বাঙলা উপন্যাস-সাহিত্য তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের দান | বাঙলা উপন্যাস-সাহিত্য তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবদান ও স্থান

বাঙলা উপন্যাস-সাহিত্য তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবদান ও স্থান


বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় বাঙালীর সাধারণ প্রাত্যহিক জীবন প্রতিফলিত হয় নি, এইক্ষেত্রে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৪৩-১৮৯১) উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখিয়ে গেছেন। বঙ্কিম যুগে আবির্ভূত হয়েও তিনি রােমান্সের চর্চায় আগ্রহী না হয়ে বাঙালীর গার্হস্থ্য জীবনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন।


ছােট-বড় সুখ-দুঃখের জালবােনা পরিচিত দিনরজনীর সংসারে অতি সাধারণ নরনারীকে অহরহ যে কঠিন রূঢ়তার সম্মুখীন হতে হয় তারই একটা ছােট কাহিনী নিয়ে তারকনাথ 'স্বর্ণলতা' (১৮৭৪) রচনা করেন। এর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে তিনি এর পর আরাে ৪ খানি উপন্যাস রচনা করেন- 'ললিত সৌদামিনী' (১৮৮২), 'হরিষে বিষাদ' (১৮৮৭), 'তিনটি গল্প' (১৮৮৯) এবং 'অদৃষ্ট' (১৮৯২), কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এদের কোনটিই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। ১২৭৯ বঙ্গাব্দে 'জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় 'স্বর্ণলতা' উপন্যাসটি প্রথমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্করণে লেখকের নাম ছিল না, 'শ্ৰীযােগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-কর্তৃক প্রকাশিত' -শুধু এই উল্লেখটুকু ছিল। ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাসের গঠন-বৈশিষ্ট্য সুন্দরভাবে নির্দেশ করেছেন- "এই উপন্যাসে ত্রিবিধ আকর্ষণ সূত্র অনেকটা শিথিল গ্রন্থনে পরস্পর সংযুক্ত হইয়াছে। প্রথম, পারিবারিক জীবনে ভ্রাতৃবিরােধ ও দাম্পত্য সম্পর্কের বিপরীতমুখী প্রকাশ; দ্বিতীয়, পথিক জীবনের বিচিত্র আকস্মিকতা ও উদ্ভট অভিজ্ঞতা; তৃতীয়, অনুকুল দৈবসংঘটনের সহায়ক পাপের শাস্তি ও ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সুতরাং উপন্যাসখানি একদিকে বস্তুধর্মী, অপরদিকে নীতিতে আস্থাশীল ও রােমান্সকৌতুহলী।"


তারকনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের প্রতি তাঁর বিরূপতাকে গােপন রাখতে পারেননি, বস্তুতঃ তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের রােমান্সপ্রীতি এবং অতিকাল্পনিকতার নিন্দা করে তার বিরােধিতায় নিজের স্বাতন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই 'স্বর্ণলতা' রচনা করলেও কিন্তু নিজের রচনায় রােমান্সুলভ আকস্মিক যােগাযােগ ও 'দৈবানুগ্রহভিত্তিক অপ্রত্যাশিত সংঘটন’-কে স্থান দিতে দ্বিধাবােধ করেননি। গােপাল ও স্বর্ণলতার আকস্মিক পরিচয় ও পরস্পরের প্রতি অনুরাগ, শশাঙ্কর স্বর্ণলতাকে জোর করে বিয়ে দেবার চেষ্টা এবং হঠাৎ আগুন লাগায় তার উদ্ধার, শশিভূষণের অবস্থা-বিপর্যয়—এ সমস্তই রােমান্স লক্ষণাক্রান্ত। স্বর্ণলতার উপন্যাসে নামকরণ করা হলেও কাহিনীতে তার কোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই, তার চরিত্রও অপরিস্ফুট। উপন্যাসে সরলারই প্রাধান্য, তাই তার নাট্যরূপ 'সরলা' যথাযথ নাটকেও উপন্যাসের মতাে সরলাই নায়িকারূপে উপস্থাপিত। কাহিনীর পরবর্তী পর্যায়ে স্বর্ণলতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলেও মূল কাহিনীটি সরলাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। সরলার মৃত্যুর পরই স্বর্ণলতা কাহিনীর একটি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। গ্রন্থের নামকরণে এই ত্রুটিটি নাটকে সংশোধিত হয়েছে, বলা চলে।


