বৈদিক ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার পার্থক্য | প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বিশিষ্ট লক্ষণ

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বিশিষ্ট লক্ষণ


প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার প্রাচীনতম রূপটি বর্তমান রয়েছে বেদে এবং তার সর্বাধিক প্রচলিত অর্বাচীন রূপ 'লৌকিক সংস্কৃত' ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় রামায়ণ-মহাভারতাদি মহাকাব্য, অষ্টাদশ পুরাণ এবং সংখ্যাতীত কাব্য, নাটক, গদ্য-প্রবন্ধাদি বিভিন্ন গ্রন্থে ও একালে সংস্কৃত ভাষায় রচিত যাবতীয় গ্রন্থাদিতে। প্রায় চার হাজার বছর স্থিতিকালের মধ্যে ভাষার নানা ধরনের পরিবর্তন সাধিত হলেও এতে যে সাধারণ লক্ষণসমূহ বর্তমান রয়েছে নিম্নে তার পরিচয় দেওয়া হলাে।


১। ইন্দো-ঈরানীয় তথা আর্যভাষা থেকে প্রাচীন ভারতীয় আর্য তথা সংস্কৃত ভাষা যখন স্বতন্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে, তখন তাতে স্বরবর্ণের সংখ্যা কিছুটা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। অতি হ্রস্ব ‘অ’ এবং হ্রস্ব ‘এ’, ‘ও’ সংস্কৃতে নেই। ইন্দো-ঈরানীর 'অই' এবং 'অউ’ সংস্কৃত যথাক্রমে দীর্ঘ ‘এ’ এবং দীর্ঘ 'ও' কারে পরিণত হয়।


২। আদি আর্যভাষার কষ্টাশ্রিত ব্যঞ্জন ধ্বনি ছিল তিন প্রকার, সংস্কৃতে তা' মাত্র এক প্রকার রূপে পরিণতি লাভ করে— ক, খ, গ, ঘ, ঙ।


৩। বৈদিক ‘চ’ বর্গের উচ্চারণ ছিল 'তালব্যস্পৃষ্ট ধ্বনি', পরবর্তীকালে লৌকিক সংস্কৃতে তার উচ্চারণ হয় তালুদন্ত্যমূলীয় ‘ঘৃষ্ট’ ধ্বনি। বর্তমানকালেও এটিই প্রচলিত।


৪। আর্যভাষার কয়েকটি ঘৃষ্টধ্বনি (খ, থ, ফ) এবং উষ্মধ্বনি (জ, জ, ঝ, ঝ) সংস্কৃতে বর্জিত হয়েছে।


৫। সম্ভবতঃ দ্রাবিড় ভাষার প্রভাবে সংস্কৃতে মূর্ধন্য ধ্বনির আগম ঘটে-ট, ঠ, ড, ঢ, ণ। এগুলি ঈরানীয় অথবা অপরাপর আর্যভাষায় নেই।


৬। সংস্কৃতে প্রতি বর্গেরই একটি অনুনাসিক ধ্বনি বর্তমান—ঙ, ঞ, ণ, ন, ম।


৭। সংস্কৃতে চারটি উষ্মধ্বনিরই বহু ব্যবহার বর্তমান ছিল, এদের মধ্যে তিনটি শিশ্ধ্বনি শ, ষ, স এবং হ।


৮। বৈদিক যুগে স্বরের (pitch accent) ব্যবহার ছিল আবশ্যক- ফলতঃ বৈদিক সাহিত্য ছিল সঙ্গীতাত্মক; পরবর্তীকালে স্বরের ব্যবহার বিলুপ্ত হয়।


৯। অপশ্রুতি (Ablaut) অর্থাৎ স্বরবর্ণের গুণ, বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ সংস্কৃতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

১০। সংস্কৃতে যুক্ত ব্যঞ্জনের ব্যবহার ছিল যথেষ্ট।


১১। শব্দে ধাতুর অর্থ গােড়ার দিকে মােটামুটি অধিকৃত থাকলেও পরবর্তীকালে অর্থ পরিবর্তন দেখা যায়।


১২। সংস্কৃতে শব্দরূপে ছিল যথেষ্ট বৈচিত্র্য—তিন লিঙ্গ, তিন বচন এবং ৮ প্রকার কারক অনুযায়ী শব্দের রূপভেদ হয়।


১৩। সংস্কৃতে ধাতুরূপেও ছিল অনুরূপ বৈচিত্র্য—উত্তম, মধ্যম ও নাম তিন প্রকার পুরুষ, আত্মনেপদ ও পরস্মৈপদ এই দুই প্রকার ক্রিয়াপদ, কর্তৃবাচ্য, কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্য এবং পাঁচপ্রকার কাল ও পাঁচপ্রকার ভাব (mood) বর্তমান ছিল।


১৪। সাধারণতঃ শব্দ ও ধাতুর আদিতে ব্যবহৃত হলেও উপসর্গের স্বাধীন ব্যবহারও প্রচলিত ছিল।


১৫। সন্ধির ব্যবহার ছিল যথেষ্ট, পরবর্তীকালে তা প্রায় আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায়।


