের আকর্ষণের মধ্যেই সে জীবনের চরম অর্থকে খুঁজে পেয়েছে। সীমাকে লইয়াই অসীম, প্রেমকে লইয়াই মুক্তি', এই তত্ত্বটিকেই কবি সন্ন্যসীর হৃদয়াবেগের সংঘাতেও অন্তর্ঘাতের মধ্য দিয়ে রূপায়িত করেছেন। এই নাটকের লিরিক উচ্ছাস ও তত্ত্বগত প্রাধান্যসত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ যে জীবনের সমস্যার নাট্যরূপায়ণে আগ্রহী, তার লক্ষণ সুস্পষ্ট। 'রাজা ও রানী' এবং 'বিসর্জন' শেক্সপীয়রীয় পঞ্চাঙ্ক ট্র্যাজেডির আদর্শে রচিত। 'রাজা ও রানী' রবীন্দ্রনাথের প্রথম পূর্ণাঙ্গ পঞ্চাঙ্ক নাটক। বিক্রমদেব ও সুমিত্রার দাম্পত্য সম্পর্কের দ্বন্দ্ব এই নাটকের মূল উপজীব্য ও রাজার কর্তব্যবিমুখ আত্মবিস্মৃত সর্বনাশা কামনার ক্ষুধা থেকে স্বামীকে, নিজেকে এবং রাজ্যের নিরাপত্তাকে রক্ষা করবার জন্য সুমিত্রা রাজার কাছ থেকে নিজেকে অপসারিত করে নেয় এবং পরিশেষে মর্মান্তিক আঘাত-বেদনার মধ্যে তার আত্মদানে নাটকের সমাপ্তি হয়। কিন্তু নাটকটিতে সংঘাত গভীর হয় নি, তা কিছুটা পরিমাণ কৃত্রিম ও অতিরঞ্জিত এবং নাটকীয় তাৎপর্যহীন এবং ঘটনাড়ম্বরের আয়ােজনে মেলােড্রামায় পর্যবসিত। রবীন্দ্রনাথ নিজেও 'রাজা ও রানী'র দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন, তিনি তার সংস্কার সাধন করে পরে 'তপতী: (১৯২৯) নাটক রচনা করেন। কিন্তু এই রচনায়ও ভাববিলাস এবং মেলােড্রামার উপাদানগুলােকে বর্জন করা সত্ত্বেও নাটকীয় ভারসাম্য ঠিক রক্ষিত হয়নি। 'তপতী' অনেকটা পরিমাণেই তত্ত্বপ্রধান নাটক হয়ে উঠেছে। রাজর্ষি উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘বিসর্জন’-এও নাটকের পঞ্চাঙ্ক রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এই নাটকটিতে রাজা গােবিন্দমাণিক্য এবং নাটকের পঞ্চাঙ্ক রীতি অবলম্বিত হয়েছে। এই নাটকটিতে রাজা গােবিন্দমাণিক্য এবং প্রেমের শক্তির সঙ্গে রঘুপতি ও আচারসর্বস্ব হৃদয়হীন ব্রাহ্মণ্য পৌরােহিত্যের দ্বন্দ্ব রূপায়িত। একান্ত স্নেহভাজন ও পালিত পুত্র জয়সিংহের আত্মােৎসর্জনে প্রেম ও কল্যাণের মাহাত্ম্য-প্রতিষ্ঠা এবং সেই রক্তাক্ত, বিদ্বেষ-কুটিল বিরােধের অবসান। ঘটনাবিন্যাসে দুর্বলতা এবং কাব্যধর্মিতার প্রাধান্য-সত্ত্বেও গৌবিন্দমাণিক্যে ব্যক্তিত্বের গাম্ভীর্য, জয়সিংহের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং রঘুপতির আহত অভিমান ও জয়সিংহের মৃত্যুতে তার শােকোচ্ছাস নাটকীয় তীব্রতায় চিত্রিত হয়ে 'বিসর্জন' কে বিশিষ্ট করে তুলেছে। 'মালিনী’তে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মবিরােধ বিশেষ নাটকীয় সংহতি লাভ করেনি।


