বাংলা কথাসাহিত্যে পরশুরাম-এর অবদান ও স্থান | বাংলা কথাসাহিত্যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের অবদান, প্রতিভা ও ভূমিকা

বাংলা কথাসাহিত্যে পরশুরামের অবদান, প্রতিভা ও ভূমিকা


সমকালে বুদ্ধিজীবীদের অগ্রগণ্য রূপে পরিচিত রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬०) পরশুরাম ছদ্মনামে বাঙলা ভাষায় কতকগুলি উৎকৃষ্ট হাস্যরশাশ্রিত ছােটোগল্প রচনা করেন। কর্মজীবনে তিনি একটি রাসায়নিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন ; বিদ্যাবত্তার জন্য তিনি বহু সম্মানসূচক পুরস্কার লাভ করেছেন; রামায়ণ-মহাভারতের সারাংশ অনুবাদ ও অনেক গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ রচনা করেছেন স্বনামে। তাঁর এই জীবনের সঙ্গে ছােটোগল্পকার ‘পরশুরামের কোনাে সঙ্গতি নেই। বুদ্ধির দীপ্তি ও কৌতুকরসে মণ্ডিত পরশুরামের ছােটোগল্প রবীন্দ্রনাথকেও চমকিত করেছিল।


রবীন্দ্রনাথ তার 'গড্ডালিকা' পাঠান্তে মন্তব্য করেছিলেন, "সহসা ইহার অসামান্যতা দেখিয়া চমক লাগিল।...বইখানি চরিত্র চিত্রশালা।...তিনি মূর্তির পর মূর্তি গড়িয়া তুলিয়াছেন। এমন করিয়া গড়িয়াছে যে মনে হইল ইহাদিগকে চিরকাল জানি।"


১৯২২ খ্রিস্টাব্দে 'পরশুরাম' ছদ্মনামে রাজশেখর তার প্রথম ছােটোগল্প শ্ৰীশ্ৰী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ রচনা করেন। লক্ষ্যণীয়, এই যুগের লেখকদের মধ্যে অনেকের লেখাই যথাসম্ভব যুগের দাবি মিটিয়েই বিস্মৃতির অতলে নিমজ্জিত। কিন্তু পরশুরাম-রচিত বিশুদ্ধ হাস্যরসাত্মক অথচ বুদ্ধিদীপ্ত ছােটোগল্পগুলির আয়ুষ্কাল যুগসীমায় বদ্ধ নয়, তাদের মূল্য একালেও সমভাবেই বর্তমান।


অবশ্য বলা বাহুল্য, তার অনেক গল্পের উপাদানই সমকালের সমাজ-জীবন থেকে গৃহীত ; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তাক্কালিক সমাজজীবনে বহু পরিবর্তন সাধিত হলেও গল্পগুলির মূল্যবােধ কিন্তু একটুও কমে নি। তার কারণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, সমাজের বহিরঙ্গা যে অনুপাতে পরিবর্তিত হয়েছে, সমাজ-মানুষের অন্তরঙ্গ জীবনে তদনুরূপ বিবর্তন দেখা যায়নি। অপর গল্পকারদের দৃষ্টি যেখানে সমাজের বহিরঙ্গকেই উদ্ভাসিত করেছিল, অত্যন্ত চিন্তাশীল বিজ্ঞান ধর্মী বুদ্ধিজীবী গল্পকার পরশুরামের গভীর, অন্তর্ভেদী সুক্ষ্ম দৃষ্টি সেখানে সমাজ-মানুষের মনের গহনে ডুব দিতে সক্ষম ছিল। এই কারণেই গল্পকার পরশুরামের ছােটোগল্পে সমাজ-সমস্যা নয়, মানুষের মনস্তত্ত্বের মূলে পৌছে তার অসঙ্গতিগুলিকে উপনীত করে যে সমস্ত গল্প রচনা করেছেন তাদের কোনাে সম-সাময়িকতা নেই, আছে চিরক্তনতা। তাই সমাজ-বিবর্তনে এদের রসাস্বাদে কোনাে বিঘ্ন ঘটে না, সর্বযুগে, সর্বত্রই এদের অস্বাদ্যমানতা বজায় থাকে। বাঙলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে গল্পগুলির উপযােগিতার আরও একটি বিশেষ কারণ—এই গল্পগুলির কোনাে অনুসৃতি এ কালেও দুর্লভ বলেই এজাতীয় বুদ্ধি ও কৌতুকোদ্দীপ্ত হাস্যরসাত্মক কাহিনির দাবি সমভাবেই বর্তমান।


