বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে স্বর্ণকুমারী দেবীর দান | বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে স্বর্ণকুমারী দেবীর অবদান ও স্থান

বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে স্বর্ণকুমারী দেবীর অবদান ও স্থান


উনবিংশ শতকে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার আলােয় বাংলাদেশের যে ব্যাপক জাগরণ ঘটেছিল, তারই ফলশ্রুতিতে স্ত্রীশিক্ষা প্রসার ও স্ত্রী-স্বাধীনতার কিছুটা বিকাশও আলােক-প্রাপ্ত পরিবারগুলিতে দেখা দিয়েছিল। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাতেও আমরা কয়েকজন মহিলাকে কাব্যচর্চায় নিয়ােজিত দেখেছি। গিরীন্দ্রমােহিনী দাসী, কামিনী রায়, মানকুমারী বসু, স্বর্ণকুমারী দেবী থেকে শুরু করে অনুরূপা দেবী, নিরূপমা দেবী, সীতা দেবী, শান্তা দেবী প্রমুখ কবি ও কথা-সাহিত্যিক বঙ্গ সাহিত্যকে উনবিংশ শতক থেকেই সমৃদ্ধ করেছেন।


রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা ভগিনী স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩০) বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা ছিল বিচিত্রমুখী। উপন্যাস, কবিতা, নাটক, গল্প সাহিত্যের বিচিত্র প্রকরণেই তাঁর পারদর্শিতা সুপ্রমাণিত। সাময়িক পত্র সম্পাদনাতেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর সম্পাদিত 'ভারতী পত্রিকা সমকালে বিশেষ গুরুত্বলাভ করেছিল। অর্থাৎ স্বর্ণকুমারী ছিলেন যথার্থই নবজাগরণ যুগের নারী চেতনার প্রতিমূর্তি।


স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক না হলেও রচনার উৎকর্ষ ও পরিমাণের দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের উনবিংশ শতকে তিনিই শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের মর্যাদা পেতে পারেন অবিতর্কিতভাবে। বাংলা সাহিত্যে মহিলা-ঔপন্যাসিকের সাহিত্য সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর নিজস্ব ভাষা-চিন্তা ও সমাজ ভাবনার বিশিষ্ট পরিচয়টি মহিলা ঔপন্যাসিকের সৃষ্টির মধ্যেই যথার্থভাবে প্রকাশিত হতে পারে। স্বর্ণকুমারীর রচনায় নারীচেতনার এই বিশিষ্ট রূপটি স্পষ্ট হয়ে না উঠলেও তাঁর ঔপন্যাসিক প্রতিভাকে অস্বীকার করা যাবে না।


স্বর্ণকুমারী দেবীর উপন্যাসগুলিকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়—ঐতিহাসিক উপন্যাস ও সামাজিক উপন্যাস। প্রথম শ্রেণীতে রয়েছে তার 'দীপনির্বাণ', 'ফুলের মালা', 'মিবার-রাজ' এবং 'বিদ্রোহ' প্রভৃতি উপন্যাস। তার সামাজিক উপন্যাসগুলি হল 'ছিন্ন মকুল', 'হুগলীর ইমামবাড়ি', ‘স্নেহলতা’ ও 'কাহাকে'।


স্বর্ণকুমারী দেবী ঐতিহাসিক উপন্যাসে যথেষ্ট দক্ষতা দেখাতে পারেন নি। এক্ষেত্রে তার মৌলিকতাও বিশেষ নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের মতাে কল্পনার প্রসার ও আবেগের তীব্র দীপ্তি তিনি আয়ত্ত করতে পারেন নি। ইতিহাসের তথ্যানুবর্তনের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক সত্যরক্ষার ব্যাপারে স্বর্ণকুমারী দেবী রমেশচন্দ্রের দৃষ্টান্তকেই অধিক অনুসরণ করেছেন।


