বাংলা নাট্যক্ষেত্রে তুলসী লাহিড়ীর কৃতিত্ব আলােচনা কর।

বাংলা নাট্যক্ষেত্রে তুলসী লাহিড়ীর কৃতিত্ব


১৯৩৯ থেকে ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত একদিকে বিশ্বযুদ্ধের সর্বগ্রাসী প্রভাব, অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ রাষ্ট্র বিপ্লব ভারত তথা বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নিদারুণ বিপর্যয় ঘনীভূত করে তুলেছিল। ফলে বাংলার নাট্যসাহিত্য এই বিশ্ব রাজনীতি ও দেশীয় বিপর্যয়ের দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল অনিবার্যভাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, পঞ্চাশের মন্বন্তর ইত্যাদি অভিজ্ঞতার বেদনা ও বিক্ষোভ বাংলা নাট্য আন্দোলনের দিগন্ত-প্রসারী সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। বিজন ভট্টাচার্য, দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মন্মথ রায়, সলিল সেন, বিধায়ক ভট্টাচার্য ইত্যাদি নাট্যকারগণ এই যুগে বিশেষ মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নাট্যরচনায় ব্রতী হয়েছেন। এ যুগে নাটক আর মধ্যবিত্তের মনােরঞ্জনের উদ্দেশ্যকে সম্বল করে অগ্রসর হয় নি, নাটক হয়ে উঠেছে জীবন পরিবর্তনের হাতিয়ার। এই নাট্য আন্দোলনেরই অন্যতম শক্তিশালী নাট্যকার তুলসী লাহিড়ী।


একধারে নট, নাট্যকার, পরিচালক ও গীতিকার তুলসীদাস লাহিড়ী বাংলা নাট্যসাহিত্যে ও রঙ্গমঞ্চে এক স্মরণীয় নাম। তার শিক্ষা ও পারিবারিক পটভূমিকা, তার আইনজ্ঞান, কৃষিজীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা এবং সেই সঙ্গে যুদ্ধ ও মন্বন্তরের রূঢ় অভিঘাত তার শিল্পী মানসকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করেছিল।


১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে উত্তরবঙ্গের রঙপুর জেলায় এক জমিদার পরিবারে তুলসীদাস লাহিড়ীর জন্ম। শৈশব শিক্ষা সমাপ্ত করে প্রথম যৌবনে তিনি আইন পাশ করে কিছুদিন ওকালতির চেষ্টা করেন। কিছুকাল জমিদারি এলাকায় কৃষিকর্ম পরিচালন কর্মেও তাঁকে নিয়ােজিত থাকতে হয়। বাল্যকাল থেকে একদিকে রবীন্দ্র সাহিত্য, অন্যদিকে সঙ্গীতে তাঁর প্রীতি ছিল। এই জন্যই তার নাটকগুলির বিশেষত্ব একদিকে একাধিক গানের প্রয়ােগ, অন্যদিকে রবীন্দ্র-গান, কবিতার উদ্ধৃতি।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৩৫০-এর মন্বন্তর, সেই সঙ্গে কৃষক জীবনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় তুলসী লাহিড়ীকে এক নবতর উপলব্ধি ও প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে নিয়ে গেছে। এই অভিজ্ঞতারই রূপায়ণ ঘটল 'দুঃখীর ইমান' নাটকে।


'দুঃখীর ইমান' প্রথম অভিনীত হয় শ্রীরঙ্গম নাট্যমঞ্চে ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে। নানা কারণে নাটকটি গণনাট্য সংঘ কর্তৃক অভিনীত হতে পারেনি। শিশির ভাদুড়ীর পরিচালনায় পেশাদার রঙ্গমঞ্চ শ্রীরঙ্গমে অভিনীত হলেও তৎকালীন নাট্যকার ও নাট্য মঞ্চগুলিকে নাটকটি গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' নাটকের সমকালীন ৫০-এর মন্বন্তরের পটভূমিতে রচিত এই নাটকে এ দেশের হিন্দু-মুসলিম কৃষকদের প্রতি এক দৃঢ়প্রত্যয়ী ভালােবাসা উচ্চারিত। বলা হয় 'দুঃখীর ইমান' শুধু দুঃখীদের ইমান নয়, হিন্দু-মুসলিম কৃষকদের প্রতি বাংলার এক অভিজ্ঞ শিল্পীর ইমান।


শ্রী সুধী প্রধান এক তুলনামূলক আলােচনায় লিখেছেন— 'দুঃখীর ইমানের হিন্দু-মুসলিম ক্ষেতমজুর দুজন প্রকৃত সক্রিয় হিরাে; নিজেদের বিবেচনামত চেষ্টায় জীবন পরিবর্তন করে।..বিজন মার্কসবাদ পড়ে যা করতে পারেন নিতুলসীবাবু না পড়ে তাই করেছেন। তুলসীবাবুর মৃত্যুর আগেও...মার্কস-লেনিনের কোন বই পড়েন নি।' [নাট্য আন্দোলন ও নাট্যকার তুলসীদাস লাহিড়ী] অর্থাৎ যুগের প্রভাবে তিনি কৃষকশ্রেণীর দুঃখ-বেদনা বিশ্বাসের দিকটিকে নাটকে তুলে ধরেছেন, কিন্তু তা কোনাে বিশেষ রাজনৈতিক তত্ত্ব বা মতাদর্শ দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল না।


