মধ্যযুগের বাঙলা ভাষার লক্ষণ | বাঙলা ভাষার আদি-মধ্যযুগের লক্ষণ

বাঙলা ভাষার আদি-মধ্যযুগের লক্ষণ


বাঙলা ভাষার আদি-মধ্যযুগে যে সকল গ্রন্থ রচিত হয়েছে, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য বড়ুচণ্ডীদাস রচিত 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। এই যুগের অপর সকল গ্রন্থ বহুল পরিমাণে প্রচলিত ছিল বলে যুগে যুগে তাদের ভাষান্তর ঘটায় মূল ভাষারূপের পরিচয় কোন গ্রন্থেই আর পাওয়া যায় না— সর্বত্রই ভাষা বিকৃত হয়ে অনেকটা আধুনিক রূপ লাভ করেছে। একমাত্র 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'ই যে কোন কারণে লােকলােচনের অন্তরালে থাকায় এর ভাষা রয়েছে অনেকটা অবিকৃত। ফলে আদি-মধ্যযুগের বাঙলা ভাষার আলােচনায় এই 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে'র উপরই একান্তভাবে নির্ভর করতে হয়।


ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ আদি-মধ্যযুগে পদের আদি 'অ' এবং 'আ' নির্বিশেষে ব্যবহৃত হতাে বলে, মনে হয় যে তখনাে 'অ'এর প্রকৃত বিবৃত উচ্চারণ হয়তাে বর্তমান ছিল (অতি/আতি, অনন্ত/আনস্ত)। পদের অন্ত্য ‘অ’ উচ্চারিত হতাে তবে পদমধ্যস্থ ‘অ’-এর সংবৃত উচ্চারণও শুরু হয়েছিল (কােখন, নান্দোঘর) হ্রস্ব ও দীর্ঘ উচ্চারণেও কোন প্রভেদ ছিল না। দ্বিস্বর ধ্বনির উচ্চারণ এই আদি-মধ্যযুগেই আরম্ভ হয়েছিল (আউ লাইল)। 'ন' ও ‘ণ’, ‘জ’ ও ‘য’ এবং 'শ', 'ষ' ও 'স'-এর মধ্যে উচ্চারণগত কোন পার্থক্য না থাকায় এগুলি নির্বিচারে ব্যবহৃত হয়েছে। পদ- মধ্যে অল্পপ্রাণ ধ্বনির মহাপ্রাণীভবনের প্রভূত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় (কর্ভো, কথাে)। নাসিকযীভবন- প্রক্রিয়া ঐ যুগেই শুরু হলেও তা আবশ্যিক হয়ে ওঠেনি। উদ্বৃত্ত স্বর কোথাও বর্তমান ছিল, কোথাও সন্ধুচিত হয়েছে, কোথাও বা তৎস্থলে শ্রুতিধ্বনির আগম ঘটেছে (তিয়জ, ছাওয়াল)। আদি-মধ্যযুগে স্বরসঙ্গতির ব্যবহার যথেষ্ট পাওয়া গেলেও (এখুনী), অপিনিহিতির দৃষ্টান্ত কম। শব্দের আদি অক্ষরে শ্বাসাঘাত আদি-মধ্যযুগেই প্রায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে গেছে।


রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ আদি-মধ্যযুগেই বহুবচনের বিভক্তি রূপে ‘রা' যথেষ্ট ব্যবহৃত হলেও বহুত্ববােধক বা সংখ্যাবাচক শব্দের সাহায্যে বহুবচনের প্রয়ােগও অব্যাহত ছিল (আক্মারা, তােহ্ম সব)। প্রাচীন যুগের বিভক্তিই সাধারণভাবে আদি-মধ্যযুগেও বর্তমান ছিল। তির্যক বিভক্তি ‘এ, ঐ’ সম্বন্ধ পদ ছাড়া সর্বত্র ব্যবহৃত হয়েছে। বিভক্তি স্থলে অনুসর্গের ব্যবহার (নামবাচক এবং অসমাপিকা ক্রিয়াবাচক) এই যুগে বৃদ্ধি লাভ করেছে।


আদি-মধ্যযুগে অতীত কালে দু'রকম বিভক্তি চিহ্নই প্রচলিত ছিল—‘ল’-যুক্ত এবং 'ল' বর্জিত ('তাের বাঁশী আহ্মে নাহি পাই' এবং 'চলিলা বড়াই বৃন্দাবনে।')- এই যুগেই নিত্যবৃত্তকাল পূর্ণ অতীত এবং সমাপিকা ক্রিয়ারূপে ব্যবহৃত হতে আরম্ভ করে। যৌগিক ক্রিয়াপদের ব্যবহারও এই যুগেই প্রথম লক্ষ্য করা যায়। 'ইয়া'- যুক্ত সম্পন্ন কালের প্রয়ােগও এই যুগে লক্ষ্য করা যায় (শুনিয়াছ তােহ্মে)। 'ইল’- যুক্ত যৌগিক কালের প্রয়ােগে আঞ্চলিকতার প্রভাব থাকা সম্ভবপর (রহিলছে)।


প্রাণীবাচক শব্দের ক্ষেত্রে বিশেষণে এবং কৃদন্ত অতীতকালের ক্রিয়াপদে 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে'ও স্ত্রীপ্রত্যয়ের যােগ প্রসারিত হয়েছিল (কোঅলী পাতলী বালী, উত্তরলী হয়িলী রাহী)। এই যুগের ভাষায় 'কামান, মজুরি, বাকী’ প্রভৃতি বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করা যায়।