"সমগ্র মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে যদি এমন কোন ধারার উল্লেখ করতে হয়, যা বিশ্বসাহিত্যে পরিবেষণ-যােগ্য, তবে তা নিঃসন্দেহে বৈষ্ণব সাহিত্য।"- আলােচনা কর।

বৈষ্ণব পদাবলীর গুণাগুণ

বৈষ্ণব পদ ও বৈষ্ণবধর্ম ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গীতিধর্মিতায় রবীন্দ্রনাথের পরই বৈষ্ণব পদাবলীর নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়। সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসে অবশ্যই বৈষ্ণব কবিতার স্থান সর্বোচ্চে। একটা বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গােষ্ঠীসাহিত্য রূপে রচিত হওয়া সত্ত্বেও এই বৈষ্ণব পদগুলি দেশকালের সীমাকে লঙঘন করে কোন গুণে সর্বজনীন রসাবেদন-সৃষ্টিতে সার্থকতা অর্জন করেছে, সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উক্তি বিশেষ মূল্যবান বিবেচিত হতে পারে। তিনি বলেন - "এই প্রেমের শক্তিতে বলীয়সী হইয়া আনন্দ ও ভাবের এক অপূর্ব স্বাধীনতা প্রবল বেগে বাঙলা সাহিত্যকে এমন এক জায়গায় উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছে যাহা পূর্বাপরের তুলনা করিয়া দেখিলে হঠাৎ খাপছাড়া বলিয়া বােধ হয়। তাহার ভাষা, ছন্দ, ভাব, তুলনা, উপমা ও আবেগের প্রবলতা সমস্তই বিচিত্র ও নূতন। তাহার পূর্ববর্তী বঙ্গভাষা ও বঙ্গ সাহিত্যের সমস্ত দীনতা কেমন করিয়া এক মুহূর্তে দূর হইল, অলঙ্কার শাস্ত্রের পাষাণবন্ধন সকল কেমন করিয়া এক মুহূর্তে বিদীর্ণ হইল, ভাষা এত শক্তি পাইল কোথায়, ছন্দ এত সঙ্গীত কোথা হইতে আহরণ করিল? বিদেশী সাহিত্যের অনুকরণে বাঁধিয়া আপনার গান ধরিল। প্রকাশ করিবার আনন্দ এবং আবেগ এত যে, তখনকার উন্নত মার্জিত কালােয়াতি সঙ্গীত থই পাইল না। দেখিতে দেখিতে দশে মিলিয়া এক অপূর্ব সঙ্গীতপ্রণালী তৈরি করিল, আর কোন সঙ্গীতের সহিত তাহার সম্পূর্ণ সাদৃশ্য পাওয়া শক্ত।"