কাব্যধর্মী নাটক

স্বকীয় গীতিপ্রাণতা এবং তত্ত্ব, ভাবাদর্শ রূপায়ণের ঝোকের জন্য কবি আর শেক্সপীয়রের নাট্যরীতি অনুসরণে বিশেষ উৎসাহ বােধ করেননি, পরবর্তীকালের নাটকগুলােতে তিনি কাহিনীর ঘটনাগত বিন্যাসকে বর্জন করে প্রত্যয় ও হৃদয়ানুভূতিগত দ্বন্দ্বের ছকেই তাঁর জীবনসত্য উপলব্ধিকে রূপদান করেছেন। স্বরূপ বৈশিষ্ট্যে মূলত কাব্যধর্মী তৃতীয় পর্যায়ের নাটকগুলােতে অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রকাশ নাটকীয় নয়, তা কাব্যের সৌন্দর্য, সঙ্গীত ও বিশিষ্ট অলংকরণেই অভিব্যক্ত। 'চিত্রাঙ্গদা মদনদেবের নিকট রূপ-ঋণ লইয়া যে অর্জুনকে আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, তাহার জন্য তাহার মনে অনুতাপ ও আত্মধিকার জাগিয়াছে। অর্জুনেরও চিত্রাঙ্গদার প্রতি ভাব পরিবর্তন করিয়াছে। কিন্তু ইহাদের উপস্থাপনা হইয়াছে নাটকীয় রীতিতে নহে, দীর্ঘ স্বগতেতাক্তি ও অপূর্ব কাব্য-সৌন্দর্যের মাধ্যমে আত্মবিশ্লেষণ ও প্রেম নিবেদনের দ্বারা। মনস্তত্ত্ব ও হৃদয়-সংঘাতের ইঙ্গিত এই কাব্যপ্লাবনের নীচে চাপা পড়িয়া গিয়াছে, কিন্তু অন্তরাত্মা কাব্যের।' 'গান্ধারীর আবেদনে' আখ্যানবস্তু ও নীতি প্রতিষ্ঠারই প্রাধান্য, চরিত্রগুলাে স্বকীয় পরিবর্তনহীন আবেগে স্থির, নাটকীয়তা গৌণ। রবীন্দ্রনাথের কাব্যধর্মী নাটকগুলাের মধ্যে 'কর্ণ ও কুন্তী’র মধ্যেই কাব্য ও নাট্যগুণের সর্বাপেক্ষা সার্থক সমন্বয় ঘটেছে বলে কোনও কোনও সমালােচক মনে করেন। কর্ণের জীবনের নিষ্ফলতার বেদনা, কুন্তীর আত্মপরিচয় দানের মুহূর্তে তার আবেগের তরঙ্গোচ্ছাস ও অবশেষে নিজের জীবনের অনিবার্য রিক্ততাকেই শান্ত অথচ কঠিন ভঙ্গিতে বরণ—এ সমস্তই এক গম্ভীর ট্র্যাজিক বিষাদে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।