এই সমস্ত ত্রুটি-সত্ত্বেও 'স্বর্ণলতার' নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও একেবারে উপেক্ষণীয় নয়। "প্রণয়মূলক রােমান্টিক আবেষ্টনের বাহিরে সাংসারিক সুখ-দুঃখময় প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা-পরায়ণ নরনারীকে অহরহ যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হইতে হয় সেরূপ একটি সমস্যা অবলম্বন করিয়া লেখা সর্বপ্রথম বাঙ্গালী গার্হস্থ্য উপন্যাস হইতেছে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'স্বর্ণলতা'। 'বঙ্গাধিপ পরাজয়ে'র মতাে ‘স্বর্ণলতা'ও যথাসম্ভব বঙ্কিম প্রভাববর্জিত, দুইটি উপন্যাসের মধ্যে সাদৃশ্য এই পর্যন্তই" (সুকুমার সেন)। এই উপন্যাসে স্বার্থের সংঘাতে নির্মমতাও চিত্রিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে বাঙালী পাঠক কাব্যের সৌন্দর্যজগতের বিচিত্র ঐশ্বর্য দেখে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছিল, আর ‘স্বর্ণলতা’য় পেল অশ্রুলবরণাক্ত স্নেহমমতায় অভিষিক্ত প্রাত্যহিক বাঙালী জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার স্বাদ। 'স্বর্ণলতা'র চরিত্রগুলি লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতায় সঞ্জীবিত। এর ভাষাও সরল, প্রাঞ্জল। 'স্বর্ণলতা'র ভাষাভঙ্গি সম্বন্ধে ডাঃ সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন, "বঙ্কিমের ভাষাসৌভাগ্য তারকনাথের ছিল না। তবে বঙ্কিমের রচনার মতাে সরসতা এবং কাব্যশ্রী না থাকিলেও স্বর্ণলতার ভাষা সরল, প্রাঞ্জল এবং বর্ণনীয় বিষয়ের বিশেষ উপযােগী। ভাষার আভরণহীনতা বিষয়বস্তুর পক্ষে নিরতিশয় শােভন হইয়াছে।" এই সকল কারণেই উপন্যাসটি তৎকালে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।


শশিভূষণের বৈষয়িকতা ও স্ত্রৈণতা স্বাভাবিকভাবে ফুটেছে। বিধুভূষণের সরল, বিষয়বুদ্ধিহীন, ক্রোধপরায়ণ ও হুজুগমন্ত চরিত্রটিও বাস্তব। শশিভূষণের স্ত্রী প্রমদার কুটিল ও নীচ, বিধুভূষণের স্ত্রী সরলার সরল ও সহিষ্ণু প্রকৃতির আলেখ্য বাস্তব ও জীবন্ত। দাসী শ্যামার আনুগত্য ও স্নেহের চিত্রও বাস্তব। গদাধরচন্দ্রের নির্বুদ্ধিতা স্থূলতা ও অসততার মিশ্রণ যেমন, তেমনি নীলকমলের উৎকেন্দ্রিকতাও স্বাভাবিক বলে মনে হয়। অবশ্য গদাধর উপন্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নীলকমলের সঙ্গে কাহিনীর কোনও সম্পর্ক নেই।


অবশ্য চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ক্রমবিকাশ, গভীর মনস্তত্বিশ্লেষণ, জগৎ ও জীবনমূল্যবােধ স্বর্ণলতায় নেই, তাতে আকস্মিকতার বাহুল্য ও বহির্ঘটনার প্রাধান্য চরিত্রগুলােকে আচ্ছন্ন করেছে, কয়েকটি চরিত্রের সঙ্গে মূল পটভূমির কোনও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বস্তুত প্রথম শ্রেণীর উপন্যাসের মর্যাদা ‘স্বর্ণলতার প্রাপ্য নয়। কিন্তু পরবর্তীকালে গার্হস্থ্য জীবনকে নিয়ে এক বাঙালীর সহজ আবেগ-অনুভূতিকে কেন্দ্র করে যে উপন্যাসধারার সূত্রপাত হল, স্বর্ণলতার লেখক তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ই তার পথিকৃৎ একথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে।