আধুনিক বাংলা ছােটোগল্পে সুবােধ ঘােষের অসামান্য প্রতিভার মূল্যায়ন | আধুনিক বাংলা ছােটোগল্পে সুবােধ ঘােষের অবদান, প্রতিভা ও ভূমিকা

আধুনিক বাংলা ছােটোগল্পে সুবােধ ঘােষের কৃতিত্ব ও দান


আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের এক অন্যতম উল্লেখযােগ্য নাম সুবােধ ঘােষ। কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি পত্রিকা যুগের কথা সাহিত্যে যে তীব্র বাস্তবজীবন উঠে এল, সেখানে উগ্রতা ছিল। কিন্তু প্রাথমিক পর্বের উগ্রতা ক্রমে কেটে গিয়ে এল বিভূতিভূষণের 'পথের পাঁচালি', এলেন তারাশঙ্কর তার রাঢ় বাংলার বিচিত্র জীবনের চিত্রশালা নিয়ে, এবং এলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় 'প্রাগৈতিহাসিক'-এর মতাে গল্প আর 'পদ্মা নদীর মাঝি' র মতাে উপন্যাস নিয়ে। নবযুগের কথাসাহিত্যের প্রতিশ্রুতি ধ্বনিত হয়েছিল সেই সব গল্প-উপন্যাসে। তেমনি ১৯৪০-এ সুবােধ ঘােষ বাংলা কথাসাহিত্যে আবির্ভূত হলেন 'অযান্ত্রিক' ও 'ফসিল'-এর মতাে দুটি অসাধারণ পরিণত গল্প নিয়ে। বিষয়বস্তু, জীবনভাবনা এবং শিল্পসিদ্ধির ত্রিবেণীসংগম ঘটালেন সুবােধ ঘােষ প্রথম আবির্ভাবেই।


সুবােধ ঘােষের আদি নিবাস ঢাকার বিক্রমপুরে। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে হাজারিবাগে জন্মগ্রহণ করেন। প্রত্নতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, এমন কি সমর-বিদ্যায়ও যথেষ্ট পারদর্শিতা তার ছিল। বাসের কনডাক্টররূপে প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। জীবনে বিচিত্র জীবিকায় তার অভিজ্ঞতা প্রচুর। সার্কাস দলে ক্লাউন হিসাবে কাজ করেছেন, বােম্বাই মিউনিসিপালিটিতে ঝাড়ুদারের কাজ করেছেন, ঠিকাদারের কাজ নিয়ে গেছেন পূর্ব আফ্রিকায়। আবার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়ে কারাবাসও করেছেন।


ফলে সুবােধ ঘােষ ব্যক্তিগত জীবনেই সঞ্চয় করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে দেখেছেন একেবারে নিকট থেকে। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ ভাণ্ডারকেই তিনি পূর্ণ ও সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন তার গল্পে, উপন্যাসে।


১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে আনন্দবাজার পত্রিকায় রবিবাসরীয় বিভাগে যােগদান করে পরে ঐ পত্রিকার সিনিয়র এডিটর এবং সম্পাদকীয় লেখকদের একজন হন। দাঙ্গার সময়ে গান্ধীজি যখন পূর্ববঙ্গে নােয়াখালি ভ্রমণ করেন, সুবােধ ঘােষ তখন তার সঙ্গী ছিলেন। তিনি 'কংগ্রেস সাহিত্য সংঘ'র সদস্য ছিলেন এবং 'জাগে নব ভারতের জনতা'র মত কয়েকটি জনপ্রিয় গান রচনা করেন।


সুবােধ ঘােষ তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে 'অযান্ত্রিক', গল্পটি নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করলেন (১৯৪০)। নিজের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, "লেখক হবার আগে জীবনের আলাে-ছায়া ও অধিকারের অনেক রূপ ও অনেক ঘটনা দেখবার অভিজ্ঞতা আমারও ছিল। শ্মশানের ভয়ানক ধোঁয়ার কুঙ্কুটিকা ও শালবনের মাথার ওপর পূর্ণচাদের জ্যোৎস্না-বিস্তার, দুইই দেখবার অভিজ্ঞতা। পনেরাে বছর বয়সের জীবনে রােজ সকালে এক মাইল পথ হেঁটে উকিলবাবুর বাচ্চা ছেলেদের পড়াতে গিয়ে কঠোর এক সাংসারিক সত্যের স্বাদ পেতে হয়েছে! দশ টাকা মাইনের মাস্টারের একদিনের গরহাজির ক্ষমা করতে পারলেন না বিত্তবান ও সম্রান্ত উকিলবাবু। পাঁচ আনা কেটে রেখে নটাকা এগার আনা দিলেন।"


