বাঙলা ভাষায় শাক্তপদাবলীর উদ্ভব ও বিষয়-বৈচিত্র্য এবং সমকালীন জীবনের প্রতীকরূপে এর বৈশিষ্ট্য-বিষয়ে আলােচনা কর।

ত্রয়ােদশ শতকের প্রারম্ভে বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে তুর্কী আক্রমণের আকস্মিক অভিঘাতে গৌড়বঙ্গে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় সূচিত হয়েছিল তারই মধ্যে কিছু শুভ ইঙ্গিতও আভাসিত হয়ে উঠেছিল। আর্য-অনার্য সভ্যতা-সংস্কৃতির মধ্যে যে একটা ব্যবধানকে দূরতিক্রম্য বলে মনে হয়েছিল, এই আকস্মিক অভিঘাত সেই ব্যবধানকে নিকটতর করেছিল। ফলে আর্য অনার্য সভ্যতা-সংস্কৃতির মধ্যে কিছুটা মিশ্রণ দেখা যায়—বেশ কিছু অনার্য দেবদেবী আর্যসমাজে গৃহীত হলেন। এদের মধ্যে ছিলেন মনসা, চণ্ডী, ধর্মঠাকুর প্রভৃতি, জনসাধারণ এদের পূজা করতেন, এঁদের মাহাত্ম-প্রচারের জন্য অনেকেই বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যও রচনা করেন। দেবী চণ্ডী পূজা পেলেও তার সঙ্গে ভক্তদের সম্পর্ক ছিল ভয়ের, দেবী ভক্তের হৃদয়ে তখনাে ভক্তির আসন লাভ করতে পারেননি। ক্রমে পরিবেশের পরিবর্তন ঘটতে থাকে—অনার্যকুল থেকে আগতা চণ্ডী জগজ্জননী কালীমাতায় রূপান্তরিত হলেন। ভক্তের সঙ্গে দেবীর সম্পর্ক কখনাে মাতা-পুত্রের, কখনাে বা পিতা-কন্যার। ইতােমধ্যে সামাজিক অবস্থারও অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়। মুঘল শাসনে দেশে শাস্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব মানুষের মনে প্রেমবােধকেও জাগিয়ে তােলে। এরপর আবার মুঘল সাম্রাজ্যের পতনদশায় দেশসমূহ বিপদের সম্মুখীন হয়; চৈতন্যদেবের প্রভাবও অস্তমিত হওয়াতে বাঙালীর সম্মুখে আর কোন মহৎ স্থির আদর্শও বর্তমান ছিল না। এই অবক্ষয়ের যুগে দেশব্যাপী সামগ্রিক অন্ধকারের মধ্যেও বাঙলাদেশে অন্ততঃ একজন কবি যেন বিদ্যুৎচমকের মতােই আলাের স্ফুরণ লক্ষ্য করেছিলেন—এই কবি সাধকশ্রেষ্ঠ রামপ্রসাদ। তিনি সর্বব্যাপ্ত অব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও জগজ্জননীর নিকট শরণ-গ্রহণের মধ্যেই বিপদমুক্তির সন্ধান পেলেন। তিনি দেবীর নিকট সুখ-দুঃখ-সমন্বিত জীবন নিয়ে একেবারেই আত্মসমর্পণ করে বসলেন।


মধ্যযুগের শুরুতেই বৈষ্ণবগণ তাদের আরাধ্য দেবতা রাধাকৃষ্ণের উপাসনার অঙ্গরূপে গ্রহণ করেছিলেন বৈষ্ণব পদ রচনা এবং পদকীর্তনকে। রামপ্রসাদ জগজ্জননী কালীর আরাধনায় এই আদর্শকে গ্রহণ করে রচনা করলেন নানাপ্রকার শাক্ত পদ এবং স্বয়ং তাতে সুর সংযােগ করে সেগুলিকে গীতিরূপও দান করলেন। এইভাবেই সৃষ্ট হলাে শাক্ত পদাবলীর। বৈষ্ণব পদের আদর্শে সৃষ্ট হলেও শাক্ত পদাবলী কোন কোন দিক থেকে বৈষ্ণব পদাবলীর সমজাতীয় হায়েও আবার কোন কোন দিক থেকে এর নিজস্বতা এবং স্বাতন্ত্র্য নিয়েই আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে। শাক্ত পদগুলিও বৈষ্ণব পদের মতই বিভিন্ন রসপর্যায়ে বিভক্ত এবং কবিগণ লিরিক গোত্রের ক্ষুদ্রাকৃতি পদের মাধ্যমেই আপনাদের মনােভাব প্রকাশ করেছেন।


রামপ্রসাদের পদ-সম্বন্ধে আলােচনা- প্রসঙ্গে ডঃ সুশীলকুমার দে যথার্থই মন্তব্য করেছেন, "Not only does he imitate in places characteristic diction and imagery of Vaisnaba Padabalis but he deliberately describes the Gostha, Rasa, Milana of Bhagabati in imitation of Brindaban Lila of Srikrishna." বৈষ্ণব-পদ থেকে স্বাতন্ত্র্যতার বিচারে দেখা যায়—যৌবনের জয়গানে মুখর বৈষ্ণব পদে যতই মাধুর্য রসের অবতারণা করা হােক, কিংবা আধ্যাত্মিকতা আরােপিত হােক না কেন, সুস্থ গৃহীজীবনের পক্ষে বৈষ্ণবীয় প্রেম কখনও কাম্য নয়। বৈষ্ণব পরকীয়া তত্ত্বের অসামাজিক হৃদয়বৃত্তি গৃহজীবনে একান্তই আনাকাক্ষিত। বৈষ্ণব রসতত্ত্বকে বাস্তবজগতে রূপায়িত করা সম্ভব নয়, বৈষ্ণব গীতিকবিতার সঙ্গেও বস্তুতঃ বাঙালীর বাস্তবজীবনের কোন যােগ নেই। ফলে বৈষ্ণব সাধনায় আরাধ্য দেবতা চিরকাল ভাবলােকেই বিরাজ করেন। কিন্তু শান্ত পদগুলিকে বলা যায় একান্তভাবেই গৃহস্থ জীবনের কাব্য। আরাধ্যা দেবী জগজ্জননী শ্যামা বা উমা শাক্তসাধকের দৃষ্টিতে জননী বা কন্যা-রূপে আমাদের সমস্যা-জর্জরিত সংসারেরই একজন। শাক্ত সাধককে নির্জনে সাধনা করবার জন্য গ্রামপ্রান্তে বৈষ্ণবসাধনার আখড়া স্থাপন করতে হয় না, সাধক কবি সংসারে বাস করেই দায়-দায়িত্বও সেই আরাধ্যার কাধে চাপিয়ে দিয়ে উদ্ধার পেতে চান। 


ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় শাক্ত পদগুলিকে আমাদের সংসার-জীবনের প্রেক্ষাপটে রেখে বিচার-বিশ্লেষণ করে বলেছেনঃ “পদের ফাকে ফাকে, উল্লেখে-ইঙ্গিতে তুলনায়-রূপকল্পে সমাজ জীবনের বাস্তব সমস্যা ছায়াপাত করিয়াছে। এখানে আমরা ডিক্রি-ডিসমিস, তহবিল-তছরূপ, হিসাবের খাতা প্রভৃতি বৈষয়িক জীবনের অনুষঙ্গের কথা শুনি; ঘুড়ি-ওড়া, পাশা-খেলা প্রভৃতি আমােদ-প্রকরণকে রূপক-রূপে ব্যবহৃত হইতে দেখি; বহু-বিবাহ-বিড়ম্বিত পরিবারে বিমাতার স্নেহহীন, বিমাতৃ-শাসিত পিতার ঔদাসীন্যের খবর পাই....শাক্ত পদাবলীতে সংসারের সমস্ত গ্লানি, কুশ্রীতা, দারিদ্র্য, তিক্ততা অনাবৃতভাবে প্রকট ও ইহার সাধনাক্রম অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত, উহার মধ্যে কোন নিগুঢ় ব্যঞ্জনা নাই।..বৈষ্ণব পদাবলীতে বাঙালীর মনের কথা যেন বেনামীতে ব্যক্ত হয়; শাক্ত পদাবলীতে উহার একেবারে সরাসরি, প্রত্যক্ষ প্রকাশ। সেইজন্য মনে হয় যে অষ্টাদশ শতকে বাঙালীর সংসার ও ভাবজীবনে যে একটা প্রকাশের নূতন ভঙ্গীতে স্বতঃই প্রতিফলিত হইয়াছে।”


শাক্ত পদাবলী ও বৈষ্ণব পদাবলী উভয়ই ধর্মবােধ থেকে উৎসারিত হলেও বৈষ্ণব পদের একটা বিশেষ গুণ এই যে, সুর বর্জন করলেও এর সুখপাঠ্যতার হানি হয় না; কিংবা রসানুভূতির ক্ষেত্রেও কোন অসুবিধা হয় না—শাক্ত পদাবলীর এই গুণ নেই। পক্ষান্তরে শাক্ত পদাবলীগুলি ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত যে ধর্ম-সম্পর্ক-বর্জিত-রূপে পাঠ করলেও এদের স্বাভাবিক মানসিক আবেদন অক্ষুগ্নই থাকে। এ বিষয়ে ডঃ ভূদেব চৌধুরী বলেন, "বৈষ্ণব পদাবলী গােষ্ঠীগত প্রেম-বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত। তাই, এই পদসাহিত্যে ধর্ম ও মর্মানুরাগ সমসূ্রে বিধৃত; একে অন্য থেকে অবিচ্ছিন্ন। কিন্তু শাক্তসঙ্গীতের মর্মোৎসারিতা ধর্ম-নিরপেক্ষ, ব্যক্তি-চিত্ত- প্রবাহে সমাকুল। এইখানেই এই দুই শ্রেণীর ধর্মনির্ভর গীতিসাহিত্যের ঐতিহাসিক পার্থক্য মূল।"


