রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্রের দেশাত্মবােধক কাব্য-কবিতা | রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্রের বাঙলা দেশাত্মবােধক কাব্য ও খণ্ড কবিতার পরিচয়

রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র সেনের কাব্য ও কবিতার পরিচয়

ঈশ্বর গুপ্তের একান্ত স্নেহভাজন, সহকারী 'সংবাদ প্রভাকরে’র নিয়মিত লেখক রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম পাশ্চাত্ত্য কাব্যের রােমাণ্টিক-কল্পনায় প্রভাবিত হয়ে দেশাত্মবােধক রচনায় বাঙলা কবিতার আধুনিকতার ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। ডাঃ সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন : "অবাস্তব কাল্পনিক পরিবেশে স্থূল প্রণয়লীলার স্থানে তিনি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় দেশপ্রেমকে কাব্যের বিষয়রূপে গ্রহণ করিলেন...রঙ্গলালে নব-রােমান্টিক কবিত্ব প্রত্যুষান্ধকারে অকালজাগ্রত এক বিহঙ্গের অস্ফুট কাকটি ন্যায় অপূর্বকণ্ঠ এবং দ্বিধাগ্রস্ত। রঙ্গলালের বাণী যাহাদের অন্তরের মৌন স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিল সেই নবপ্রলুন্ধ ইংরেজী-শিক্ষিত বাঙালীর ভবিষ্যতের আশা তখনাে তেমনি সংশয়-বিজড়িত ছিল। পদ্মিনী উপাখ্যানে শিক্ষিত বাঙালী আপনার মনের কোন ভাবনাকে কতকটা বাত্মায় দেখিয়া আশ্বস্ত হইল।"


রঙ্গলালের সমকালে ইংরেজি-শিক্ষিতদের মধ্যে পরাধীনতার অভিশাপ অস্থিরতা ও অতৃপ্তি জাগিয়ে তুলছিল। টডের ‘রাজস্থান কাহিনী’র রাজপুত বীরত্বের গল্প বাঙালীর দেশগৌরবােধের আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজ শাসকরা শিক্ষিত হিন্দুদের তােষণনীতি ত্যাগ করে, ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে ও সমাজ-সংস্কারেও তাদের আর কোনও আগ্রহ ছিল না। বাঙলার ইংরেজি শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীদেরও ইংরেজ শাসকদের ঔদার্য এবং এদেশের উন্নয়নে তাদের সদিচ্ছা সম্পর্কে সব আশা ভরসা চূর্ণ হয়। তাদের মানসে দেশের পরাধীন অবস্থার জন্য ক্ষোভ-বেদনা পুঞ্জীভূত হতে থাকে। ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে 'হিন্দুমেলা'র প্রতিষ্ঠাতা রাজনারায়ণ বসুর 'জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা', ইলবার্ট-বিল-বিরােধী আন্দোলন, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমােহন বসুর 'ভারত সভা', সুরেন্দ্রনাথের কারাবাস (১৮৮৩), 'ন্যাশনাল কনফারেন্স' (১৮৮৩) প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে বাঙলার জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ও আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ইংরেজি-শিক্ষিত প্রথম বাঙালী কবি রঙ্গলালও টডের Annals and Antiquities of Rajasthan থেকে আলাউদ্দিন-কর্তৃক চিতাের অবরােধ এবং সতীত্ব রক্ষার জন্য পদ্মিনীর চিতানলে আত্মাহুতির শৌর্যবীর্যময় কাহিনীকে তার পদ্মিনী উপাখ্যান-এর বিষয়বস্তুরূপে গ্রহণ করেছিলেন। সদ্যজাগ্রত অথচ অপরিস্ফুট স্বদেশপ্রীতি-সূত্রে যে মনােভাব নব্যশিক্ষিত বাঙালীসাধারণের মধ্যে সমকালে লক্ষ্য করা গিয়েছিল, তারই পােষকতা পাওয়া গেল এই কাব্যের কাহিনীতে।