রূপক-সাঙ্কেতিক তথা তত্ত্ব নাটক

রবীন্দ্রনাথের চতুর্থ শ্রেণীর রূপক ও সাঙ্কেতিক নাটকগুলােতেই তার নাট্যপ্রতিভার উজ্জ্বলতম বৈশিষ্ট্য উদ্ভাসিত হয়েছে। রূপক সাহিত্যে বিরুদ্ধ, নির্বিশেষ ভাব, চিন্তা প্রত্যয়কে রূপকের বন্ধনে, বস্তুরূপ ও তার অন্তরালবর্তী মূল সত্যের একাত্মতায় মূর্ত করে তােলা হয়। সাঙ্কেতিক রচনায় রূপকের মধ্যস্থতারও কোন প্রয়ােজন হয় না। সেখানে নিগৃঢ় রহস্যময় ব্যঞ্জনা নাট্যবস্ত থেকে উৎসারিত হয়ে তাকে রহস্যময় করে তােলে। 'রূপক' এবং 'সাঙ্কেতিক' নাটকের পার্থক্য-বিষয়ে ডঃ অজিতকুমার ঘােষ বলেন, অরূপকে রূপের মধ্যে ধরিবার চেষ্টা সাঙ্কেতিক রচনায় কিন্তু রূপান্তরে দেখাইবার ইচ্ছা রূপক রচনায়। প্রথমটিতে আধ্যাত্মিক অনুভূতির বাত্ময় প্রকাশ, কিন্তু দ্বিতীয়টিতে নৈতিক উদ্দেশ্যের সৌন্দর্যময় ছদ্মবেশ। সাঙ্কেতিক রীতিতে অপ্রকাশ্য শেষ পর্যন্ত অপ্রকাশ্যই থাকিয়া যায়, কিন্তু রূপক রীতিতে অপ্রকাশিত 'ভিন্নরূপে প্রকাশিত হয় মাত্র।' রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলির স্বরূপ বিচারে বিশেষজ্ঞগণও মতভেদের দ্বারা আক্রান্ত। ডঃ নীহাররঞ্জন রায়, ডঃ সুবােধচন্দ্র সেনগুপ্ত, অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী প্রভৃতি বিদগ্ধ পণ্ডিতগণও এ বিষয়ে ভিন্নমত পােষণ করেন। ডঃ রায় 'রূপক' ও ‘সাঙ্কেতিক’-এর মধ্যে কোন পার্থক্য বিধান করেন নি, ডঃ সেনগুপ্তের মতে রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলি প্রধানতঃ ‘সাঙ্কেতিক’, তবে ‘রূপকে’র স্পর্শ আছে, আর অধ্যাপক বিশী এগুলিকে 'তত্ত্বনাট্য' নামে অভিহিত করে মতানৈক্যের দায় এড়িয়ে গেছেন। যাহােক্, রবীন্দ্রনাথের এই পর্যায়ের অধিকাংশ নাটকেই রূপক ও সাংকেতিকতা মিশ্রিতভাবে পাওয়া যায়। কবি তার রূপক সাংকেতিক নাটকগুলােতে ঘটনার সুস্পষ্ট ধারাবাহিকতায় চরিত্রসৃষ্টির প্রচলিত নাট্যরীতি অনুসরণের পরিবর্তে গভীরতম সত্যোপলব্ধিতে তত্ত্বভাবনাকে আভাষে, ইঙ্গিতে ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত করে তুলতে চেয়েছেন। দৃশ্যবিন্যাসে, আবহে, পাত্র-পাত্রীদের অর্থগৃঢ় সংলাপে অমূর্ত ভাবই ব্যঞ্জিত হয় এবং তা-ই এই জাতীয় নাটকের বস্তুদেহকে নিয়ন্ত্রিত ও নিরুপিত করে।