১৬। সমাসেও যথেষ্ট বৈচিত্র্য ছিল।


১৭। কৃৎ প্রত্যয় ও তদ্ধিত প্রত্যয় যাগে শব্দ-সৃষ্টির ছিল যথেচ্ছ ব্যবহার।


১৮। বাক্যে পদবিন্যাসের কোন নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না।


১৯। ছন্দঃপ্রকৃতি ছিল প্রধানতঃ অক্ষরমূলক, পরের দিকে অবশ্য মাত্ৰামূলক ছন্দও প্রচলিত হয়।



বৈদিক ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার পার্থক্য


'প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা' বলতে বৈদিক সংস্কৃত এবং লৌকিক ‘সংস্কৃত’—উভয় ভাষাকেই বােঝালেও এ দুয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আর্যগণ ভারতের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ পাঞ্জাব এবং সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাসকালেই বেদ রচনা করেছিলেন বলে বৈদিক ভাষায় ‘উদীচী’ অর্থাৎ উত্তরাঞ্চলের ভাষার প্রভাব বিদ্যমান। পক্ষান্তরে উত্তর-পশ্চিম ভারতে পাণিনির জন্ম হলেও তিনি পাটলীপুত্রবাসী ছিলেন বলে তার ব্যাকরণে এবং ফলতঃ সংস্কৃত সাহিত্যে মধ্যদেশীয় ভাষার প্রভাবই ছিল অধিকতর। বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষার মধ্যে ব্যাকরণগত পার্থক্যের এটা একটা বড় কারণ।


১। ধ্বনির দিক থেকে বৈদিক এবং সংস্কৃতের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না। মনে হয় বৈদিকে একটা মূর্ধন্য (ল) ধ্বনি ছিল, যা সংস্কৃতে বর্জিত হয়েছে। তৎপরিবর্তে কোথাও 'ল' কোথায় 'ড়' ব্যবহৃত হয়। তাই ঋগবেদের প্রথম ঋকৃটির দু'রকম পাঠ পাওয়া যায়- 'অগ্নিমীলে', 'অগ্নিমীড়ে'।


২। বৈদিকে, বিশেষতঃ ঋগবেদের স্বর (Pitch accent) ছিল অপরিহার্য; স্বরের পরিবর্তনও ঘটতে পারতাে এবং তাতে অনেক সময় অর্থেরও পরিবর্তন ঘটতাে, কিন্তু সংস্কৃতে স্বরের কোন স্থান নেই।


৩। সংস্কৃতে শব্দরূপ যেমন আছে, বৈদিকে তার অতিরিক্ত কিছু পদ ছিল, অন্য বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। বৈদিকে প্রথমা বহুবচনে অতিরিক্ত পদ 'নরাসঃ'।


৪। সংস্কৃতে ভাব (mood) ছিল দু’টি—অনুজ্ঞা (লােট) ও সম্ভাবক বা বিধি (লিঙ); বৈদিকে অতিরিক্ত ভাব-অভিপ্রায় (লিটু) এবং নিবদ্ধ (Injunctive)। সংস্কৃতে নিবদ্ধ ভাবের প্রয়ােগ শুধু একটিমাত্র ক্ষেত্রেই বিহিত ছিল—‘মা’ এই নিষেধার্থক অব্যয়ের যােগে।


৫। বৈদিকে বর্তমান, সামান্য অতীত, সম্পন্ন অতীত এবং ভবিষ্যৎ—এই চার কালের বিভিন্ন ভাবের রূপ হতে পারতাে, কিন্তু সংস্কৃতে শুধু বর্তমান কাল এবং কখনাে কখনাে সামান্য অতীতের ভাবান্তর হয়।


৬। বৈদিকে ক্তাচ-ল্যপ্, তুম-তবৈ, ত্বায়,-ত্বী,-ত্বানম-ত্বীনম প্রভৃতি অসমাপিকা পদের এবং শতৃ-শানচ্ ক্কসু-কানচ্, স্যতৃ-স্যমান প্রভৃতি ক্রিয়াজাত বিশেষণের বহুল প্রয়ােগ ছিল, সংস্কৃতে এই বাহুল্য কমে গিয়ে অল্প কয়েকটিতে পর্যবসিত হয়েছে।


৭। বৈদিকে কয়েকটি উপসর্গের স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র ব্যবহার ছিল, সংস্কৃতে এদের প্রায় সব কটিই শব্দের আগে যুক্ত হয়, শুধু 'আ, অনু, প্রতি' প্রভৃতি কৃচিৎ পরসর্গরূপে অথবা স্বাধীনভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।


৮। বৈদিকে দু’য়ের অধিক পদে সমাস হতাে না, সংস্কৃতে বহুপদী সমাসের ব্যবহার যথেষ্ট।


৯। অতীতকালে সমাপিকা ক্রিয়ার অর্থে 'ক্তবতু' প্রত্যয়ের প্রয়ােগ সংস্কৃতে নতুন এসেছে, বৈদিকে ছিল না।


১০। বৈদিকে ছিল না এমন বহু শব্দ এবং ধাতু সংস্কৃত ভাষায় গৃহীত হয়েছে এবং বৈদিকের বিপুল শব্দভাণ্ডারের একটা বড় অংশ সংস্কৃতে পরিত্যক্ত হয়েছে।