বাংলা উপন্যাস ও ছােটোগল্পে সমরেশ বসুর অবদান, প্রতিভা ও ভূমিকা | বাংলা উপন্যাস ও ছােটোগল্পে সমরেশ বসুর কৃতিত্ব ও দান

বাংলা উপন্যাস ও ছােটোগল্পে সমরেশ বসু এক অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর কথাসাহিত্যের আলােচনা প্রসঙ্গে তার প্রতিভার পরিচয় দাও।


বাংলা উপন্যাস ও ছােটোগল্পে সমরেশ বসুর অবদান ও স্থান


সাম্প্রতিক কালের বাংলা সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী সমরেশ বসু। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে বাংলা কথাসাহিত্যে যে ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব হয়েছিল, তারা বাংলা সাহিত্যকে বঙ্কিম রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের বাইরে এক নবতর শক্তি ও সামর্থ্য দান করেছিলেন সন্দেহ নেই। তবে তার পরবর্তী পর্বে বাংলা সাহিত্যে শক্তি ও সামর্থ্যের বিচারে যথার্থ স্বীকৃতিযােগ্য সাহিত্যফলক হিসাবে সমরেশ বসুর নামটি উঠে আসতেই পারে। তার সাহিত্যসৃষ্টি নিশ্চয়ই ঐতিহ্য বহির্ভূত বা শিকড়বিহীন নয়। কিন্তু সমর্থ শিল্পপ্রতিভার গুণেই তিনি ঐতিহ্যের ভূমিতে দাঁড়িয়েও স্বয়ং এক নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে পেরেছে।


উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়েই সমরেশ বসুর সাহিত্য জগতে অনুপ্রবেশ। সাধারণত ছােটোগল্পের মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যিকেরা আত্মপ্রকাশ করে থাকেন। কেননা ছােটোগল্পের সীমানা ছােটো, ফলে সেখানে সংক্ষিপ্ত বিস্তারে বহু চরিত্র-রচনার দায় নেই বা জীবনের ব্যাপক অর্থসন্ধানের পরিশ্রম নেই। বিন্যাসগত কৌশল আয়ত্ত হবার আগে তাই কথাসাহিত্যিকেরা সাধারণভাবে ছােটোগল্পের জগতকেই আত্মপ্রকাশের যােগ্য মাধ্যম হিসাবে নির্বাচন করেন। কিন্তু সমরেশ বসুর আবির্ভাব যেন পূর্ণ পরিণত প্রতিভা নিয়েই। প্রথম ছােটোগল্প সংকলন প্রকাশের আগেই তাই তার তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হতে দেখি। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় তার একুশ বছর বয়সে লেখা প্রথম উপন্যাসটি। তবে তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'উত্তরঙ্গ'। তাঁর প্রথম ছােটোগল্পের বই যে বছর প্রকাশিত হয়েছে, সেই বছরেই প্রকাশিত হয়েছে তার পূর্ণশক্তির উপন্যাস 'শ্রীমতী কাফে'।


খুব দূরবর্তীকালের নয় বলে এখনও পর্যন্ত তার সৃষ্টি বিষয়ে ব্যাপক চর্চা বা বিশ্লেষণ শুরু হয়নি। তবে একেবারেই হয়নি তা-ও নয়। তাঁর সাহিত্য-কৃতি নিয়ে যতটুকু আলােচনা হয়েছে, তাতে দুটি বিপরীতধর্মী মত প্রকাশিত হয়েছে। একটি হল, সমরেশ বসু যেন স্বয়ঙ্ভ এক সাহিত্যপ্রতিভা। দ্বিতীয়টি হল, বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষিতই তাঁকে নির্মাণ করেছে। কিন্তু যখনই সেই দায়বদ্ধতাকে তিনি অস্বীকার করেছেন, তখনই সাহিত্যধর্ম বা শিল্পধর্ম থেকে তিনি স্বলিত হয়েছেন। তবে আমাদের মনে হয়, সাহিত্যের স্বাভাবিক নিয়মে ঐতিহ্যের ভূমি থেকেই তার উত্থান। সামাজিক অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রণাকর অনুভব তাকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করেছে। অভিজ্ঞতার প্রাচুর্য তাঁর বিশেষ জীবনদর্শনটিকে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াতেই রূপ দিয়েছে। তার অনিঃশেষ সৃষ্টিশীলতাই তাকে প্রথাগত পথের বাইরে পথ খুঁজতে নিরন্তর তাড়িত করেছে। সেই পথসন্ধানে যথার্থ আম-পাঠকের দরবারে তার জনপ্রিয়তার জোয়ার-ভাটা যেমনই হােক, একটা কথা অস্বীকার করার কোনাে উপায় নেই যে, সমরেশ বসু সাহিত্যজীবনের একেবারে সূচনালগ্ন থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত একান্তভাবে নিয়ােজিত থেকেছেন মানবিকতার অনুসন্ধানে।


