মধ্যভারতীয় আর্যভাষা বিভিন্ন যুগে যেভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে তার পরিচয় | মধ্যভারতীয় আর্যভাষার যুগ-বিভাগসহ সাধারণ লক্ষণসমুহ

মধ্যভারতীয় আর্যভাষার যুগ-বিভাগসহ সাধারণ লক্ষণসমুহ


আনুমানিক খ্রীঃ পূঃ পঞ্চদশ শতকে আর্যগণ ভারতে আগমন করেন। তাঁদের ব্যবহৃত ভাষাকে বলা হয় 'প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা'। এই ভাষারূপ মােটামুটি একই ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছিল খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত। এরপর থেকেই ভাষাদেহে পৃথক লক্ষণসমূহ ফুটে ওঠায় ভাষাকে ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। এর নাম মধ্যভারতীয় আর্যভাষা' (Middle Indo-Aryan Language) -সাধারণ ভাবে এই যুগের ভাষায় অতি প্রচলিত নাম 'প্রাকৃত'। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীষ্টোত্তর দশম শতাব্দী পর্যন্ত প্রবাহিত এই মধ্যভারতীয় আর্যভাষা ‘প্রাকৃত’কে তিন যুগে (একটি ক্রান্তিকালসহ) বিভক্ত করা হয়। (১) আদিস্তর বা প্রাচীন প্রাকৃতের কাল- আনুঃ খ্রীঃ পূঃ ৬০০ অব্দ থেকে অঃ খ্রীঃ পৃঃ ২০০ অব্দ (২) যুগসন্ধিকাল ক্রান্তিকাল আনুঃ খ্ৰীঃ পূঃ ২০০ অব্দ থেকে আঃ ২০০ খ্রীষ্টাব্দ ; (৩) মধ্যস্তর বা সাহিত্যিক প্রাকৃতের কাল—আনুঃ ২০০ খ্রীঃ থেকে ৬০০খ্রীঃ (৪) অন্ত্যন্তর বা অপভ্রংশের কাল—৬০০খ্রীঃ থেকে ১০০০ খ্রীঃ পর্যন্ত। এই তিন যুগের ভাষায় বিস্তর ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কতকগুলি সাধারণ লক্ষণ বর্তমান থাকার এগুলিকেই প্রাকৃতের লক্ষণ বলে গ্রহণ করা হয়।


প্রাকৃতের সাধারণ লক্ষণগুলিকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়-

  • (ক) ধ্বনিগত, 

  • (খ) রূপগত, ও 

  • (গ) পদগত।


(ক) ধ্বনিগত লক্ষণ:


১। প্রাকৃতে ঋ' '৯' 'ঐ' এবং 'ঔ'-কারের ব্যবহার ছিল না। সাধারণতঃ- 'ঋ' স্থলে আর কাল স্বর বা 'র'-যুক্ত স্বর 'এ' এবং 'ঔ' স্থলে 'ও' ব্যবহৃত হতােএটিই সাধারণ নিয়ম, তবে ব্যতিক্রমও ছিল। যথা মৃগ > মগ, মিগ, মুগ, সুগ, বৃক্ষ > রূককখ, লুচ্ছ ব্ৰচ্ছ। ঋষি > ইসি। তৈল-তেল, তেল্ল। পৌর-পাের।


২। প্রাকৃতে 'অয়' >'এ' এবং 'অর' >'ও' হতাে, যথা-কথয়তু > কথেতু! ভবতি > ভােদি।


৩। পদান্তে 'ম'-জাত ও কচিৎ ন্জাত অনুস্বার ছাড়া অপর সকল ব্যঞ্জন লুপ্ত হাতাে। পুত্রাৎ পুত্তা মনস্ সন।


৪। তিনটি শিস্ ধ্বনির মধ্যে মাগধী প্রাকৃতে শুধু 'শ' এবং অন্যত্র শুধু ‘স’ হতাে। যথা শুতনুকা > শেল > সেল্ল।


৫। পদের আদি যুক্তব্যঞ্জন প্রাকৃতে বিশিষ্ট অথবা একক ব্যঞ্জনে পরিণত হয়েছে এবং পদমধ্যে যুগ্মব্যঞ্জনে পরিণতি হয়েছে ও পূর্ববর্তী দীর্ঘস্বর হ্রস্ব হয়েছে। যথা- ত্রীনি> তিনি। কার্য > কজ্জ। স্নান > সিনান। কল্যাণ > কল্লাণ।


৬। স্বরমধ্যবর্তী একক ব্যঞ্জন অল্পপ্রাণ হলে লুপ্ত হয়েছে ও মহাপ্রাণ হলে ‘হ’-কারে পরিণত হয়েছেঃ যথা- শৃগাল > সিআল, মধু > মহু, সখী > সহী, লােক > লােম।


(খ) রূপগত লক্ষণ:


১। পদের অন্তে স্থিত ব্যঞ্জনলােপের ফলে অধিকাংশ ব্যঞ্জনান্ত শব্দই স্বরান্ত শব্দে পরিণত হয়। প্রাকৃতে 'আ'-কারান্ত, ই-কারন্ত প্রভৃতি শব্দরূপ থাকলেও অধিকাংশ শব্দের রূপ হতাে 'অ'-কারান্ত শব্দের মতাে। যথা- কর্মণে>কম্মায়, লতায়াঃ>লতাসস্।


২। প্রাকৃতে দ্বিবচন ছিল না, তৎ-পরিবর্তে বহুবচন ব্যবহৃত হতাে।


৩। প্রাকৃতে শব্দরূপে অনেক সরলতা এসে গেলাে। প্রথমা ও দ্বিতীয়া বহুবচনে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গের রূপে কোন পার্থক্য রইলাে না। পঞ্চমীর একবচনে 'তস' এবং সপ্তমীর একবচনে ‘স্মিন'-এর ব্যবহারে অনেক ব্যাপকতা লাভ করে। এছাড়াও সর্বনামের প্রথমার বহুবচনে 'এ' বিভক্তি দ্বিতীয়ার বহুবচনে এবং তৃতীয়ার 'হি' বিভক্তি চতুর্থী ও পঞ্চমীতেও ব্যবহৃত হতাে।


৪। প্রাকৃতে ধাতুরূপও অনেক সহজ সরল হয়ে গেল। সংস্কৃতের বৈচিত্র্য আর প্রাকৃতে রইলাে না। সংস্কৃতের দশটি গণের মধ্যে শুধু ভাদি-গণই প্রাকৃত অবশিষ্ট রইলাে। প্রাকৃতে আর আত্মনেপদও রইলাে না, সবই পরস্মৈপদে পরিণত হলাে। লিট্ লােপ পেলাে, লঙ্ এবং লুঙ-ও একসঙ্গে মিশে গেল। অসমাপিকা ক্রিয়ার বৈচিত্র্য প্রাকৃতে অনেক কমে গেল, ক্রিয়ার মধ্যে শুধু রইলােবর্তমান কালের নির্দেশক (লট্), অনুজ্ঞা (লােট্), সম্ভাবক (বিধিলিঙ) এবং ভবিষ্যৎকাল (লুট্) অতীত কালের অর্থে সমাপিকা ক্রিয়ারূপে ব্যবহৃত হতাে ‘ক্ত' প্রত্যয়ান্ত (নিষ্ঠান্ত) পদ।


(গ) পদগত লক্ষণ:


১। প্রাকৃতে পদ-গঠন ছিল নাম-মূলক (nominal)।

২। প্রাকৃতে অধিকাংশ বিভক্তিচিহ্ন লুপ্ত হয়ে যাবার ফলে বিভিন্ন শব্দকে অনুসর্গরূপে ব্যবহার করে বিভক্তির-অভাব পূরণ করা হতাে।

৩। বিভক্তিযুক্ত পদের সংখ্যা কমে যাওয়াতে পদস্থাপন রীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলাে।



আর্যভাষার আত্মপ্রকাশ


মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার স্থায়িত্বকাল ছিল মােটামুটি দেড় হাজার বছর—খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীষ্টোত্তর দশম শতক পর্যন্ত। এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে মধ্যভারতীয় আর্যভাষা তথা প্রাকৃত ভাষা তিনটি সুস্পষ্ট স্তরে রূপান্তরিত হয়েছে। 

  • (ক) আদিস্তর বা প্রাচীন প্রাকৃত, 

  • (খ) মধ্যস্তর বা সাহিত্যিক প্রাকৃত এবং 

  • (গ) অন্ত্যস্তর বা অপভ্রংশ ও অবহট্ট।


(ক) আদিস্তরের প্রাচীন প্রাকৃত: আনুমানিক খ্ত্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত এই পর্বের বিস্তৃতি কাল। হীনযানপন্থী বৌদ্ধসম্প্রদায়ের পালিভাষায় লিখিত বিভিন্ন শাস্ত্রে ও সাহিত্যে এবং মহামতি অশােকের অনুশাসন ও সমসাময়িক অপর কিছু কিছু শিলালিপিতে আদিস্তরের প্রাচীন প্রাকৃতের নিদর্শন পাওয়া যায়।


বুদ্ধদেবের নির্দেশেই তার শিষ্যগণ 'সকায় নিরুত্তিয়া' বা নিজস্ব মাতৃভাষায় বুদ্ধদেবের নির্দেশাদি এবং ধর্মীয় বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই ভাষাকে বলা হয় 'পালিভাষা'। এই পালিভাষা কোন সমকালীন কথ্যভাষা না হলেও কোন কথ্য প্রাকৃতের আধারে গঠিত একটি মার্জিত সাহিত্যিক ভাষা। হীনযানপন্থী বৌদ্ধগণ তাদের ধর্মীয় ব্যবহারে এই পালিভাষা ব্যবহার করতেন। জাতকাদি-কাহিনী গ্রন্থে পালিভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে।


পালিভাষা ছাড়া প্রাচীন প্রাকৃতের অপর নিদর্শন পাওয়া যায় বিভিন্ন শিলালিপিতে, এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য

  • (ক) অশােক অনুশাসন, 

  • (খ) খারবেল অনুশাসন 

  • (গ) সুতনুকা প্রত্নলেখ এবং 

  • (ঘ) হেলিওদোরের গরুড়স্তম্ভ-লিপি।।


ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে গিরিগাত্রের স্তম্ভে খােদিত অশােকের অনুশাসনে সমকালীন ভারতে প্রচলিত কিছু আঞ্চলিক ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায়। খ্রীঃ পূঃ তৃতীয় শতকে ভারতবর্ষে প্রাচীন প্রাকৃতে অন্ততঃ নিম্নোক্ত আঞ্চলিক রূপগুলি যে প্রচলিত ছিল, সমকালীন বিভিন্ন শিলালিপি থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ- উত্তর-পশ্চিমা, দক্ষিণ-পশ্চিমা, মধ্যপ্রাচ্য ও প্রাচ্যা। অশােকের গিরি লিপি ও প্রস্তর লিপি (Major Rock Edict ), ক্ষুদ্র গিরি লিপি (Minor Rock Edict), স্তম্ভলিপি (Pillar Inscription) এবং গুহালিপিতে (Cave Inscription) এই কয়টি আঞ্চলিক ভাষারূপের পরিচয় পাওয়া যায়।


খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতকে উড়িষ্যার খারবেল-কৃত যে অনুশাসন পাওয়া যায় তার ভাষার সঙ্গে অশােক-অনুশাসনের প্রাচ্যাভাষার সাদৃশ্য কম, বরং দক্ষিণা-পশ্চিমা ভাষার সঙ্গেই মিল বেশী।


উত্তর প্রদেশের রামগড় পাহাড়ের যােগীরা গুহায় তিন পংক্তির একটি প্রত্নলিপি পাওয়া গেছে


'শুতনুক নাম দেবদশিক্যি। 

তং কময়িথ বলনশেয়ে

দেবদিনে নম লুপদখে।'


অর্থাৎ সুতনুকা নামে দেবদাসী-তাকে কামনা করেছিল বারাণসীবাসী দেবদিগ্ন (দেবদত্ত?) নাম রূপদক্ষ। এটিকে সুতনুকা প্রত্নলিপি নামে অভিহিত করা হয়। এর ভাষাগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে এটিকে বলা হয় 'পূর্বীপ্রাচ্যা'- যার সঙ্গে পরবর্তী কালের 'মাগধী প্রাকৃতে’র যথেষ্ট নিকট সম্বন্ধ রয়েছে।


প্রাচীন প্রাকৃত ছাড়াও এ যুগে 'গাথা ভাষা' নামে একটা মিশ্র ভাষা গড়ে উঠেছিল— মহাযানপন্থী বৌদ্ধগণ সংস্কৃতের সঙ্গে প্রাকৃত মিশিয়ে এই ভাষা (এরই নামান্তর "মিশ্রসংস্কৃত বা বৌদ্ধ সংস্কৃত) সৃষ্টি করে তাদের শাস্ত্রগ্রন্থাদি রচনা করেছিলেন।


(খ) মধ্যস্তরের সাহিত্যিক প্রাকৃতঃ আচার্য সুকুমার সেন খ্রীঃ পূঃ ২০০ অব্দ থেকে খ্রীষ্টোত্তর দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত বিস্তৃত কালকে পৃথক ক্রান্তিকাল বলে স্বীকার না করে এটিকেও মধ্যযুগের অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। ফলতঃ খ্রীঃ পূঃ ২০০ থেকে ৬০০ খ্রীঃ কালকেই আমরা প্রাকৃতের মধ্যস্তর তথা সাহিত্যিক প্রাকৃতে র যুগ বলে অভিহিত করতে পারি। এই স্তরের ভাষাও প্রাচীন প্রাকৃতের বহুধা বিভক্ত ছিল। প্রধানতঃ সংস্কৃত নাটকের বিভিন্ন পাত্র-পাত্রীর মুখে এ জাতীয় প্রাকৃতের নিদর্শন পাওয়া যায় বলেই য়ুরােপীয় ভাষাবিজ্ঞানীরা একে Dramatic Prakrit নামে আখ্যায়িত করেছিলেন—আমরা এটিকেই বলি 'সাহিত্যিক প্রাকৃত'।


প্রাকৃত বৈয়াকরণগণ সাহিত্যিক প্রাকৃতের নিম্নোক্ত শ্রেণীবিভাগ করেছেন—মাহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, মাগধী, অর্ধমাগধী, পৈশাচী ও অপভ্রংশ। এ কালের ভাষাবিজ্ঞানীরা অবশ্য অপভ্রংশকে 'সাহিত্যিক প্রাকৃত' না বলে সর্বপ্রকার প্রাকৃতের শেষ পরিণতি বলে গ্রহণ করে থাকেন।


  • 'মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃত’: বৈয়াকরণগণ মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃতকেই আদর্শ প্রাকৃতরূপে গ্রহণ করলেও এর ব্যবহার শুরু হয়েছিল সম্ভবতঃ অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালেই। সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনতম নাট্যকার অশ্বঘােষের নাটকে অন্যান্য প্রাকৃত থাকলেও মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের ব্যবহার নেই। পরবর্তী সংস্কৃত নাটকে গানের ভাষা মহারাষ্ট্রী। এ ছাড়া মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে বহু স্বাধীন কাব্য-মহাকাব্য-নাটকও রচিত হয়েছে অপর কোন প্রাকৃতের এ সৌভাগ্য হয় নি। সেদিক থেকে সর্বপ্রকার সাহিত্যিক প্রাকৃতের মধ্যে এর গুরুত্বই সর্বাধিক।


  • শৌরসেনী প্রাকৃত: সংস্কৃত নাটকে সাধারণতঃ নারীর মুখের ভাষা শৌরসেনী প্রাকৃত। এই প্রাকৃতটি শূরসেন বা মথুরা অঞ্চলে উদ্ভূত হয়েছিল বলে অনুমান করা চলে। দু' একটি স্থল ছাড়া মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের সঙ্গে এর বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। কারো কারাে মতে শৌরসেনী প্রাকৃত থেকেই মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের উদ্ভব ঘটে। সংস্কৃত ভাষার প্রভাব শৌরসেনী প্রাকৃতেই সর্বাধিক লক্ষিত হয়।


  • মাগধী প্রাকৃত: নাম থেকে অনুমিত হয় যে মাগধী প্রাকৃতের উদ্ভবস্থল মগধ। কিন্তু সংস্কৃত নাটকে ব্যবহৃত মাগধী প্রাকৃত কোন অঞ্চলেরই কথ্যভাষা ছিল না। সংস্কৃত নাটকে সাধারণতঃ অশিক্ষিত নীচ জাতীয় পাত্রের মুখে ব্যবহৃত এই মাগধী প্রাকৃত নাটকে হাস্যরস সৃষ্টির জন্য কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষারূপেই উদ্ভূত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। 'সুতনুকা' প্রত্নলিপিতে যে সকল ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, সেই সমস্ত লক্ষণ মাগধী প্রাকৃতেও উপস্থিত, যথাতিনটি শিস্ধ্বনির মধ্যে শুধু 'শ'-এর ব্যবহার, 'র'-স্থলে 'ল' এবং পদান্তে বিসর্গ-যুক্ত ‘অ’ স্থলে এ ব্যবহার। এ থেকে অনুমান করা চলে যে প্রাচীন প্রাকৃতের পূর্বীপ্রাচ্যাই ক্রমবিবর্তনের ফলে মাগধী প্রাকৃতে রূপান্তরিত হয়েছে। সংস্কৃত নাটকের বাইরে মাগধী প্রাকৃতের কোন ব্যবহার পাওয়া যায় নি। 'চাণ্ডালী’, ‘শাবরী’, শাকারী’ প্রভৃতিকে মাগধী প্রাকৃতের বিভাষা বলে উল্লেখ করেছেন বৈয়াকরণরা।


  • অর্ধমাগধী: জৈন সাধুগণ তাদের ধর্মশাস্ত্রে অর্ধমাগধী প্রাকৃত ব্যবহার করেছেন, এর নামান্তর আর্যপ্রাকৃত বা জৈনপ্রাকৃত। অশ্বঘােষের নাটকে অর্ধমাগধীর ব্যবহার রয়েছে। এই প্রাকৃতে যেমন মাগধীর লক্ষণ বর্তমান, তেমনি রয়েছে শৌরসেনী এবং মাহারাষ্ট্রীরও কিছু কিছু লক্ষণ। ফলতঃ অর্ধমাগধীকে একটি মিশ্রকৃত বলেই গ্রহণ করা চলে। এতে সংস্কৃত ভাষার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এই ভাষায় বহু জৈনগ্রন্থাদি রচিত হয়েছে।


  • পৈশাচী প্রাকৃত: প্রাচীন বৈয়াকরণগণ পৈশাচী প্রাকৃতের নাম উল্লেখ করলেও কার্যতঃ এর কোন ব্যবহার পাওয়া যায় না। তবে গুণাঢ্য পৈশাচী প্রাকৃতেই তাঁর 'বড্ডকহা' (বৃহতকথা) গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে গ্রন্থটির বিলুপ্তির জন্য এই ভাষার নিদর্শন দুর্লভ। কেহ কেহ মনে করেন, পৈশাচী প্রাকৃত মূলতঃ ভারতীয় আর্যভাষার অন্তর্ভুক্ত নয়, এটি দরদীয় ভাষার একটি শাখা। আবার গান্ধারী প্রাকৃতের সঙ্গেও এর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।


  • অপভ্রংশ: প্রত্যেক সাহিত্যিক প্রাকৃতের শেষ পরিণতিই অপভ্রংশ। এটি পৃথক কোন সাহিত্যিক প্রাকৃত নয়। (পরবর্তী আলােচনা দ্রষ্টব্য)


  • অন্ত্যস্তর অপভ্রংশ: প্রাকৃত বৈয়াকরণগণ অন্যতম প্রাকৃত রূপেই অপভ্রংশের কথা উল্লেখ করেছেন এবং 'প্রাকৃত' শব্দটির পূর্বেই পতঞ্জলির মহাভাষ্যে 'অপভ্রংশ' শব্দটিরও উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু একালের ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, প্রতিটি সাহিত্যিক প্রাকৃতেরই অন্ত্যন্তর ছিল তত্তৎ নামীয় অপভ্রংশ। সংস্কৃতে রচিত মহাকবি কালিদাসের ‘বিক্রমাের্বশী’ নাটকেই সর্বপ্রথম অপভ্রংশের ব্যবহার পাওয়া যায়।


প্রাকৃত ব্যাকরণকারগণ নাগরক অপভ্রংশকেই শ্রেষ্ঠ অপভ্রংশরূপে অভিহিত করেছেন এবং ব্রাচড়ক, উপনাগরক, বৈদর্ভী, লাটী, গৌড়ী চক্কা, পাঞ্চালী, সিংহল' প্রভৃতি অপভ্রংশকে বলেছেন ‘বিভাষা’। কার্যতঃ আমরা 'শৌরসেনী' অপভ্রংশেরই সাক্ষাৎ পেয়ে থাকি। সম্ভবতঃ এটিই প্রাকৃত বৈয়াকরণ-কথিত 'নাগরক অপভ্রংশ'। শৌরসেনী-প্রাকৃতের ক্রমবিবর্তনে শৌরসেনী অপভ্রংশের উদ্ভব, এই সূত্র-অবলম্বনে আমরা 'মাগধী অপভ্রংশ' এবং মাহারাষ্ট্ৰী অপভ্রংশের সম্ভাব্যতার কথা অনুমান করে থাকি। কিন্তু বাস্তবে এই সমস্ত অপভ্রংশের কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না।


অপভ্রংশের স্থিতিকাল ৬০০ খ্রীঃ- ১০০० খ্রীঃ, কিন্তু কার্যতঃ দেখা যায়, সংস্কৃত এবং নবােদ্ভূত নব্য ভারতীয় আর্যভাষার প্রতিদ্বন্দ্বীরুপে অপভ্রংশ এবং তার অর্বাচীন রুপ 'অবহটঠ' (>অপভ্রষ্ট) অন্ততঃ চতুর্দশ অথবা পঞ্চদশ শতক অবধি অব্যাহতভাবেই বর্তমান ছিল। নব্যভারতীয় আর্যভাষার একজন প্রধান কবি বিদ্যাপতি 'অবহট্ঠ' ভাষার দু'খানি গ্রন্থও রচনা করেছেন।


অপভ্রংশ/অবহট্ঠ ভাষায় জৈনগণ বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। আবার ধর্মভাবমুক্ত বহু সাহিত্যও এই ভাষাতেই রচিত হয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ও ধনপালের 'ভবিসত্তকহা', আব্দুর রহমানের 'সংনেহর রাসক', চাদ্দ বরদাই-রচিত 'পৃথ্বীরাজ রাসৌ', পিঙ্গলাচার্য-রচিত 'প্রাকৃতপৈঙ্গল' এবং বিদ্যাপতি রচিত 'কীর্তিলতা'।


অবহট্ঠ ভাষা থেকেই 'প্রত্ন নব্য ভারতীয় ভাষা'র মাধ্যমে আনুঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে নব্য ভারতীয় আর্য তথা আধুনিক ভারতবর্ষে প্রচলিত বাঙলা, অসমীয়া, হিন্দী, পাঞ্জাবী, মারাঠি প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষাগুলির উদ্ভব ঘটেছে। লক্ষণীয় এই যে এই সকল নানা ভারতীয় আর্যভাষা যখন আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত, তখনও কিন্তু সমগ্র উত্তর ভারতে সাধুভাষা-রূপে অবহট্ঠ ভাষা প্রচলিত ছিল। এমনকি, একই ব্যক্তি একই সঙ্গে অবহট্ঠ ভাষা এবং নব্য ভারতীয় ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন এমন দৃষ্টান্তও দুর্লভ নয়। সরহপাদ বাঙলা ভাষায় 'চর্যাপদ' রচনা করেছেন, আবার অবহটঠ ভাষায় ‘দোহা’ রচনা করেছেন।