বৌদ্ধ 'কুশজাতকে'র কাহিনী-অবলম্বনে রচিত 'রাজা' (১৯১০) এবং তার রূপান্তরিত সংস্করণ 'অরূপরতন' (১৯২০) কবির শ্রেষ্ঠ সাঙ্কেতিক নাটকগুলাের অন্যতম। 'রাজা'র নায়িকা সুদর্শনা নিজের অন্ধ মােহে অন্ধকারের রাজা, এই সৃষ্টি-রহস্যের আধার মূল শক্তিকে প্রত্যক্ষরূপে, স্বকীয় আসক্তির সীমায় দেখতে চেয়েছিল; অবশেষে দুঃখবিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে অন্তর্দৃষ্টি উন্মীলিত হলে রাজাকে সে নিজের দুঃখম্নাত অন্তরের মধ্যে পেল। 'ডাকঘরে'-ও (১৯৩২) আমরা ঈশ্বরের অসীম, অনন্তের উদ্দেশ্যে মানবাত্মার বেদনাময় অভিসারকে দেখি- "এক মৃত্যুপথযাত্রী বালকের মুক্তিপিপাসা, ভগবানপ্রেরিত চিঠি পাওয়া সম্বন্ধে তাহার নিশ্চিত বিশ্বাস, মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে চিকিৎসার নানা বাধা-নিষেধ-মুক্ত, অবারিত স্বাধীনতায় তাহার ভগবৎ-সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি, ডাকঘরের রূপক-আবরণ রচনা করিয়াছে।" রবীন্দ্রনাথের রূপক-সাংকেতিক নাটকের ওপর স্ত্রীগুবার্গ, মেটারলিংক প্রভৃতি ইয়ােরােপীয় নাট্যকারদের প্রতীক নাটকগুলির প্রভাবের কথা বলা হয়। প্রভাব যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা যৎসামান্য, ভারতবর্ষের কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভায় ভারতীয় অধ্যাত্মসাধনার পটভূমিতে সাংকেতিক নাটকের যে রূপ রচনা করেছেন, সেটি সম্পূর্ণরূপেই তার নিজস্ব মৌলিক সৃষ্টি। 'রাজা' ও 'ডাকঘর' দুটি নাটকের একজন রাজাকে বার বার উল্লিখিত হতে দেখি, প্রথম নাটকটির নায়িকা সুদর্শনা রাজাকে প্রত্যক্ষরূপে পাবার জন্য সতৃষ্ণ হয়ে ওঠে, আর দ্বিতীয়টির মুখ্য চরিত্র অমল রাজার কাছ থেকে চিঠি পাবার জন্য প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু কোনাে নাটকেই রাজাকে মঞ্চে শরীরিরূপে আবির্ভূত হতে দেখা যায় না। নাটকের আবহে এই সত্যই ব্যঞ্জিত হয় যে বিশ্বের অন্তরালে যে শক্তি বিরাজমান, তাঁকে ঈশ্বর বা অন্য যে কোনও নাম বা রূপ দেওয়া হােক, কোনাে নাম বা রূপের মধ্যে তাকে পাওয়া যায় না, তাকে পেতে হয় অন্তরের মধ্যে। দুটি নাটকে এই সত্য বিভিন্নভাবে রূপায়িত হয়েছে। 'ডাকঘর' প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি গাঢ়বদ্ধ গীতিকবিতার মত, বস্তুজগতের স্থূলতাবর্জিত, প্রতিটি সংলাপে চেতনার গভীরতম অনুভূতিগুলি সার্থকভাবেই ব্যঞ্জিত।