সাহিত্যজীবনে তিনি উপন্যাস ও ছােটোগল্প-উভয় ক্ষেত্রেই অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় রেখেছেন। উপন্যাস রচনা শুরু করেছেন এক মৃৎশিল্পীকে নিয়ে এবং তার শেষ অসমাপ্ত উপন্যাসও এক ভাস্করকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ শিল্প তথা শিল্পীজীবনকে নিয়েই সমরেশ বসুর সম্পূর্ণ হয়েছে সাহিত্য-বৃত্ত। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রথমে চিত্রশিল্পী হিসাবে কর্মসংস্থানের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি জীবনকে দেখেছেন বিভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে, সঞ্চয় করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। নিজেকে নিয়ে এবং সাহিত্যিক হিসাবেও সারা জীবনে বিতর্ক তৈরি করেছেন প্রচুর। ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে জীবনকে দেখতে চেয়ে নিজের ভিতরেই তৈরি করেছেন আর একটি সত্তা— যার নাম কালকূট।


১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস 'নয়নপুরের মাটি'। অবশ্য আমরা জানতে পারছি যে উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৪৬-এ, অর্থাৎ যখন তাঁর বয়স মাত্র একুশ বছর। মাত্র একুশ বছর বয়সেই উপন্যাস রচনার উপযুক্ত বিন্যাস দক্ষতা তিনি তাঁর সহজাত প্রতিভা থেকেই আয়ত্ত করে নিতে পেরেছিলেন। নয়নপুর গ্রামের এক মৃৎশিল্পীকে নিয়ে রচিত এই উপন্যাস। সমরেশ বসু পরবর্তীকালে বলেছিলেন যে, মাটিই হল এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। এই উপন্যাসের মৃৎশিল্পী মহিম মাটির তাল দিয়ে পরম মমতায় নানা রূপ ফুটিয়ে তােলে জীবনের। ফরমায়েসি কাজে উপার্জনের সম্ভাবনা বেশি থাকলেও সে কাজে সে স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করে না। শিক্ষিত পাগল-শিল্পী গৌরাঙ্গ মহিমকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বড়াে শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত মহিম খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার সব সভাবনাকে ফেলে গ্রামে ফিরে এসেছিল তার নিঃসন্তান বউদি অহল্যার টানে অথবা নয়নপুরের মাটির টানে। এদিকে জমিদারের পুত্রবধূ উমাও মুগ্ধ হয় মহিমের শিল্পে। সেও চায় মহিম কলকাতায় যাক। মহিমকে রাজি করাতে সে এমনকি শরীরী মায়াও বিস্তার করে। কিন্তু জমিদারের প্রস্তাব ও উমার প্রস্তাব উপেক্ষা করে শেষপর্যন্ত গ্রামের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হতে হয় তাকে। সন্তানস্নেহ-বুভুক্ষু বউদি অহল্যাকে একটি মাটির শিশু উপহার দিতে চেয়েছিল মহিম, কিন্তু সে ইচ্ছাও ভেঙে যায় পাইকের অত্যাচারে। অহল্যা মহিমকে জিজ্ঞাসা করে, "চেরকাল মুই পাথরের অহল্যা হইয়ে থাকব?" উত্তরে মহিম বলে, "না, তাতে মুই পরাণ পিতিষ্ঠা করব।"