জীবনাশ্রয়ী এবং মানবিক আবেদন পুষ্ট শাক্ত পদাবলীকে বিষয়বস্তু বিচারে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা চলে —১. কন্যা-সাধনাত্মক উমা সঙ্গীত বা আগমনী-বিজয়া'র গান এবং ২. মাতৃসাধনাত্মক শ্যামা সঙ্গীত বা কালীকীর্তন।


১. উমাসঙ্গীত

উমাসঙ্গীত বা আগমনী-বিজয়ার গানে আরাধ্যাদেবীকে কন্যারূপে ভজনা করা হয়েছে। আদ্যাশক্তি পরমা প্রকৃতি ভগবতী হিমালয়-গৃহে মাতা মেনকা-গর্ভে পার্বতী, উমা বা গৌরীরূপে জন্মগ্রহণ করেন। শিবের সঙ্গে বিবাহিতা হবার পর থেকেই তিনি কৈলাস ধামে স্বামিগৃহবাসিনী। উমার জন্য জননী মেনকার উৎকণ্ঠা, উমাকে নিয়ে মেনকার সাধ-আহ্লাদ এবং কন্যার বিদায়-উপলক্ষ্যে জননীর হৃদয়ভেদী হাহাকারই এ জাতীয় পদের বিষয়বস্তু। এতে কোন পৌরাণিক রসবস্তু নেই, এতে রয়েছে। একান্তভাবেই বাঙালীর ঘরের কথা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "বাঙ্গালার জলবায়ুতে মধুর রস বিরাজ করে, তাই বাঙলাদেশে অত্যুগ্র চণ্ডী ক্রমশঃ মাতা অন্নপূর্ণারূপে, ভিখারীর গৃহলক্ষ্মীরূপে, বিচ্ছেদ বিধুর কন্যারূপে, মাতা, পত্নী ও কন্যা, রমণীর এই ত্রিবিধ মঙ্গলসুন্দররূপে দরিদ্র বাঙালীর ঘরে মধুর রসসঞ্চার করিয়াছে।" উমাসঙ্গীতগুলিতে বাল্যলীলা, আগমনী ও বিজয়া—তিন জাতীয় পদ রয়েছে। এই ত্রিবিধ পদেই বাৎসল্যরসের অনুপম প্রকাশ ঘটেছে। বৈষ্ণব পদাবলীর বাৎসল্যরসের তুলনায় শাক্ত পদাবলীর বাৎসল্যরসে অনেক বেশি আন্তরিকতা, গাঢ়তা এবং বাস্তবতার প্রকাশ ঘটেছে। শাক্ত পদাবলীর এ জাতীয় পদ ওলি পাঠ করলেই বােঝা যায়, কোন উপলব্ধি থেকে ইংরেজ কবি লিখেছিলেন, "Our sweetest songs are those that tell of Saddest thought" পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন অনুভূতির এমন সুষ্ঠ ও সর্বাঙ্গীণ প্রকাশ বিশ্বসাহিত্যের কোথাও খুঁজে পাওয়া ভার।


২. শ্যামা সঙ্গীত

শাক্তপদাবলীর শ্যামাসঙ্গীতগুলিতে সাধক কবিগণ জগজ্জননীকে শ্যামাজননীরাপেই গ্রহণ করেছেন। এ জাতীয় পদে শক্তিত্ত্ব এবং সাধনতত্ত্বে পরিচয় রয়েছে। বৈষ্ণব ধক যেমন জগৎ-ব্রহ্মাণ্ডের আদি পরমশক্তি হিসাবে কৃষ্ণকে গ্রহণ করেছেন, শাক্ত-সাধক তেমনি মাতৃ-শক্তিকেই জগৎ-কারণরূপে দেখেছেন। শক্তিতত্ত্বের পদে বিভিন্ন রূপকের সাহায্যে যে ভাবে দেবীর রূপ ফুটিয়ে তােলা হয়েছে, তাতে ভক্তসাধক-ব্যতীত অপর কারাে পক্ষে এর পরিপূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করা সম্ভবপর নয়। একমাত্র তন্ত্রসাধনার সঙ্গে পরিচয় থাকলেই শক্তিতত্ত্বের স্বরূপ উপলব্ধি সম্ভব। সাধনতত্ত্বের গঢ় ইঙ্গিতও সকলের পক্ষে গ্রহণযােগ্য নয়; তবে এ শ্রেণীর কিছু পদে ভক্তের আকৃতি এমনভাবে আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে যে এদের একটা সার্বজনীন আবেদনকে স্বীকার করে নেওয়া চলে। এতে মায়ের কাছে সন্তানের অভিযােগ, আব্দার এমন মানবিক আবেদন নিয়ে উপস্থিত যে সাধ্য ও সাধকের অন্তরঙ্গ যােগটি সহজেই উপলব্ধি করা যায়। এ জাতীয় পদগুলিতে আমাদের সমাজ ও সংসার জীবনের অনেক বাস্তব চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে। এই পদগুলিতে কবি সমাজ-সংসারের জটিলতা এবং তা থেকে মুক্তির জন্য দেবীর নিকট আত্মনিবেদন জ্ঞাপন করেছেন।