১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত দীপনির্বাণ স্বর্ণকুমারী দেবীর অতি অল্প বয়সের রচনা। চিতাের-রাজের পারিবারিক ইতিহাস ও মহম্মদ ঘােরীর দিল্লী আক্রমণ—এই দুই ঐতিহাসিক কাহিনী-ধারা এই উপন্যাসে মিলিত হয়েছে। ইতিহাসের রূপটিও এখানে বাস্তব-রস-সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া মুসলমান বিজয়ের পূর্বে হিন্দুরাজ্যের আভ্যন্তরীণ অবস্থার কোনাে পূর্ণ বিবরণ এখানে পাওয়া যাবে না। স্বল্প-বয়সের রচনা হওয়ায় সামাজিক রাজনৈতিক বােধের সুক্ষ্রতাও এই উপন্যাসে সঞ্চারিত হতে পারেনি। হিন্দু-পরাজয়ের কারণটি অত্যন্ত স্থূলভাবে পরিবেশিত। সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতা ও পৃথ্বীরাজের উদারতা হিন্দু-পরাজয়ের কারণ হিসেবে এখানে উপস্থাপিত। অপরপক্ষে ভাগ্য, বিশ্বাসঘাতকের সহায়তা, হিন্দুদের সরল বিশ্বাসপ্রবণতাই তাদের যুদ্ধ জয়ের মূল কারণ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। উপন্যাসের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে বৈচিত্র্যহীন দুখানি প্রেম কাহিনী। চরিত্রগুলিও নিত্যস্ত নির্জীব। বয়সগত পরিণতির অভাবে লেখিকা কাহিনী বয়নে, চরিত্র চিত্রণে, ইতিহাস রস সৃষ্টিতে অন্তর্লোক রূপায়ণে আদৌ সার্থক হতে পারেন নি।


'দীপনির্বাণ' উপন্যাস অপেক্ষা 'ফুলের মালা’ উপন্যাসে ঐতিহাসিকতা যথার্থভাবে রক্ষিত হয়েছে। এই উপন্যাসের পটভূমি পাঠান-রাজত্বকাল। তখন সেকেন্দার শাহ দিল্লীর অধীনতা ত্যাগ করে বঙ্গে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। দিনাজপুরের রাজ বংশের সঙ্গে বঙ্গেশ্বরের, অন্যদিকে বঙ্গেশ্বরের পরিবার মধ্যস্থ সংঘাতই উপন্যাসটির বিষয়বস্তু। ঐতিহাসিক তথ্যের যথেষ্ট সমাবেশ থাকলেও উপন্যাসের চরিত্রগুলি প্রায়ই মামুলি ও বিশেষত্বহীন। শক্তি দৃপ্ত অভিমান ও তেজস্বিতা অতিনাটকীয় হলেও অস্বাভাবিক হয় নি। গণেশদেব, যােগিনী, গিয়াসুদ্দিন প্রভৃতি চরিত্রগুলিও স্বাভাবিকতার সীমা কখনাে কখনাে অতিক্রম করলেও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একেবারে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় নি। ফলে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসাবে 'ফুলের মালা' কিছুটা সার্থক।


'মিবার-রাজ' ও 'বিদ্রোহ' উপন্যাস দুটি ভীল ও রাজপুতের জাতিগত বিরােধের বিবরণ। মিবার রাজ উপন্যাসে পার্বত্য ভীলদের রাজভক্তি ও বিশ্বাসপ্রবণতার সঙ্গে প্রথানুগত্য ও বংশগত বৈরিতার চিত্র উপস্থাপিত। উপন্যাসটি ক্ষুদ্রায়তন এবং ঘটনা বিন্যাসও সংক্ষিপ্ত।


'বিদ্রোহ' উপন্যাসে দুইশত বছরের পরবর্তী ঘটনাধারা বিবৃত। ভীল ও রাজপুতের পরস্পর সম্পর্কের সমস্ত জটিলতা সূক্ষ্ম ও ব্যাপকভাবে বর্ণিত হয়েছে এই উপন্যাসে। ভীলদের মাতৃভূমি রাজপুতদের অধিকৃত হওয়ায় ভীলেরা বশ্যতা স্বীকার করলেও বিদ্রোহের ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নি সুপ্ত অবস্থায় তখনও কোথাও কোথাও বিরাজ করছে-উপন্যাসে সেই সুপ্ত বিদ্রোহের ধূমরেখাটি চিত্রিত হয়েছে। এরই মধ্যে ভীল যুবক জুমিয়ার প্রতি রাজপুত রাজার সৌহার্দ্য ও জুমিয়ার পালিতা কন্যা সুহারের প্রতি তার আকর্ষণ রাজ-পরিবারে অসন্তোষ ঘনীভূত করেছে। 'বিদ্রোহ' উপন্যাসটিকেই স্বর্ণকুমারী দেবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলা যায়। রাজসভা, রাজপুত ও ভীলদের সম্পর্ক, ভীলদের গ্রামজীবন, তাদের সরলতা কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও সন্ত্রস্ত অবস্থার চিত্র সু- অঙ্কিত। ট্র্যাজেডির অনিবার্য গতিটিও এই উপন্যাসে নিপুণভাবে বর্ণিত।


সামাজিক নানা বিচার-বিতর্ক ও সামাজিক সম্পর্কের নানা প্রশ্ন স্বর্ণকুমারী দেবীর সামাজিক উপন্যাসগুলিতে পাওয়া যাবে। তৎকালীন সামাজিক উপন্যাস রচয়িতাদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়া অন্যান্য ঔপন্যাসিকদের রচনায় রসরুপের পরিবর্তে ত্ত্বরূপই প্রধান হয়ে উঠেছে। সামাজিক তর্ক ও তত্ত্বের ভারে নিষ্প্রাণতা স্বর্ণকুমারী দেবীর সামাজিক উপন্যাসগুলিরও মূল ত্রুটি।