সমরেশ বসুর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস উত্তরঙ্গ। এই উপন্যাসে সমরেশ নিজের একান্ত পরিচিত জগতের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। 'উত্তরঙ্গ'র পটভূমি নৈহাটি-জগদ্দল-শ্যামনগর অঞ্চল। যদিও পটভূমি স্থাপিত হয়েছে বর্তমানের পরিবর্তে সামন্ততন্ত্রের ভাঙনের যুগে। তখন ইংরেজরা কৃষিজমিতে গড়ে তুলছে কলকারখানা, কৃষক পরিণত হচ্ছে শ্রমিকে। এই উপন্যাসে সমরেশ বসু আরাে পরিণত। এই উপন্যাসের দুর্বলতা যেটুকু, তা আসলে নিহিত এর নায়ক চরিত্রে। নায়ক লখাই বা লক্ষ্মীন্দর সিপাহী বিদ্রোহের এক পলাতক সৈনিক। সে বেঁচে এসেছে তার প্রাণটুকু নিয়ে। ইংরেজের বিরুদ্ধে তার আক্রোশ স্বাভাবিক। কিন্তু যে কখনাে কৃষক ছিল না, তার পক্ষে কৃষিজমি চলে যাবার যন্ত্রণা যথার্থ অনুভব করা সম্ভব ছিল না।


সমরেশ বসুর প্রথম জনপ্রিয় উপন্যাস 'বি টি রােডের ধারে-তে লেখক আরাে পরিণত হয়ে উঠেছেন। পরিবেশ ও চরিত্র-পরিকল্পনাতে বহু পার্থক্য থাকলেও 'উত্তরঙ্গ' উপন্যাসের সঙ্গে এই উপন্যাসের কাহিনি-পরিকল্পনাগত সাদৃশ্য আছে। এখানেও সমরেশের চিরচেনা শিল্পাঞ্চলের বস্তিতে এসে হাজির হয় অজ্ঞাতপরিচয় মানুষ গােবিন্দ। বস্তিজীবনের এক নিখুঁত ছবি এখানে ফুটিয়েছেন লেখক। সেইসঙ্গে এসেছে সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।


'শ্ৰীমতী কাফে' উপন্যাসটি ব্রিটিশ শাসনের শেষ পঁচিশ বছরের কালসীমায় বাংলার অগ্নিগর্ভ পটভূমিতে রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিক্ষোভের এক নির্ভরযােগ্য দলিল হয়ে উঠেছে। এখানে সন্ত্রাসবাদী, গান্ধীবাদী, মার্কসবাদী সমস্ত চরিত্রই আছে রক্তমাংসের মানুষ হিসাবে, তত্ত্ব হিসাবে নয়। সমরেশ দেখিয়েছেন বিভ্রান্তিকর এই সময়ে সব তত্ত্ব, সব মতাদর্শ, সব চরিত্রই বিক্ষত, বিভ্রান্ত।


সমরেশ বসুর আর এক অসামান্য সৃষ্টি 'গঙ্গা' উপন্যাস। ধীবরজীবন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস খুব বেশি না থাকলেও বিষয়টি নতুন নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি' এবং অদ্বৈত মল্লবর্মনের 'তিতাস একটি নদীর নাম' ধীবরজীবনভিত্তিক দুটি বিখ্যাত উপন্যাস। তা সত্ত্বেও গঙ্গানদীর বুকে যারা দারিদ্র্য ও প্রাণ হাতে নিয়ে ইলিশ শিকার করে, তাদের বৃত্তি বিষয়ক খুঁটিনাটি, মাটি-জল-আকাশ নিয়ে ঘেরা মানুষগুলির জীবনের ও জীবিকার জন্য সংগ্রাম, তাদের কামনা, প্রবৃত্তি, প্রেম, মহানুভবতা এক অসামান্য মহাকাব্যিক মাত্রায় ধরা পড়েছে এই উপন্যাসে।