এই বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে বৈষ্ণবধর্মের একটা প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন মহাকাব্যে ও পুরাণে শ্রীকৃষ্ণকে 'পূর্ণব্রহ্ম' কিংবা 'অবতার' অথবা 'বিষ্ণুর অবতার' বলে বর্ণনা করে তাঁর অপরিসীম শক্তি, বুদ্ধি-আদি বিভিন্ন গুণরাশির যথাযথ পরিচয় বিবৃত করা হলেও তিনি বৃন্দাবনে গােপীদের সঙ্গে যে বিভিন্ন লীলায় মত্ত ছিলেন, সেই প্রেম স্বরূপেরও কিছুটা বিবরণ আমরা বিভিন্ন সূত্রে পেয়ে থাকি। ভাগবতে কৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গে স্পষ্টভাবে রাধার নামটি কিন্তু কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। কিন্তু সেখানে ব্রজগােপীরা নিরুদিষ্ট কৃষ্ণপ্রসঙ্গে একস্থানে বলছে যে, কৃষ্ণ হয়তাে তার প্রিয়তমা সখীটিকে নিয়ে নির্জন কুঞ্জেও লীলা করছে। এখানেই 'অনয়ারাধিত' শব্দের উল্লেখ থেকে সেই প্রিয়তমা ব্রজগােপীর নামটি 'রাধা' বলে কল্পিত হয়েছে বলে গবেষকগণ অনুমান করেন। পরবর্তীকালে সম্ভবতঃ কোন লৌকিক সূত্রে বৃন্দাবনের গােপীদের মধ্যে শ্রীমতী রাধিকার নামটি অনুপ্রবিষ্ট হলে তিনিই শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সীরূপে কল্পিত হন। কিছু কিছু প্রাকৃত ও সংস্কৃত প্রকীর্ণ শ্লোকে রাধা-কৃষ্ণের লীলাকাহিনীর কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতকে জয়দেব গােস্বামী রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা অবলম্বন করে যে অপূর্ব সঙ্গীতধর্মী 'গীতগােবিন্দ’ কাব্য রচনা করেন, তাতেই আমরা সর্বপ্রথম রাধাকৃষ্ণ-লীলার পরিপূর্ণ বিবরণ লাভ করি। 'ব্রহ্মবৈর্বত-পুরাণ’-আদি কোন অর্বাচীন পুরাণেও রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনী বিস্তৃতভাবে পরিবেশিত হয়। বড়ু চণ্ডীদাস রচিত 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' নামক এক নাট্যগীতিতে বাঙলা ভাষায় প্রথম রাধাকৃষ্ণ-কাহিনী কীর্তিত হয়। প্রায় সমকালেই মিথিলার কবি বিদ্যাপতি ঠাকুর রাধাকৃষ্ণ লীলাকাহিনীর বিভিন্ন দিক অবলম্বন করে ব্রজবুলি ভাষায় কিছু পদ রচনা করেন। এগুলিকেই পদাবলী সাহিত্যের প্রাচীনতম রূপ বলে মনে করা হয়। স্ভবতঃ দ্বিজ চণ্ডীদাসও এ সময় বাঙলা ভাষায় এ জাতীয় কিছু পদ রচনা করেছিলেন।


এ সমস্তই মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্ববর্তীকালের কথা। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বৈষ্ণবধর্মের অপূর্ব বিকাশ সাধিত হয় এবং বঙ্গদেশে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় নামে একটি বিশেষ শাখা গড়ে ওঠে। এই সম্প্রদায় রাধাকৃষ্ণের যুগল রূপের উপাসক ছিলেন। এরা বিশ্বাস করতেন যে শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন রাধাকৃষ্ণের যুগল অবতার। তাদের এই বিশ্বাস রূপায়িত হয়ে উঠেছে স্বরূপ দামােদর-রচিত নিম্নোক্ত শ্লোকটিতে


‘শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কীদৃশ্যে বানয়ৈবা।

স্বাদ্যো যেনাভ্ভুত মধুরিমা কীদৃশাে বা মদীয়ঃ। 

সৌম্যং চাস্যা মদনুভবতঃ কীদৃশং বেতি লােভাৎ 

তঙ্ভাবাবাঢ্য সমজনি শচী-গর্ভসিস্ধৌী হরীন্দুঃ


অর্থাৎ রাধাপ্রেমের স্বরূপ উপলব্ধি করবার জন্যই ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ মর্ত্যলােকে নবদ্বীপচন্দ্র শ্ৰীচেতন্যবূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কবিরাজ গােস্বামীও 'চৈতন্যচরিতামৃত'-এ বলেছেন


রাধাভাব অঙ্গীকরি ধরি তার বর্ণ। 

তিন সুখ আস্বাদিতে হয় অবতীর্ণ ॥


চৈতন্যদেব এক দেহেই রাধা এবং কৃষ্ণের অবতার। তিনি অন্তকৃষ্ণঃ বহিগৌার'অন্তরে তিনি কৃষ্ণময়, আকারে রাধার তুল্য গৌরতনু। এই নবােদ্ভূত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মেরও রসশাস্ত্রে যে পঞ্চরসের অস্তিত্ব এবং মধুর রসের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণিত হয়েছে তারি রসভাষ্যরূপে সৃষ্টি হলাে চৈতন্যসমকালীন এবং চৈতন্যোত্তর যুগের বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য। তাই বলা হয়, বৈষ্ণবধর্মের সঙ্গে বৈষ্ণব পদের নিগুঢ় সম্পর্ক বর্তমান। তা হলেই একটি প্রশ্ন দেখা দিতে পারে—ধর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত এই সাহিত্য সর্বজনীন রসাবেদন সৃষ্টি করতে পারে কীভাবে?