'হুগলীর ইমামবাড়ী' উপন্যাসে ধর্মতত্ত্ব আলােচনার অতি-বিস্তার গ্রন্থের সরস বাস্তবতাকে গ্রাস করেছে। সন্ন্যাসী তাঁর অতিমানবিক শক্তি নিয়ে বারংবার আবির্ভূত হয়ে গল্পের স্বাভাবিক স্রোতকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছেন। স্বামী-পরিত্যক্তা মুন্নার চরিত্রে করুণ রসের ও নবাব খাঁজাহান খাঁর স্বেচ্ছাচারী মনােভাবের প্রকাশ সার্থক হলেও মূল গল্পের সঙ্গে এদের যােগ সামান্য। ধর্মতত্ত্বের অতি-প্রাদুর্ভাব ও অতি মানবিক শক্তির পুনঃপুনঃ ব্যবহার এই উপন্যাসের প্রধান ত্রুটি। গ্রন্থন প্রণালীও খুব শিথিল। একমাত্র মহম্মদ মহসীন চরিত্রের উন্নত উদারতাই উপন্যাসের মধ্যে কিছুটা ঐক্যবন্ধনের সেতুরুপে কাজ করেছে।


'স্নেহলতা' (১৮৯২) উপন্যাসটিও সমাজ ও ধর্মসংস্কারের তর্ক-বিতর্কে পথ হারিয়েছে। জগৎবাবুর পারিবারিক জীবন গ্রন্থারম্ভে আশার উদ্রেক করলেও তাত্ত্বিক চর্চার প্রাবল্যে সেই পারিবারিক চিত্রের উজ্জ্বলতা কিছু পরেই স্নান হয়ে গেছে। সমাজ সমালোচনা ও মতবাদ প্রচারের প্রাবল্যে এই উপন্যাসটিকেও শিল্পসার্থকতায় উন্নীত হতে দেয় নি।


'কাহাকে' (১৮৯৮) স্বর্ণকুমারী দেবীর সর্বোকৃষ্ট উপন্যাস হিসাবে পরিচিত। এক আধুনিক শিক্ষিতা মহিলার প্রণয়ের ব্যর্থতার ইতিহাস এই উপন্যাসের প্রধান কথাবস্তু। শৈশবকালে নায়িকার ভালােবাসার পাত্র ছিলেন তার পিতা। সময়ান্তরে এক সহপাঠী এসে তার ভালােবাসা আকর্ষণ করে। পিতা ও সহপাঠীর মধ্যে ভালােবাসার অংশভাগ নায়িকার চিত্তকে আন্দোলিত করে। পরে পূর্ণ যৌবনে আত্মীয়গৃহে রমানাথের মধ্যে প্রেমকে আবিষ্কার করেছে নায়িকা। কিন্তু এই অনুরাগই যথার্থ প্রেম কিনা সে বিষয়ে তর্ক উপস্থিত হয়েছে তার নিজেরই অন্তরে। 'কাহাকে' উপন্যাসের বিশেষত্ব যে, এই উপন্যাসটির মধ্যেই নারীর হৃদয়ের সুরটি আদ্যোপান্ত ধরা পড়ে। সামাজিক তর্ক ও তত্ত্ব এখানেও আছে, কিন্তু হৃদয়ের দ্বন্দ্ব ও টানাপােড়েনের রসরপকে তা সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে নি। উপন্যাসের মধ্যে পিতার প্রতি আদরিণী কন্যার মনােভাব বর্ণনায়, রমানাথের প্রতি নবজাগ্রত প্রেমের বিশ্লেষণে, প্রেমভঙ্গের দুঃসহ বেদনা ও নৈরাশ্যের, মিলনের গভীর প্রশাস্তিতে নারী হৃদয়ের সূক্ষ্মতা ও ভাব-প্রবণতার সুন্দর প্রকাশ ঘটেছে। বস্তুত মহিলা ঔপন্যাসিকের বিশিষ্টতায় 'কাহাকে' উপন্যাসটি উজ্জ্বল।


স্বর্ণকুমারী দেবীর ঐতিহাসিক ও সামাজিক উপন্যাসগুলিতে অথবা ছােটোগল্পগুলির মধ্যে মহৎ ও চিরস্থায়ী সাহিত্য-প্রতিভার লক্ষণ না থাকলেও বাংলা সাহিত্যের প্রথম পর্বের মহিলা সাহিত্যিকের উজ্জ্বল গৌরব স্বর্ণকুমারী দেবীর অবশ্য প্রাপ্য।