'মুক্তধারা' (১৯২৫) এবং 'রক্তকরবী'তে (১৯২৩) কবি আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার সংকট এবং সেই সংকট থেকে মানবমনের মুক্তিকে রূপায়িত করেছেন। মানুষ তার বিজ্ঞান-সাধনার শক্তিতে মানবকল্যাণের জন্য যে যন্ত্রকে উদ্ভাবন করেছে, সাম্রাজ্যবাদ তাকেই আয়ত্ত করে তারই সাহায্যে মানুষের তৃষ্ণার জল রােধ করবার অপপ্রয়াসে মত্ত হয়, রাজকুমার অভিজিৎ নিজের প্রাণকে বলি দিয়ে ঝর্ণার যান্ত্রিক বাধকে ভেঙ্গে দিয়ে যন্ত্রের অপেক্ষা মানুষ ও মানুষের শুভবুদ্ধিই যে বড় সেই সত্যের ইঙ্গিতকে স্পর্শ করে। এই কাহিনীর মধ্যে আধুনিক সভ্যতার ইতিহাস যান্ত্রিক শক্তিতে শক্তিমান ইউরােপীয় জাতি কর্তৃক দুর্বল জাতির স্বাধীনতা হরণের ঘটনাই আভাসিত। 'মুক্তধারা’র রূপক বিশেষ সার্থক হতে পারেনি। তার তুলনায় 'রক্তকরবী'র সাংকেতিক তাৎপর্য অনেক সার্থকভাবে অভিব্যঞ্জিত। আধুনিক বাণিজ্যিক সভ্যতার লােভ, ক্ষুধা, বঞ্চনা, নিষ্ফলতার যন্ত্রণা এবং আত্মবিড়ম্বনার পটে মানবাত্মার সত্য-অন্বেষণই এই নাটকটির রূপকের মধ্যে চিত্রিত হয়েছে। ‘রক্তকরবী’র যক্ষপুরীর লৌহজালের অন্তরালস্থিত রাজা নিজের প্রচণ্ড শক্তির ব্যর্থতায় নিজেই যন্ত্রণাজর্জরিত -তার সৃষ্টিক্ষমতা, শক্তি ও ঐশ্বর্য কেবল বস্তুপিণ্ডের সঞ্চয়েই বিড়ম্বিত। ধনতান্ত্রিক সমাজের যান্ত্রিক ও মনুষ্যত্ববিনাশী শােষণে সম্পদ-আহরণের ব্যবস্থায় ব্যক্তি হিশেবে কারাে কোনও স্বতন্ত্র মূল্য নেই, প্রতিটি মানুষের ভূমিকা সুনির্দিষ্ট। 'রক্তকরবী'র নায়িকা কঙ্কণপরিহিত প্রাণময় সত্তার প্রতীক নন্দিনী যক্ষপুরীর অতৃপ্ত, কলুষিত, সংঘর্ষপীড়িত, স্বাভাবিক ও নির্মল আত্মবিকাশ, বঞ্চিত জগতে অবারিত প্রাণের ঐশ্বর্যকে বহন করে আনে, রাজাও নিজের জীবনের ব্যর্থতার আবর্জনা থেকে মুক্তি পেয়ে ঐশ্বর্য ও শক্তির বাধাকে নিজ হাতে চূর্ণ করে প্রেমের উপলব্ধি করে ধন্য হলেন। নন্দিনীর দয়িত, যৌবনশক্তির প্রতীক রঞ্জনের মৃত্যুতেই এই পরিণতি সম্ভব হয়। যৌবনকে হত্যা করে রাজা যৌবনের ও প্রেমের মূল্য উপলব্ধি করেছে। পৃথিবীব্যাপী ধনতান্ত্রিক সমাজের নিষ্ঠুর শােষণব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে ব্যক্তি-মানুষের মুক্তির সংগ্রামের বাস্তব সত্যকেই কবি ‘রক্তকরবী’র রূপকাকারে ফুটিয়ে তুলেছেন। 'শারদোৎসব' (১৯২৪) এবং 'ফাল্গুনী' (১৯১৬) সাংকেতিক নাটকের পর্যায়ভুক্ত হলেও স্বতন্ত্র ধরনের রচনা। নাটকীয় সংঘাতবর্জিত এই রচনাগুলােতে অবকাশের ঋতু শরৎ এবং যৌবনের ঋতু বসন্তের সৌন্দর্য ও ভাবব্যঞ্জনাকে ক্ষীণসূত্রসংবলিত সঙ্গীত-মালায় প্রকাশ করা হয়েছে। 'অচলায়তন'-এ (১৯১২) কবি ধর্মীয় প্রথা এবং তৎসম্পর্কিত আচরণের অমানুষিকতা উদ্ঘাটিত করতে চেয়েছেন। "আচরণই ধর্ম নহে, বাহিকতায় অন্তরের ক্ষুধা মেটে না, এবং নিরর্থক অনুষ্ঠান মুক্তির পথ নহে, তাহা বন্ধন" -এই ভাবসত্যই নাটকটিতে রুপকায়িত। দেশে যে পুঞ্জীভূত সংস্কারের জড়তা মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে চলেছিল, তাকে সচেতনভাবে আঘাত করার উদ্দেশ্য নিয়েই রবীন্দ্রনাথ এই নাটকটি রচনা করেছিলেন। কিন্তু এখানে অতিরিক্ত উদ্দেশ্যপরায়ণতায় রূপকের আবরণ কিছুটা পরিমাণে স্থূল ও প্রকট হয়ে পড়েছে—গভীর, সূক্ষ্ম ইঙ্গিতময়তার সৌন্দর্য তত ফোটে নি।