পরশুরাম রচিত ছােটো গল্পগুলি নিম্নোক্ত গ্রন্থগুলিতে সঙ্কলিত হয়েছে গড্ডালিকা (১৯২৪), 'কজ্জলী' (১৯২৮), 'হনুমানের স্বপ্ন' (১৯৩৭), 'গল্পকল্প’ (১৯৫০), 'ধুস্তরীমায়া' (১৯৫২), 'কৃষ্ণকলি' (১৯৫৩), 'নীল তারা' (১৯৫৬), 'আনন্দীবাঈ' (১৯৫৭) প্রভৃতি। বাঙলা ভাষায় রাজশেখরের পূর্বে এবং সমকালেও কেউ কেউ হাস্যরসাত্মক ছােটোগল্প রচনা করলেও পরশুরাম-রচিত গল্পগুলি ছিল স্বাতন্ত্রে চিহ্নিত। তাঁর এই বিশিষ্টতা-বিষয়ে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "তবে রাজশেখর বসুর পরিমিতিবােধ আরও সূক্ষ্ম ও তাহার অলৌকিক জগতে পদক্ষেপ যদৃচ্ছ নহে, বিশেষ, উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রিত।...তাহার ‘গড্ডালিকা’ ও 'কজ্জলী' এই জাতীয় সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।...রাজশেখর বসুর হাস্যরসের মধ্যে কিন্তু একটা স্বতঃ-উৎসারিত প্রাচুর্য ও অনাবিল বিশুদ্ধি আছে। তাহার রসিকতার প্রবাহ বৃদ্ধির বিপ্রক্রীড়ায় ঘােলাটে হইয়া যায় নাই, সূর্যকরােজ্জ্বল নির্বরের ন্যায় সহজ সাবলীল নৃত্যভঙ্গে হাসির ঝিকমিকি ছড়াইতে ছড়াইতে বহিয়া চলিয়াছে।"


বাংলা কথাসাহিত্যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের অবদান


আধুনিক কবিতা রচনার ক্ষেত্রে যে প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮) যথেষ্ট নতুনত্বের পরিচয় দিয়ে অন্যতম পথিকৃৎ-এর মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন, তিনিই বাঙলা গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রেও আপন স্বাতন্ত্র্যকে সুপ্রতিষ্ঠ করে একালের সাহিত্যের সব্যসাচী-অভিধা লাভের অধিকার অর্জন করেছে। আবার একই সঙ্গে আধুনিকতার মুখপত্র ‘কালিকলমে'র সম্পাদক রূপে আধুনিকতার প্রবর্তনে এবং নব্যলেখক-সৃষ্টিতে অন্যতম প্রধানের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র আধুনিক কবিদের অন্যতম ; তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে 'প্রথমা' (১৯৩২), 'সাগর থেকে ফেরা', 'অথবা কিন্নের', 'কখনাে মেঘ' (১৯৬১) প্রভৃতি। তিনি কবিতা রচনার পূর্বেই ছােটোগল্প রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন।


১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় 'শুধু কেরাণী' এবং 'গােপনচারিণী' রচনার মধ্য দিয়েই তার জয়যাত্রা শুরু। তিনি 'মিছিল' (১৯২৮), 'কুয়াশা' (১৯৩২), 'আগামীকাল', 'অমলতাস' প্রভৃতি উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে বাস্তবজীবনের কিছু বিশ্বাস্য চিত্র তুলে ধরলেও ছােটোগল্পে তিনি জীবনকে আরও গভীরভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন। তার সমকালীন সতীর্থ বুদ্ধদেব বা অচিন্ত্যকুমার প্রভৃতির সঙ্গে একই বলয়ের অন্তর্বর্তী হওয়া সত্ত্বেও প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁদের কাব্যিকতা ও রােম্যান্টিকতা থেকে অনেক দূরে ছিলেন। এর বিষয়ে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "কল্পনাবিলাস ও কাব্যচর্চার লেশমাত্র বাষ্প তাহার গল্পে নাই। একপ্রকার শুষ্ক, আবেগহীন, বুদ্ধিপ্রধান জীবন-সমালােচনা, বাঙালিসুলভ ভাবার্দ্রতার সম্পূর্ণ বর্জন ও আবেগপ্রবণতার কঠোর নিয়ন্ত্রণই তাহার মুখ্য বিশেষত্ব।"


তাঁর ছােটোগল্পের সঙ্কলন-গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে— 'পাক’ (১৯২৬), 'পুতুল ও প্রতিমা', 'মৃত্তিকা', 'বেনামীবন্দর', 'ধূলিধূসর' প্রভৃতি। প্রেমেন্দ্র মিত্র এ সমস্ত ছাড়াও গােয়েন্দা গল্প ('পরাশর বর্মা'), কল্পবিজ্ঞানের গল্প এবং কিশােরদের উপযােগী গল্প-উপন্যাস ('ঘনাদা') রচনায়ও অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।