দীর্ঘ সময়কাল ধরে অসংখ্য উপন্যাস লিখেছেন সমরেশ বসু। তার মধ্যে কোনাে কোনাে উপন্যাস অশ্লীলতার অভিযােগেও অভিযুক্ত। বিশেষত উল্লেখ করা যেতে পারে তার 'প্রজাপতি' এবং 'বিবর' উপন্যাসের নাম। পত্রিকার চাহিদা মেটাতে বা আম-পাঠকের গড়ুর-ক্ষুধা নিবারণের জন্য কিংবা নিতান্ত ব্যাবসায়িক কারণে কোনাে কোনাে জনপ্রিয় লেখককে শিল্পের শর্ত লঙ্ঘন করে অশ্লীল বিষয়ের অবতারণা করতে হয় হয়তাে। কিন্তু সমরেশ বসুর মতাে ঔপন্যাসিককেও এই স্থূল চাহিদার কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে—এ তথ্য সহজে স্বীকার করা যায় না। আসলে অশ্লীলতার সংজ্ঞাটাই এখনও যথেষ্ট ধোঁয়াটে। তাছাড়া জীবন ও সমাজচিত্রণের ক্ষেত্রে যাথার্থ্য থাকলে আদিম যৌনজীবনের বর্ণনাকেও সর্বদা অশ্লীল বলা যায় না হয়তা। দেখা দরকার, বর্ণিত বিষয় নিতান্ত অপ্রয়ােজনে এসেছে, না কি নিজ জীবনদর্শনকে প্রতিফলিত করতে সে বর্ণনা অনিবার্য ছিল। কার্যত দেখা যাবে, 'প্রজাপতি' বা 'বিবরে' আমাদের জীবনের গ্লানি ও অসহায়তা প্রকাশের জন্য কিছু বর্ণনা অনিবার্যভাবেই এসেছে। বিশেষত 'বিবর' উপন্যাসে মধ্যবিত্ত মানুষের আপােসপ্রবণতা এবং আত্মস্বার্থের গহ্বরে মনের ক্ষোভ-ক্রোধকে লুকিয়ে ফেলার ক্ষমতাকে যেভাবে তীব্র শ্লেষে বিদ্ধ করা হয়েছে, তা শিল্পের দিক থেকে অসাধারণ। তবে কোনাে কোনাে বর্ণনা অংশ হয়তাে বিস্তারিত করার প্রয়ােজন ততােটা ছিল না। সেক্ষেত্রে ব্যাবসায়িক সাফল্যের কাছে শিল্পী সমরেশের পরাভব ঘটেছে, একথা স্বীকার করতেই হবে। কেননা ঠিক এই বিষয় নিয়ে সমরেশ যখন স্বীকারােকি’ উপন্যাস লেখেন, তখন অশ্লীল প্রসঙ্গা ছাড়াই লেখকের জীবনদর্শন কীভাবে শিল্পিত প্রকাশ লাভ করে, তা আমরা দেখেছি।


সমরেশ বসুর অন্যান্য উল্লেখযােগ্য উপন্যাস 'মহাকালের রথের ঘোড়া', 'কামনা বাসনা', 'গঙ্গা', 'জগদ্দল', 'ছেঁড়া তমসুক', 'তিন ভুবনের পারে', 'পথিক', 'নাটের গুরু', 'পঞ্চবহি', 'কীর্তিনাশিনী', 'আয়নায় নতুন মুখ', 'আমি তােমাদেরই লােক', 'আম মাহাতাে', 'আদি অন্তয মধ্য', 'অলকা সংবাদ', 'অন্ধকারে আলাের রেখা', 'বিকেলে ভােরের ফুল', 'বাঘিনী' ইত্যাদি।


জীবনের অন্তিম পর্বে সমরেশ বসু শান্তিনিকেতনের প্রখ্যাত শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ-এর জীবন নিয়ে দেশ পত্রিকায় একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেন 'দেখি নাই ফিরে' নামে। দুঃখের বিষয় অসাধারণ সম্ভাবনাপূর্ণ এই উপন্যাসটি অসম্পূর্ণ রেখেই সমরেশকে চিরবিদায় নিতে হয়।