পদ্মিনী-উপাখ্যানের সর্বাধিক পরিচিত অংশ এই ক্ষত্রিয়দিগের প্রতি রাজার উৎসাহ বাক্য টমাস মূরের Glories of Brien the Brave From Life Without Freedom কবিতার অনুকরণে লিখিত হলেও বাঙলাদেশে স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষার উন্মেষে বিপুল প্রেরণা দান করেছিল। রঙ্গলালের দ্বিতীয় কাব্য 'কর্মদেবী'তে (১৮৬২) তার দেশপ্রেমের আদর্শ স্পষ্টতর। এই কাব্যটির কাহিনীসূত্রও রাজপুত-ইতিহাস থেকে গৃহীত। কর্মদেবী'র নায়ক যশন্মীরের অন্তর্গত পুগল প্রদেশে ভাগ জাতির অধিপতি অনঙ্গদেবের পুত্র সাধুর বীর ও স্বদেশনিষ্ঠ চরিত্রে দেশাত্মবােধের আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে। বিদেশী বণিকদের কাছে দেশের সােনা বিকিয়ে গেছে বলেই যে আমাদের দেশের এই দুর্গতি, কবি সাধুর উক্তিতে তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন, বাঙালীর পৌরুষহীনতাকেও তিনি ধিক্কার দিয়েছেন।


হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'বীরবাহু কাব্য-এ (১৮৬৪) রঙ্গলালকে অনুসরণ করলেও দেশাত্মবােধের প্রকাশে পূর্ববর্তী কবিকে অনেকটা পরিমাণেই অতিক্রম করেছেন। "রঙ্গলালের কাব্যে স্বদেশপ্রীতির প্রকাশ পশ্চাত্তাপে, এবং তাহা নিষ্ক্রিয় গােছের, দৈবনির্ভরশীল। বীরবাহুতে স্বদেশপ্রেম সক্রিয়। নায়কের মনােবেদনার মধ্যে লেখকের মনােবেদনাই মুখরিত।" বীরবাহুর নায়কের এই স্বপ্নসাধ তখনকার ইংরেজি-শিক্ষিত অনেক বাঙালী তরুণের হৃদয়মনকে চঞ্চল করে তুলেছিল।


'এডুকেশন গেজেটে' ও 'অবােধবন্ধু' তৈ হেমচন্দ্রের যে খণ্ডকবিতাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলি প্রথম খণ্ড 'কবিতাবলী' (১৮৭০)-তে সংকলিত হয়। এই কাব্য-সংকলন গ্রন্থের 'ভারত সঙ্গীত' হেমচন্দ্রের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ও জনসমাদৃত কবিতা। এই কবিতার দ্বারা জাতীয় আন্দোলন অনুপ্রাণিত হয়েছিল, দেশাত্মবােধের প্রসারে কবিতাটির ঐতিহাসিক ভূমিকা স্মরণীয়। দেশপ্রেমের এমন আবেগােচ্ছাসপূর্ণ ও উত্তেজনাতপ্ত প্রকাশ খুব কম বাঙলা কবিতায়ই দেখা যায়। 'ভারত সঙ্গীতে' পরাধীন ভারতবাসীদের দাসমনােভাবের প্রতি কবি এই কঠিন ধিক্কার উচ্চারণ করেছেন-

"গােলামের জাতি শিখেছে গােলামি,

আর কি ভারত সজীব আছে?”


হেমচন্দ্রের ব্যঙ্গবিদ্রপপূর্ণ অনেক কবিতা 'বিবিধ কবিতা-য় (১৩০০ বঙ্গাব্দ) সংকলিত হয়েছিল। সমকালীন ঘটনামূলক সরল ও ব্যঙ্গাত্মক কবিতাগুলিতে হেমচন্দ্রের রচনাশক্তি বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ব্যঙ্গবিদ্রুপের অন্তরালে স্বদেশের জন্য কবির উৎকণ্ঠা-মমতা ও দেশবাসীদের অধােগতিতে ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে-

"হায় কি হােল দলাদলি বাধলাে ঘরে ঘরে।

পার্টি খেলা কেউ তুলেছে ভারত-রাজ্য পরে।

সবই লীডার কর্তা স্বয়ং আপনি বাহাদুর,

কতই দিকে তুলছে কতাে কতই-তরাে সুর।"