রূপক-সাঙ্কেতিক তথা তত্ত্বনাটকের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য-বিষয়ে অবহিত হওয়া প্রয়ােজন। এ জাতীয় নাটক শুধু প্রকৃতিগত দিক থেকেই নয়, বহিরঙ্গের বিচারেও অপর সকল নাটক থেকে পৃথক। তত্ত্বনাটকে ক্রিয়াবিরলতাও অপর একটি বিশিষ্ট লক্ষণ বহিঃসংঘাতের স্বল্পতা এবং গীতিধর্মের প্রবলতা শুধু রবীন্দ্রনাথের তত্ত্নাটকেই নয়, ইংরেজি সাহিত্যে সাঙ্কেতিক নাট্য আন্দোলনের নেতা ইয়েট্্-এর নাটকেও অনুরূপ লক্ষণের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত নাট্যতত্ত্ববিশারদ A. Nicoll. সাঙ্কেতিক নাটকের ভাষা-ব্যবহারও বিশিষ্টতাযুক্ত। রবীন্দ্রনাথের নাটকেও তার পরিচয় পাওয়া যায়।


অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, "সাঙ্কেতিক নাটকের ভাষা অনেক সময় দুর্বোধ্য বলে মনে হয়, কারণ ভাষা বা বর্ণনাভঙ্গির সহায়তায় কোন গৃঢ় বিষয়কে প্রকাশ করা যায় না; তাই ভাষার সাধারণ অর্থকে অতিক্রম করে একটা বিশেষ অর্থ আবিষ্কার করতে না পারলে সাঙ্কেতিক নাটকের মর্মোদ্ঘাটন সম্ভবপর নয়। একটা জটিল কুয়াশাচ্ছন্ন রহস্যজাল সাঙ্কেতিক নাটকের ভাষায় ও ভঙ্গিতে বর্তমান থাকে। অনেকে তত্ত্বনাটকে পদ্যরীতি ব্যবহার করেন। গদ্যের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা ও ব্যবহারিক স্থূলতাকে পরিহার করে কবিতার সাহায্যে একটা সুদূর অজানার অস্পষ্ট চেতনা তার মধ্যে সঞ্চার করে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ পূর্ববর্তী বহু নাটকে পদ্যভাষা ব্যবহার করলেও তত্ত্বনাটকে গদ্যভাষাই ব্যবস্থা করেছেন, কিন্তু এই ভাষা যে অতিশয় কাব্যধর্মী, তা যে কোন নিষ্ঠাবান পাঠক-দর্শকের দৃষ্টি এড়ায় না।"


নৃত্যনাট্য ও কৌতুকনাট্য

রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'তাসের দেশ', 'চিত্রাঙ্গদা' (নৃত্যনাট্যের সংস্করণ), 'চণ্ডালিকা', শ্যামা' প্রভৃতি নৃত্যনাট্যে সঙ্গীত ও নৃত্যের মাধ্যমে ভাববস্তুকে রূপায়িত করেছেন। এই নাটকগুলােও রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার সৃজনবৈচিত্র্যের নিদর্শন।


'বৈকুষ্ঠের খাতা', 'চিরকুমার সভা', 'শেষরক্ষা' প্রভৃতি রচনাগুলােতে রবীন্দ্রনাথের কৌতুকনাট্য রচনার দক্ষতা প্রকাশিত হয়েছে। কৌতুককর নাট্য পরিস্থিতি, মানসিক ভারসাম্যহীন খেয়ালী মানুষের স্বভাবগত অসঙ্গতিই রবীন্দ্রনাথের কৌতুক নাট্যের হাস্যসৃষ্টির উপাদান। সমসাময়িক স্থূল, অমার্জিত রঙ্গব্যঙ্গপূর্ণ বাঙলা প্রহসনগুলাের তুলনায় রবীন্দ্রনাথের নাটকের মার্জিত, শুভ্র হাস্যরস এক স্বস্তিদায়ক ব্যতিক্রম।


রবীন্দ্র নাটকের বৈশিষ্ট্য

রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন শ্রেণীর নাটকগুলাের পরিচিতি দানের পর সামগ্রিকভাবে তার এই শিল্পকর্মের মূল্য নিরূপণ করা যেতে পারে। কবির নাটক সম্বন্ধে টন মন্তব্য করেছেন ঃ "His dramatic work is the vehicle of ideas rather than the expression or action." কোনও কোনও সমালােচক রবীন্দ্রনাটকের প্রচলিত নাট্যরীতিসম্মত সংঘাতের স্বভাব, গীতি প্রবণতা, তত্ত্বপ্রাধান্যকে তার ত্রুটিরূপে উপস্থাপিত করতে চান। কিন্তু আধুনিক কালের য়ুরােপীয় নাটকের দৃষ্টান্তেই আমরা জানি, নাটকের নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রচলিত নাট্যরীতির বন্ধনকে স্বীকার করে নেয় নি। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক জীবনের সংশয়-দ্বন্দ্বের পটে ভারতবর্ষীয় সভ্যতার বিশিষ্ট মূল্যবােধ, অধ্যাত্মবিশ্বাসের রূপায়ণের জন্যে নতুন নাট্য-আঙ্গিকের পরীক্ষা করেছেন এবং তাতে বহুলাংশে সফলও হয়েছেন। তার সাংকেতিক নাটকগুলাে আমাদের সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। মেটারলিংক, ইয়েটস, স্ট্রাগুডবার্গ প্রভৃতি বিদেশীয় নাট্যকারদের সাংকেতিক ও কাব্য-নাটকগুলাে তাকে এই জাতীয় নাটক রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল কিনা সে আলােচনায় কোনও লাভ নেই। তার সাংকেতিক নাটকগুলিতে বিদেশি নাটকের প্রত্যক্ষ প্রভাবের কোনও চিহ্ন নেই, বরং তারা তাদের স্বাতন্ত্রেই দেদীপ্যমান। য়ুরােপীয় সাংকেতিক নাটকে দুয়ে রহস্যের প্রাধান্যই আমরা লক্ষ্য করি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নাটকে সকল সংশয় দ্বিধার অবসানে সত্যের জ্যোতির্ময় আবির্ভাব সূচিত হয়েছে। তার ভারতীয় মন য়ুরােপীয় নাটকের সংকেতের রহস্যাবৃত, কুহেলিকাময়, অতীত বিস্ময়ের শিহরণময় জগৎটাকে গ্রহণ করে নি। রবীন্দ্রনাথের সাংকেতিক নাটকগুলো তার প্রতিভার মৌলিকতায় ভাস্বর। এটি সত্য যে কবির সমসাময়িক কালে সাধারণ দর্শক ও শ্রোতা তার মূল ঘটনাড়ম্বরবর্জিত সুরুচির নাটকে গ্রহণ করেন নি। রঙ্গমঞ্চের নাট্যকারেরাও তার পরীক্ষা- নিরীক্ষা থেকে শিক্ষালাভ করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন নি। কিন্তু আধুনিক কালে তার নাটকগুলাের প্রতি নাট্যরসিকদের দৃষ্টি পড়েছে। তার কয়েকটা নাটক মঞ্চে সাফল্য লাভ করেছে। এবং আধুনিক গদ্য নাটকে এবং কাব্য নাটকে, তাদের তীক্ষ্ণ মার্জিত সংলাপে ভাবগত দ্বন্দ্বের বিকাশে, ইঙ্গিতময়তায় রবীন্দ্রনাথের নাটকের প্রভাব দুর্লক্ষ্য নয়। তার নাটকগুলি বাঙলা নাট্যসাহিত্যের নতুন দিগন্তকেই উন্মােচিত করেছে।