ছােটোদের জন্যও সমরেশ বসু বেশ কিছু ছােটোগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন। ছােটোদের জন্য তিনি আধা-গােয়েন্দা আধা-অভিযানমূলক উপন্যাস লিখেছেন গােগােলকে নায়ক করে। গােগােল হল সমরেশ-সৃষ্ট এক ক্ষুদে গােয়েন্দা। এই গােগােল সিরিজের উপন্যাসগুলি কিশােরদের কাছে আজও যথেষ্ট জনপ্রিয়। গােগােল সিরিজের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য উপন্যাস 'জঙ্গলমহলে গােগােল', 'গােগােল চিক্ধুস নাগাল্যান্ডে', 'গােগােল কোথায়', 'চোরা হাতী শিকারী', 'অদৃশ্য মানুষের হাতছানি', 'পশ্চিমের ব্যালকনি থেকে' ইত্যাদি।


সমরেশের মধ্যে একটি জীবনরসিক অথচ নিরাসক্ত বাউল মন ছিল। তাঁর এই ভবঘুরে বাউল মনের প্রকাশ ঘটাতে তিনি আশ্রয় করেছিলেন কালকূট ছদ্মনাম। কালকূটের লেখা উপন্যাসগুলিতে যেন আর এক সমরেশের পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে। এক ভ্রমণপিপাসু জীবনতৃষ্ম হৃদয় যেন প্রবল আর্তি নিয়ে গভীর দৃষ্টিতে জীবনকে ফিরে ফিরে দেখেছে কালকূটের উপন্যাসগুলিতে। কালকূটের নামে লেখা উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য 'আরব সাগরের জল লােনা', 'অমৃত কুডের সন্ধানে', 'অমৃত বিষের পাত্রে', 'এক যে ছিল রাজা', 'কোাথায় পাবাে তারে', 'চলাে মন রূপনগর’, ‘নির্জন সৈকতে’, 'বনের সঙ্গে খেলা', 'মন চলাে বনে', 'মিটে নাই তৃষ্মা', 'যুদ্ধের শেষ সেনাপতি', 'শাম্ব', 'স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে', 'হারায়ে সে মানুষে' ইত্যাদি।


ছােটোগল্পের ক্ষেত্রেও সমরেশের প্রতিভা অনস্বীকার্য। তবে প্রথম উপন্যাসে সমরেশ যে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, আশ্চর্যজনক হলেও প্রথম ছােটোগল্প-সংকলন 'মরশুমের একদিন'- এর কোনাে কোনাে গল্পে সেই দক্ষতার অভাব স্পষ্ট। পূর্বেই বলা হয়েছে, সমরেশ বসু অন্যান্য সাহিত্যিকদের মতাে প্রথমে ছােটোগল্পের কলমে হাত মশা করেননি। উপন্যাসের মধ্যে দিয়েই তাঁর আবির্ভাব। কিন্তু ছােটোগল্পের শিল্পকৌশলেও তিনি সমান অনায়াস। দু-একটি গল্প বাদ দিলে এই প্রথম সংকলনেই তার প্রতিভার প্রমাণ আছে। 'মরশুমের একদিন' সংকলনেই রয়েছে আদাব’-এর মতাে গল্প। তা ছাড়া আছে 'জলসা' বা 'গম্ভব্য'-এর মতাে রাজনৈতিক গল্প। কত বিচিত্র মানুষ তিনি দেখেছেন, তার প্রমাণ আছে সমরেশের গল্পগুলিতে। 'কাজ নেই' গল্পের নায়ক ফটিকৰ্চাদের পেশা বেওয়ারিশ গােরু ধরে এনে খোঁয়াড়ে পােরা, আর 'বিয়ের ঝাড়' গল্পের নায়ক হারাধন চক্রবর্তীর পেশা গণিকা পল্লিতে যৌন ব্যাধির ওষুধ দেওয়া। আশ্চর্য এই যে, বিচিত্র চরিত্র, বিচিত্র ঘটনা, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ে গল্প লিখলেও সমরেশের সমস্ত গল্পই আসলে জীবনতৃষ্মার গল্প। সুনিশ্চিত ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েও তার গল্পের মানুষেরা বাঁচতে চায় ফটিকচাদ চায়, হারাধন চক্রবর্তী চায়, এমনকি 'প্রাণ পিপাসা' গল্পের হা-ঘরে বেশ্যা মেয়েটিও কোনােরকমে বেঁচে থাকতে চায়। এই সংকলনের শ্রেষ্ঠ সংকলনের নাম গল্পটিই—'মরশুমের একদিন'। নবীন হালদার অভিনেতা বা সংগীতশিল্পী হতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে বেছে নিতে হল পেন্টার ও ড্রেসারের কাজ। এ সংসার কাউকে ঈপ্সিত বস্তু দেয় না, এই সত্য উচ্চারিত হয় একটি নেশাগ্রস্ত চরিত্রের মুখে- 'ইসটেজ বেঁকে থাকলে ওতে কেন্ট ঠাকুরকেও বাঁকা দেখা যায়। এ দুনিয়া ঢেলে না বাঁধলে চলবে না, হ্যা।'


সমরেশ বসুর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘অকালবৃষ্টি। এই সংকলনের দুটি অসাধারণ গল্প উজান ও 'প্রত্যাবর্তন'। এ ছাড়া 'যষ্ঠ ঋতু' গল্প সংকলনে আটটি গল্প স্থান পেয়েছে। এখানে দুটি রাজনৈতিক গল্প আছে- 'ফটিচার' এবং 'ন নম্বর গলি'। 'নিমাইয়ের দেশত্যাগ' একটি উদ্বাস্তু সমস্যামূলক গল্প। সংকলনের একটি অসাধারণ গল্প 'উত্তাপ'। এক দেহাতি মেয়ে দেহের উত্তাপ দিয়ে সুস্থ করে তােলে বাবুদের ছেলে হরেনকে। কিন্তু সুস্থ হবার পর যখন হরেনের মনে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে, তখন মেয়েটি প্রবল ঘৃণায় তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে ওঠে "আ মরণ। কেন্নোর মরণ গ।... ই আর বাঁচবেনি দেখছি গ।"


সমরেশ বসু সম্পর্কে সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিতের একটি মূল্যায়ন প্রনিধানযােগ্য—“He had the sensibility of Bibhutibhusan, the experience of Tarasankar, the questioning attributes of Manik and the uninhibitingly isolated background that made Satinath Bhaduri different.” অর্থাৎ ঐতিহ্যকে তিনি স্বীকার করেছেন। বিভূতিভূষণের স্থির আস্তিক্যবােধ তার ছিল না, কিন্তু অনুভূতির প্রগাঢ়তা ছিল নিঃসন্দেহে, সেইসঙ্গে ছিল মানুষের প্রতি নিবিড় ভালােবাসা। সতীনাথ ভাদুড়ির মতাে আপাত আকর্ষণহীন শিল্পাঞ্চলের মানুষকে তিনি উপন্যাসের বিষয় হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তারাশঙ্করের মতাে গভীর অভিজ্ঞতাও তাঁর ছিল এবং তার মতােই সেই অভিজ্ঞতার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন দেশজ ভঙ্গিতেই। তারাশঙ্করের মতােই লােকজীবন ও লােককথাকে তিনি মিশ্রিত করেন বর্তমানের সঙ্গে। আবার বঙ্কিম যেভাবে দীনবন্ধুর প্রতিভাকে বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেভাবে গভীর ও নিবিড় সামাজিক অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতিও সম্ভবত সমরেশের সাহিত্য প্রতিভার উৎসস্থল। সহানুভূতির সার্থক সংযােজন ঘটলে কোনাে তুচ্ছ সাধারণ বা ঘৃণিত চরিত্রও কতখানি মানবিক আবেদন সৃষ্টি করতে পারে, তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত সমরেশ বসুর উপন্যাস ও ছােটোগল্পগুলি।