রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবােধক উপন্যাসগুলির কালপারম্পর্য রক্ষাপূর্বক আলােচনা করাে।

রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবােধক উপন্যাস


রবীন্দ্রনাথ কৈশােরে ভারতের জাতীয় মহাসভা তথা কংগ্রেসের অধিবেশনে উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছিলেন। তার স্বগৃহে অর্থাৎ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে সমকালে যে স্বদেশী আবহাওয়া বর্তমান ছিল, তাও স্বীকৃত সত্য। তবে রবীন্দ্রনাথ তখনাে পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু ১৯০৫ খ্রীঃ লর্ড কার্জন দেশবাসীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ চালু করায় সারা বাংলায় যে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নেতৃত্ব দান করেন। সমকালে তার রচিত বহুকাব্যে, উপন্যাসে, প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিকতাবােধের ও রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ দেশাত্মবােধক তথা রাজনীতি-সচেতন উপন্যাস রচনা করেছেন মাত্র তিনটি- 'গােরা' (১৯১০), 'ঘরে-বাইরে' (১৯১৬) এবং দীর্ঘ ব্যবধানে ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে 'চার অধ্যায়'। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশিকতাবােধের পরিচয় পাওয়া গেলেও যথার্থ অর্থে এদের 'দেশাত্মবােধক উপন্যাস' না বলে রাজনৈতিক সচেতনতামূলক কিংবা 'সমাজ-সচেতনমূলক' উপন্যাসরূপে অভিহিত করাই সঙ্গত।


বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রথম ধাক্কা থিতিয়ে যাবার পর ১৯১০ খ্রীঃ রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তার প্রথম রাজনৈতিক উপন্যাস 'গােরা'। অবশ্য এটিকে শুধুই এ-নামে অভিহিত করলে উপন্যাসটির প্রতি অবিচারই করা হবে। কারণ 'গােরা' শুধু রবীন্দ্রনাথেরই নয়, বাঙলা ভাষায় রচিত তাবৎ উপন্যাসের মধ্যে মহত্তম সৃষ্টি। এতে রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবােধের পরিচয় কোন দেশে কালে বিধৃত নয়, সমস্ত সীমানা লঙ্ঘন করে। এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাত্মবােধের পরিচয়ই মুদ্রিত রয়েছে। এই উপন্যাস-বিষয়ে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেন, "গােরা' বাঙলা সাহিত্যে আজ পর্যন্ত একমাত্র উপন্যাস যে উপন্যাসে সমগ্র শিক্ষিত বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজের একটি বিশেষ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চিন্তাধারা ও আদর্শ, সমস্ত বিক্ষোভ ও আন্দোলন, ধর্ম ও জাতীয় জীবনের নুতন আদর্শ সন্ধানের সমস্ত ভাবাবেগ ও চিন্তাবিপর্যয়, যুক্তি-তর্কের উত্তপ, অনুভূতির উদ্দীপনা, বুদ্ধি ও বীর্যের দীপ্তি, এককথায় একটি সমগ্র দেশ ও জাতির পুরােগামী, এক শ্রেণীর সমগ্র জীবনধারা রূপ গ্রহণ করিয়াছে। একমাত্র এই উপন্যাসটিতেই বৃহত্তর অর্থে সমসাময়িক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আদর্শের সঙ্গে স্ত্রী ও পুরুষের ব্যক্তিগত সংযােগের অবস্থান লইয়া সার্থক সাহিত্য-সৃষ্টির প্রয়াস দেখিতে পাওয়া যায়। বস্তুতঃ 'গােরা'র প্রসারিত পটভূমি, ইহার সুবিত্তত পরিধি, বিশাল ও গভীর জাতীয় সত্তার তুলনা আজ পর্যন্তও বাঙলা উপন্যাসে খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। এই উপন্যাসের পাত্র- পাত্রীদের ব্যক্তিগত জীবনই ইহাদের একমাত্র পরিচয় নয়; ব্যক্তিগত পরিচয় অতিক্রম করিয়া ইহাদের প্রত্যেকেরই এক একটি বৃহত্তর সত্তা আছে, সে-সত্তা বৃহত্তর সামাজিক ও জাতীয় জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। একান্ত সাম্প্রতিক সাহিত্যে, ইহাই উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য; এই হিসাবেই বর্তমান যুগে উপন্যাসই মহাকাব্যের স্থান অধিকার করিয়াছে। 'গােরা' মহাকাব্যের প্রসার ও গভীরতা লইয়া বাঙলা সাহিত্যের প্রথম এবং আজ পর্যন্ত একমাত্র আধুনিক উপনাস।"


শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ীর পুত্ররূপে পরিচিত গােরা আসলে ছিল এক আইরিশ দম্পতির সন্তান। সে ছিল সুপ্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ভারতাত্মার বাণীমূর্তি ঘটনা-বিপর্যয়ে সে তার আত্মপরিচয় জ্ঞাত হলে তা জাতীয়বােধে পরিণত হয়। উপন্যাসটিতে শুধু গােরা, কৃষ্ণদয়াল বা আনন্দময়ীই নয়, গােরা-রূপ সূর্যের গ্রহরূপে বিরাজ করছে যে সুচরিতা, বিনয় কিংবা ললিতা—প্রত্যেকেই এক একটি উজ্জ্বল জীবন্ত চরিত্র। উপন্যাসে হিন্দু সমাজের সমান্তরালে রয়েছে ব্রাহ্মসমাজ। রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্য উদারতা এবং নিরপেক্ষ মনােভাব নিয়ে সমাজজীবনের বস্তুনিষ্ঠ পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন চরিত্রের কথােপকথন এবং তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মতাদর্শ প্রচারিত হলেও এদের কোনটিই আরােপিত নয়। প্রত্যেকটিই স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতি সম্পন্ন। শুধু বিষয় বা ভাববস্তুর দিক থেকেই নয়, উপন্যাস শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন রূপেও 'গােরা' অসামান্যতা লাভ করেছে।


অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধায় উপন্যাসটি-সম্বন্ধে বলেন, " 'গােরা'- উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস-শিল্পের পূর্ণতা-সম্বন্ধে তাহার যে আদর্শ ছিল তাহাকে সর্বাঙ্গীণ রূপ দিয়াছেন। এই একটি উপন্যাসে তাহার আদর্শ কল্পনা ও উহার নিখুঁত শিল্পরূপায়ণে তাহার মানস-অভীপ্সা ও উহার ঘটনা-ও-চরিত্র-সম্বলিত বস্তুদেহ নির্মাণের মধ্যে এক বিরল সামঞ্জস্য সাধিত হইয়াছে।...এই সমুদ্রগামিনী মহানদীতে পূর্বতন উপন্যাসগুলির ক্ষুদ্রতর ধারাগুলি মিশিয়া ইহাকে যুগজীবনের বিশাল পরিসরের প্রতিবিস্বগ্রাহী বিস্তার ও প্রতিস্পর্ধী গতিবেগ দিয়াছে।"


রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিক মনােভাবের পরিপোষক পরবর্তী উপন্যাসে 'ঘরে-বাইরে রচিত হয়। ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে। এটিকে 'গােরা'র অনুবৃত্তিবূপে গ্রহণ করা হলেও এতে বিষয়গত পরিবর্তন লক্ষিত হয়। কার্জনের ভাঙ্গা বঙ্গ আবার যুক্ত হলেও আন্দোলন স্তিমিত হয় নি, তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হচ্ছিল। এবারের আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলন। কিন্তু স্বদেশসেবীদের একটি ক্ষুদ্র ধারা মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উগ্রপন্থী সন্ত্রাসবাদীদের পথ গ্রহণ করে। এই সন্ত্রাসবাদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের কোন সমর্থন ছিল না, কিন্তু আলােচ্য উপন্যাসটিতে তিনি একজন উগ্র সন্ত্রাসবাদীকেই একটি প্রধান ভূমিকা দান করেছেন। নিখিলেশ ও বিমলা– ভদ্রমার্জিতরুচি, অভিজাত দম্পতির জীবনে ধূমকেতুর মতাে আবির্ভাব ঘটে তীক্ষ্বুদ্ধি বাতুর, সন্ত্রাসবাদী দেশসেবী সন্দীপের। স্বভাবতঃই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল বিমলা। কিন্তু সন্দীপের এই পরিচয়টা ছিল ছদ্মবেশভিতরে সে স্বার্থস্পৃহ এবং নারীমাংসলােলুপ। যাহােক একটা জটিল অবস্থার মধ্য থেকে নিখিলেশ বিমলাকে উদ্ধার করে আনতে পেরেছিল। উপন্যাসের এই তিনটি প্রধান চরিত্রের আত্মকথনের মধ্য দিয়ে সমগ্র কাহিনী বর্ণনা করে রবীন্দ্রনাথ বাঙলা উপন্যাস সাহিত্যে নতুনতর পথের সন্ধান দিলেন। চরিত্র তিনটির মানসিক দ্বন্দ্ব এবং প্রতিক্রিয়া উপন্যাসটিকে দ্রুতগতি দান করেছে। এই উপন্যাসেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম চলিত ভাষা ব্যবহার করেন। এসব মিলিয়ে 'ঘরে-বাইরে' বাঙলা সাহিত্যে একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসরূপে বিবেচিত হয়।


ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "সৃষ্ট চরিত্রগুলিই একাধারে জীবনঘটনার নায়ক ও ব্যাখ্যাতা-বূপে সংঘাতে বহিঃরুপও মানস প্রতিক্রিয়াগুলি সমন্বিতভাবে উপস্থাপিত করিয়াছে। সুতরাং এই উপন্যাসে বিষয়-সন্নিবেশ ও উহার মর্মবিশ্লেষণ উচ্চতর সৃষ্টিশক্তির পরিচয়বাহী।"


পূর্ববর্তী দুটি দেশাত্মবােধক উপন্যাসেরই অনুকৃত্তিরূপে রচিত হয় রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ উপন্যাস 'চার অধ্যায়' -এটিতেও স্বাদেশিকতা এবং দেশাত্মবােধের বেনামিতে ফুটে উঠেছে সন্ত্রাসবাদের এক বীভৎস রূপচিত্র। উপন্যাস-হিশেবে 'চার অধ্যায়' বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার নয়। ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেন, "সমস্ত বইটিতে দৃশ্য বর্ণনাগুলি বাদ দিলে যাহা বাকি থাকে, তাহা আগাগােড়াই ব্যক্ত হইয়াছে নাটকীয় চরিত্রের সংলাপের ভিতর দিয়া ও ঘটনার সংঘাত, চরিত্রের অভিব্যক্তি, ঘটনার সঙ্গে চরিত্রের দ্বন্দ্ব, চরিত্রগুলির পরিচয় ও ব্যঞ্জনা সমস্তই প্রকাশিত হইয়াছে কথার ভিতর দিয়া, অবিরল অতিশ্রান্ত মুখের কথায়। তা ছাড়া মেলােড্রামার স্পর্শও সুস্পষ্ট।  আখ্যানবস্তুতেও রােম্যান্টিক নাটকীয় উপাদান প্রচুর। কিন্তু লিরিক প্রকৃতি ও আকৃতি এ দুয়ের দ্বন্দ্ব 'চার অধ্যায়ে' র সাহিত্যরস ব্যাহত হইয়াছে।" উপন্যাসের মূল সুরটি গীতিকাব্যের হলেও এর গঠনভঙ্গি নাটকের উপযােগী। এর বিষয়বস্তু এবং কাহিনীর গঠন বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন, "দেশসেবার নামে কীভাবে অতীন্দ্র-এলা স্বকীয় মানবধর্ম বিসর্জন দিতে বাধ্য হলাে, অথচ এলা ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল বৈপ্লবিক কার্যের আহ্বানে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে এর মধ্যে দেখতে পেয়েছিল নীচতা, মিথ্যাচার এবং অবিশ্বাস ও অন্তরের দুর্গতি। তবু এই উপন্যাসের প্রবল আকর্ষণ এলা ও অতীনের প্রেমকাহিনী, তাদের অতিশয় অর্থবহ এবং ব্যঞ্জনাময় সংলাপ এবং তাদের প্রেমের অনিবার্য ট্র্যাজিক পরিণতি।….নরনারীর জীবনের সহজ স্বাভাবিক বিকাশের প্রেরণাই প্রেম, আলােচ্য উপন্যাসে প্রেমের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে, সেটিই 'চার অধ্যায় উপন্যাসের একটি প্রধান প্রমাণ।"