নাটকের নিবেদনে বলা হয়েছে— 'ধনতান্ত্রিক সভ্যতার চরম পরিণতি মন্বন্তরের দিনে এই চিরবঞ্চিত ও অবজ্ঞদের দল, যারা ধনলােভীর লােভের যূপকাষ্ঠে বলি হয়েছিল তাদের ছবি আঁকতেই এই নাটকের সৃষ্টি।' নীতিমূল্যবােধের-ধর্মবােধের সার্বিক অপচয়ের মধ্যেও মনুষ্যত্বের উচ্চগ্রীব ভূমিকাকে দেখাতে কিন্তু নাট্যকার ভেলেননি। তাই ধর্মদাস ও বিলাতির প্রেম নিশ্ছিদ্র অন্ধকারেও তারার মতাে জ্বলে ওঠে। ধর্মদাসের চুরিও হয়ে ওঠে মহৎ। জামালের দুর্ভাগ্যও পিতৃস্নেহের আলােয় গৌরবান্বিত হয়ে ওঠে।


এরপর তুলসী লাহিড়ী 'বহুরূপী' নাট্যদলে যােগ দেন। তার 'পথিক' নাটক দিয়ে বহুরূপীর যাত্রা শুরু ১৯৪৯-এ। কয়লাখনির শ্রমিকদের ধ্বংসের নিচে চাপা পড়ার কাহিনীকে পটভূমি করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালােবাজারী ও ডাকাতদলের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ নাটকটির বিষয়। অর্থাৎ কৃষকদের পরিবর্তে এ নাটকে এল শ্রমিক। তবে শ্রমিক জীবনের সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকায় এ নাটকের ঘটনা সংস্থাপন ও চরিত্র নির্মাণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকি কালিয়ারী বৃত্তান্তটুকু মৌখিক বিবৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আরাে উল্লেখযােগ্য যে, এ নাটকে শ্রমিক চরিত্র এলেও নায়কত্ব লাভ করেছে এক ভবঘুরে মধ্যবিত্ত অসীম। নাটকের সর্বাপেক্ষা দুর্বল চরিত্র এই অসীম। চারিদিকের দুর্বিষহ পরিবেশের মধ্যে তার ধীর ললিত ব্যবহার এবং শ্রমিকদের দিশারী হয়ে ওঠার চেষ্টাটুকু একান্তই অবাস্তব। অসীমের মৃত্যুও ঘটনা ও চরিত্রের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম নয়। সিঙড়া সিঙের উচ্চভাবের সংলাপও চরিত্রের পক্ষে নিতান্ত অসঙ্গত।


গণনাট্য সংঘের সঙ্গে মতাদর্শগত সংযােগ না থাকলেও লােকজীবন, লােকসংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহ তুলসী লাহিড়ীর ছিল। 'দুঃখীর ইমান' নাটকে উত্তরবঙ্গের লােকভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল। প্রান্ত উত্তরবঙ্গের লােকজীবনই 'পথিক' নাটকের পর আবার ফিরে এল 'ছেঁড়া তারে'। এই নাটকটিও বহুরূপী কর্তৃক অভিনীত ১৯৫০-এ। নাটক সম্পর্কে সুধী প্রধানের বক্তব্য—'কৃষক জীবনের সাধারণ সমস্যার সঙ্গে মুসলিম সমাজের তালাকের সমস্যা তিনি যেভাবে এই নাটকে উত্থাপন করেছেন বাংলা সাহিত্যে তার কোনাে তুলনা আছে বলে জানি না।' লােকসংগীত-শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস এই নাটক সম্বন্ধে বলেছেন, ছেড়া তার শ্রেণী সংঘর্ষ নিয়ে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত সংগ্রামটা গৌণ হয়ে যায় এবং মুখ্য হয়ে ওঠে মুসলমানী তালাক প্রথাকে কেন্দ্র করে সামাজিক সমস্যা। নাটকের মূল Climax- ও এখানেই এবং এটাই এ নাটকের মূল দুর্বলতা।


এরপর তুলসী লাহিড়ী বহুরূপী' থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে 'আনন্দম' ও পরে 'রূপকার' নাট্যদলের প্রবর্তন করেন। ক্রান্তি শিল্পী সংঘের মণ্ডপে অভিনীত হয় তুলসী লাহিড়ীর 'বাংলার মাটি' নাটক ১৯৫৩তে। এক বছর পর ১৯৫৪ তেই বাংলা ভাষার জন্য ঢাকার মাটিতে বাঙালীর রক্ত ঝরল। অর্থাৎ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নাট্যকার 'বাংলার মাটি' নাটকের দ্বারা মানুষের শুভেশক্তিকে যথার্থ পথেরই সন্ধান দিয়েছিলেন। 'বাংলার মাটি' মূলত হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার নাটক। নাটকটির সূচনা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের 'বাংলার মাটি বাংলার জল-' ইত্যাদি গানটি দিয়ে। নাটকের নামকরণও রবীন্দ্রনাথের গানটি থেকেই নেওয়া।


তুলসী লাহিড়ীর পরবর্তী নাটক 'ঝড়ের মিলন এবং 'লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার'। 'ঝড়ের মিলন' গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নি। 'লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার' নাটকে তৎকালীন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নীতিহীনতা ও হতাশার জন্ম দিচ্ছিল, তার মধ্য থেকেই আশাবাদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নাটকে এক সমাজকর্মী একটি দুঃস্থকে নাটকে বলেছে- 'দুঃখের পােড় খাওয়া দুঃখীর দল সব তােমার পাশে আছে।...যে দুর্নীতি দুনিয়ায় হাহাকার এনেছে,ঘরে ঘরে সর্বনাশ ছড়িয়েছে.....আজ নতুন করে তাকে নির্মূল করার শপথু নিয়ে, স্নেহ, দয়া, মায়া, মমতা ভরা ঘর গড়ার আশা নিয়ে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে।'


তুলসী লাহিড়ীর একাঙ্ক নাটক 'নাট্যকার' এবং প্রবন্ধ 'নাট্যকারের ধর্ম' উভয়তই নাট্যকারের সামাজিক দায়িত্বকে স্বীকার করেছেন তিনি। 'নাট্যকার একান্ত বলেছেন যারা মনুষ্যত্বের শত্রু, 'তাদের মুখােস খুলে দেওয়া নাট্যকারের ধর্ম'। নিজ নাট্যাদর্শ সম্বন্ধে তুলসী লাহিড়ী 'দুঃখীর ইমান' নাটকের নিবেদন অংশে বলেছিলেন- 'আজও যারা বেঁচে আছে তারা রাত্রির সাধনা করে প্রভাতকে বরণ করে আনবে এই আশায় উন্মুখ হয়ে দিগন্তে চেয়ে আছে, -কবে এ মেকী সভ্যতার দম্ভ দূর হবে -কবে শাসন-সংরক্ষণের নামে হৃদয়হীন শােষণের অবসান হবে কবে মানব সত্য সত্যই হৃদয়ধর্মী হবেসেই আশায়..সাহিত্যিকের ধর্ম রাখতে নাটকে মাষ্টার মহাশয়ের মুখে আশার বাণী দিয়েছি।....মন নিরন্তর প্রশ্ন করছে—তিমির বিনাশন সে আলাে এ জগতে আবার আসবে কি?'


অর্থাৎ, একদিকে আশাবাদ,অন্যদিকে সংশয়—এই দুই-ই তুলসী লাহিড়ীর বৈশিষ্ট্য। সম্ভবত তৎকালীন যুগ লক্ষণই তার মধ্যে অনিবার্যভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কেউ কেউ বাস্তবতার পরিবর্তে তুলসী লাহিড়ীর মধ্যে অতিরিক্ত ভাববাদের প্রকাশ দেখেছেন। এছাড়া গণনাট্য সংঘ বা মার্কসবাদের সঙ্গে সংযােগ তেমন না থাকায় তৎকালীন প্রগতিবাদী গণনাট্যধারার নাট্যকার হিসাবেও অনেকে তাকে স্বীকার করতে চান না। যথার্থই 'দুঃখীর ইমান' ও ‘ছেড়া তার’-এ কৃষককে নায়কত্ব দান করলেও তিনি ভাববাদ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। দীনবন্ধু মিত্র ভদ্রেতর চরিত্রের সংলাপে উপভাষা ব্যবহার করেছিলেন। তুলসী লাহিড়ী কিন্তু উপভাষা ব্যবহারে আরাে অগ্রসর হয়ে ভদ্র-শিক্ষিত চরিত্রের সংলাপেও তা ব্যবহার করেছেন।


তবে প্রগতিশীল নাটক বা গণনাট্যের লক্ষণ যদি এই হয় যে, প্রথমত, শ্রেণী বিভক্ত সমাজে অন্য শিল্প বা সাহিত্য-শাখার মতাে নাটকও শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হবে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধবাজ ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে, মজুতদার-কালােবাজারীর বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করবে এবং তৃতীয়ত, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বহারা মানুষকে সংগঠিত করে জীবন পরিবর্তনের পথ দেখাবে, -তাহলে নিশ্চিতভাবেই তুলসী লাহিড়ী গণনাট্য যুগের এক প্রতিভাধর প্রগতিবাদী নাট্যকার।