নবীনচন্দ্র সেনের অবকাশরঞ্জিনী'র দ্বিতীয় ভাগের (১২৮৪ সাল) ভারত-উচ্ছাস কবিতাটি রানী ভিক্টোরিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্রের ভারত-আগমন উপলক্ষে রচিত, কবি তার জন্য পঞ্চাশ গিনি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। অবকাশরঞ্জিনী প্রথম ভাগে (১৮৭১) দেখা যায়, মাতৃভূমির অতীত গৌরবের স্মৃতি কবিকে যন্ত্রণাদগ্ধ করেছে, কিন্তু বাইরে তার প্রকাশ নেই, আর্য ভারতের মহিমাবােধেই কবির স্বাধীনতা-কল্পনা সীমিত। দ্বিতীয় ভাগে আমরা লক্ষ্য করি, হেমচন্দ্রের দেশাত্মবােধের উদ্দীপনা নবীনচন্দ্রকেও উদ্বেল করেছে, ভারতের আত্মশক্তিকে উদ্বেল করেছে, ভারতের আত্মশক্তির উদ্বোধনের জন্য কবি বেদনাময় উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন-

"হবে কি সে দিন কে করে গণনা, 

যেই দিন দীনা ভারত তনয়

শিখি রণনীতি, করি বীরপনা,

রক্তাক্ত শরীরে ফিরিবে আলয়।"


ঐতিহাসিক গাথাকাব্য 'পলাশীর যুদ্ধ' (১৮৭৬) জাতীয়তাবােধের উন্মেষের যুগে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। রঙ্গলাল-হেমচন্দ্রের রচনায় ভারতবর্ষের পরাধীনতার ক্ষোভ মুসলমান শাসনের পটভূমিকায় পরােক্ষভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজের কাছে বাঙালীর স্বাধীনতার লােপ সেকালের শিক্ষিত তরুণদের মনে যে গ্লানিবােধ জাগিয়ে তুলেছিল, বাঙলা কাব্যে তার স্পষ্ট প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় নবীনচন্দ্রের 'পলাশীর যুদ্ধে'। অবশ্য তখন ইংরেজদের লেখা ইতিহাসে সিরাজ সম্পর্কিত যা কিছু বৃত্তান্ত জানা ছিল সেই ইতিহাসে সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রকে যে কলঙ্ক কালিমায় চিত্রিত করা হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করার ফলে নবীনচন্দ্র সিরাজ সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। নিজের সরকারি চাকরির জন্য ক্লাইভের বিরুদ্ধে কোনও সমালােচনাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার জন্য কবি মােহনলালকে প্রাধান্য দিয়ে তাকে স্বদেশপ্রেমের প্রতীকরূপে চিত্রিত করেছেন। মুসলমান নবাবের সেনাপতি মােহনলাল সিরাজের জন্যই সংগ্রাম করেছে, কিন্তু সিরাজের পরাজয়ে ভারতবর্ষ যে 'যবন' অধিকার থেকে মুক্ত হল, এই মনােভাবও সে প্রকাশ করেছে। এই অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও 'পলাশীর যুদ্ধে' দেশের পরাধীনতার মর্মবেদনা যেভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তার ঐতিহাসিক মূল্য স্বীকার করতেই হয়। সাধারণ রঙ্গমঞ্চে পলাশীর যুদ্ধের প্রতিটি অভিনয় জন-সংবর্ধিত হয়েছে।


'পলাশীর যুদ্ধে' যে দেশাত্মবােধের পরিচয় পাওয়া যায় তারই আর এক পরিচয় নবীনচন্দ্র সেনের কাব্যত্রয়ী 'রৈবতক' (১৮৮৬), 'কুরুক্ষেত্র' (১৮৯৩) ও 'প্রভাস'-এ (১৮৯৬) রূপ পেয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র তার 'কৃষ্ণচরিত্র' গ্রন্থে পূর্ণ মনুষ্যত্বের আদর্শরূপে কৃষ্ণ-চরিত্রকে নতুনভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন। নবীনচন্দ্র বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্রে’র ভাষ্য অনুসরণ করে মহাভারতের পটভূমিতে কৃষ্ণকে আর্যসংস্কৃতির নব-উজ্জীবনে ঐক্যবদ্ধ অখণ্ড ভারতবর্ষ গঠনের নায়করূপে পরিকল্পনা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে আর্য-অনার্যের মিলনে যে ঐক্যবদ্ধ ভারতের রূপ কবি চিত্রিত করতে চেয়েছেন, তার মধ্যে উনবিংশ শতাব্দীর বাঙলার জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই উদ্ভাসিত হয়েছে। অবশ্য নবীনচন্দ্র তার প্রতিভার দুর্বলতার জন্য চরিত্র ও ঘটনার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের এই আদর্শকে জীবন্তভাবে রূপায়িত করতে পারেননি।