বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে দিগিন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান ও স্থান | নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে দিগিন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব ও দান

নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে দিগিন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা ও অবদান


বাঙলা 'গণনাট্য আন্দোলনে'র সঙ্গে যুক্ত যে তিনটি নাম একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়, তাদের দু'জন বিজন ভট্টাচার্য ও তুলসী লাহিড়ী, অপর নামটিই দিগিন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত দীর্ঘজীবী, এই নয়ের দশকের আরম্ভটিও দেখে গেছেন। তাঁর নাট্যরচনা প্রচেষ্টা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী সাহিত্যাধ্যাপক এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের রসজ্ঞ লেখক ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় সপ্রংশস দৃষ্টিতে বলেছেন : “সাম্প্রতিক নাট্যকারদের মধ্যে যাহারা বাংলা নাটককে ভাব-বিলাসহীন বস্তুবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিতেছেন তাহাদের মধ্যে দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অগ্রণী। যুদ্ধোত্তর বাঙালী জীবনে যে সব প্রশ্ন ও সমস্যার আবর্ত-বিপ্লব দেখা দিয়াছে সেইগুলিই তাহার নাটকের পটভূমিতে বলিষ্ঠ বূপরেখায় অঙ্কিত হইয়াছে। সেজন্য আর্থিক সঙ্কট, শ্রমিক ও মালিক বিরােধ, মেকি জাতীয়তা, সাম্প্রদায়িক ঈর্ষাদ্বন্দ্ব প্রভৃতি অনিবার্যভাবেই তাহার নাটকে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। ....নাটক রচনা তাহার পক্ষে আর্টের বিলাস নহে তাহা দুঃখব্রত সত্যসন্ধিৎসা। পরিবেশ রচনা, বাস্তবানুগ সংলাপপ্রয়ােগ, আবেগ-দ্বন্দ্বের বৈদ্যুতিক চাঞ্চল্য এবং ক্ষিপ্রগতি ঘটনার মধ্য দিয়া তিনি তাঁহার নাটকে সার্থক নাট্যরস সৃষ্টি করিতে সক্ষম হইয়াছেন।”


দিগিন্দ্রচন্দ্রের মধ্যে শৈশব থেকেই ছিল একটা প্রতিবাদী স্বভাব। তাই এ জাতীয় কোন আন্দোলন পেলেই তাতে ঝাপিয়ে পড়তেন, তাই ৩২-এ কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনেও তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। সম্ভবত তার এই স্বভাবই তাঁকে কমুনিস্ট ভাবধারায় উৎসাহী করে তুলেছিল।


শােনা যায় মাত্র ২৩ বৎসর বয়সেই দিগিন্দ্রচন্দ্র 'ভীলবিদ্রোহ' অবলম্বনে একটি এবং ২৫ বৎসর বয়সেই ধর্ষিতা রমণীর সমস্যা ও বিড়ম্বনা নিয়ে অপর একটি নাটকও রচনা করেছিলেন, কিন্তু এ নাটক দুটি আর লােক-লােচনের গোচরে আসেনি।


তার পরিচিত প্রথম নাটক 'অন্তরাল' ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে রচিত হলেও প্রথম অভিনীত হয় '৪৪-এ। নাটকের এক অংশে শ্রমিক-মালিক বিরােধ এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ভিতর দিয়ে মার্ক্সবাদী মতকে জীবনের সঙ্গে যুক্ত করবার প্রচেষ্টা এবং অন্য অংশে কানীন সন্তান ও কুমারী মাতার সমস্যায় লেখকের মানবিকতাবােধ ও সামাজিক ন্যায়নীতি-বােধের প্রতিই আগ্রহ প্রকাশ পায়।


১৯৪৩-এ রচিত 'দীপশিখা' নাটকে একদিকে মন্বন্তরের প্রত্যক্ষ প্রভাবে কৃষক-জীবনের বিপর্যস্ত জীবন ও অন্যদিকে কৃষক-আন্দোলনের সহায়তার সমস্যা-সমাধানের জন্য আন্দোলন। এটিতেও কম্যুনিস্ট প্রভাব বর্তমান।


পরবর্তী নাটক 'তরঙ্গে' একদিকে কৃষক-বিপ্লবের সহিংস আন্দোলন এবং অপর দিকে কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলন—উভয়ের ব্যাপকতা পারস্পরিক বিরােধ এবং মাঝেমধ্যে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্র মিলে মিশে রয়েছে।


'বাস্তুভিটা' (১৯৪৭) নাটকের নায়ক বঙ্গবিভাগ-জাত পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির পরও বাস্তুভিটা এবং জীবিকা সংস্থানের উপায় তার পাঠশালাটিকে আঁকড়ে ধরে পৈতৃক ভদ্রাসনেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। হুজুগে মেতে বাস্তু ত্যাগ করতে চান নি। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে যেখানে দেশভাগ হয়েছে, সেই আগ্রাসী সাম্প্রদায়িক বিরূপতাকে সামনে রেখে তার শেষ পর্যন্ত বাস্তুত্যাগ করতেই হলাে। তার কোন কোন মুসলমান বন্ধু তার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল থাকা সত্ত্বেও সমুদ্রের কালােচ্ছাসের ধাক্কায় বালির বাঁধ আর কতক্ষণ টিকতে পারে?


১৯৪১-এ রচিত 'মােকাবিলা' নাটকে মুখ ঘুরিয়েছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের উপর। বাইরের রাজনৈতিক সংঘাত কীভাবে একটা পরিবারকে সমূহ বিপর্যয়ের মুখে ফেলে কীভাবে তাদের বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছে, তারই বিশ্বস্ত, বিবরণ।


'মশাল' নাটকে (১৯৫৪) মূলত পুঁজিবাদী মিল মালিকদের প্ররােচনা, সাম্প্রদায়িক সমস্যা এবং হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার চিত্র ফুটিয়েছেন। কিন্তু এতে রয়েছে একদেশবর্তিতা—দীর্ঘকাল পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা, অবিশ্বাস, জমিদার শ্রেণী এবং মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার চিত্র অনুপস্থিত।—এগুলি ছাড়াও দিগিন্দ্রচন্দ্র 'জীবনস্রোত'-আদি নাটক এবং অসংখ্য 'একাঙ্কিকা' রচনা করেছিলেন। যেমন—‘বেওয়ারিশ’ (৪৭), 'একাঙ্ক সপ্তক', 'অভিনব একাঙ্কগ্রন্থ', 'পাকাদেখা', 'পুনর্জীবন', 'দাম্পত্য কলহে চৈব', 'সীমান্তের ডাক’ প্রভৃতি।