সমাজের অসঙ্গতি, উচ্চস্তরের মানুষের অন্যায়, অবিচার এবং বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের অসহায় করুণ অবস্থা সুবােধ ঘােষের বিভিন্ন গল্পে আশ্চর্য মিতভাষিতায় তীক্ষ্ণ বিদ্রপে ঝলসে উঠেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ 'সুন্দরম', 'পরশুরামের কুঠা'র গল্প দুটির উল্লেখ করা যায়। 'তিন অধ্যায়', 'চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ' প্রভৃতি গল্পেও তার অসাধারণ সমাজচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।


ছোটোগল্পকার হিসাবে সুবােধ ঘােষের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য উদ্ধৃতিযােগ্য। তিনি লিখেছেন, “ছােটো গল্প লেখকের আবিষ্কারের চক্ষু থাকা চাই—তিনি জীবনের এমন সমস্ত খণ্ডাংশ নির্বাচন করিবেন যাহারা সাধারণত আমাদের দৃষ্টি এড়াইয়া যায়, যাহারা যুগপৎ অপ্রত্যাশিত ও রসসমৃদ্ধ। সুবােধ ঘােষের প্রত্যেক গল্পের ওপরই এই অসাধারণত্বের ছাপ লক্ষিত হয়—ভূগর্ভে প্রােথিত খনিজ সম্পদের ন্যায় তিনি মানবমনের অনেক গােপন, রহস্যাবৃত স্তর, জীবনসংগঠনের অনেক বিচিত্র, অভিনব রেখাচিত্র উদঘাটিত করিয়াছেন। জীবনের বিরলপথিক সীমান্ত প্রদেশ হইতে তিনি কত না মৃদুসৌরভপূর্ণ বনাযফুল চয়ন করিয়াছেন।” (বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা)


বিচিত্র বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প রচনায় সুবােধ ঘােষ অনন্যসাধারণ। তার পরিচয় 'পরশুরামের কুঠার', 'ন তস্খৌ', 'উচলে চড়িনু', 'শক থেরাপী', 'দণ্ডমুণ্ড', 'গােত্রান্তর' প্রভৃতি গল্প পাওয়া যায়। কিন্তু বিষয়-বৈচিত্র্যের চেয়েও পটভূমি রচনায় তিনি অধিকতর কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। কোনো বিশেষ পরিস্থিতি বা মানবমনের সূক্ষ্ম ও প্রায় অলক্ষ্য গােচর আবেগ পরিস্ফুট করতে তার নৈপুণ্য অবিসংবাদী। 'পরশুরামের কুঠার' বা 'ন তস্থৌ' গল্পের রসঘন, আবেগময় রচনায় তিনি অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন।


তার গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে 'ফসিল', 'পরশুরামের কুঠার', 'কিংবদন্তীর দেশে', 'ক্যাকটাস' ইত্যাদি। তার রচিত উপন্যাস 'একটি নমস্কারে', 'গাজব', 'ঝিনুক কুড়িয়ে মুক্তো', 'ত্রিযামা', 'দ্বিরাগমন', 'পুনর্নবা', 'সতর্কিয়া', 'শিউলিবাড়ি', 'শুনবরনারী' 'শ্রেয়সী', 'সুজাতা' ইত্যাদি। ভারতীয় পুরাণ মহাকাব্যের প্রেমকাহিনি অবলম্বনে তার অসাধারণ গল্পগ্রন্থ 'ভারত প্রেমকথা'। এছাড়া ভারতের আদিবাসীদের জীবন ও সমস্যা নিয়ে রচিত সুবােধ ঘাষের প্রবন্ধগ্রন্থ 'ভারতের আদিবাসী'।


১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে একাত্তর বছর বয়সে প্রয়াত হন সুবােধ ঘােষ। বাংলা কথাসাহিত্যকে, বিশেষত ছােটোগল্পকে যে জীবনের উত্তাপ ও শিল্পরূপ তিনি দান করে গেছেন, তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার্য।