প্রশ্নটি তুলেছেন রবীন্দ্রনাথও


'সত্য করে কহ মােরে হে বৈষ্ণব কবি 

কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি?...'


একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার—বৈষ্ণব পদাবলীর কবিগণ নিষ্ঠাবান ভক্ত বৈষ্ণব হলেও তারা কেউ আকাশস্থ নিরালম্ব বায়ুভূত নিরাশ্রয় নন, তাঁরাও মাটির পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন, এখান থেকেই রস আহরণ করে পদ রচনা করেছেন। বৈষ্ণব-সাধনা ছিল রাধাভাবের সাধনা। তারা কেউ বা রাধারূপে কৃষ্ণপ্রেমের স্বাদ উপলব্ধিতে তৎপর, কেউ বা রাধাভাব অবলম্বন না করেও সখী বা মঞ্জরীর অনুগভাবে সাধন করে নিত্যযুগল লীলা আস্বাদন করতেন। ডঃ শশিভূষণ দাসগুপ্ত যথার্থই বলেছেন, "পরবর্তীকালে গৌড়ীয় গােস্বামিগণকর্তৃক যখন রাধাতত্ত্ব দঢ় প্রতিষ্ঠিত হইল তখনও সাহিত্যের ভিতরে রাধা তাহার ছায়া মানবী নারীকে একেবারে পরিত্যাগ করতে পারে নাই।”


বস্তুতঃ পার্থিব লৌকিক মানবীয় প্রেমের আদর্শে কবিরা আপন হৃদয়ে সঞ্চিত প্রেমােপলব্ধিকেই একটু অলৌকিতার স্পর্শ বুলিয়ে রাধাকৃষ্ণের প্রেমরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই বৈষ্ণব পদগুলি থেকে ভক্ত বৈষ্ণব অলৌকিক প্রেমের স্বাদ পেলেও যে কোন সাধারণ পাঠক এরি মধ্যে লৌকিক পার্থিব এবং মানবীয় রসের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় না। জনৈক রসজ্ঞ সমালােচক উভয় মনােভাবের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধান করে বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন - "..বৈষ্ণব পদাবলীকে পুরােপুরি মর্ত্যপ্রেমের নিরিখে বুঝা যাইবে না, আবার শান্তরসাম্পদ ভক্তির নিরাকাক্ষ আত্মনিবেদনও ইহার একমাত্র পরিচয় নহে—উভয়ের সংমিশ্রণে, প্রেমের বিষামৃতের তীব্রতায় ইহা অনন্যসাধারণ।" রােম্যান্টিক লক্ষণযুক্ত এই বৈষ্ণব পদগুলিতে ভক্ত বৈষ্ণব যেমন ভাগবতচেতনা এবং ধর্মানুভূতির পরিচয় পান, সাধারণ পাঠকের মর্তাজীবনাশ্রয়ী সৌন্দর্যপিপাসু মননও তেমনি এখানে ভিন্নজাতীয় রসবৈচিত্র্যের আস্বাদ লাভে ধন্য হতে পারেন।


বৈষ্ণবীয় পঞ্চরস: ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রে নববিধ স্থায়ীভাব ও তা থেকে জাত নয়টি রসের কথা স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই বৈষ্ণব পদাবলী রচিত হয়েছিল বলে বৈষ্ণব পদকর্তাদের কিছুটা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হয়েছে। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে পঞ্চরসকেই শুধু স্বীকৃতি দান করা হয়েছে—এই পঞ্চরস: 'শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য, সখ্য এবং মধুর বা উজ্জ্বল'। এদের মধ্যে মধুর রসকেই সর্বোত্তম বলা হয়েছে কারণ রাধাকৃষ্ণ-লীলার বিভিন্ন পর্যায় যথার্থ অভিব্যক্তি পেয়েছে একমাত্র মধুর রসেই।


শান্তরস গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের অনুকূল নয়। মােক্ষেচ্ছু ব্যক্তিই শাস্তরসের অধিকারী, কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ মােক্ষবাঞ্ছাকে কৈতবপ্রধান বলে মনে করেন, তাই বৈষ্ণব কবিতায় শান্তরসের স্থান নেই। অবশ্য চৈতন্য-পূর্ব যুগের কবি বিদ্যাপতির 'নিবেদন' শীর্ষক পদগুলি শাস্তরসের অপূর্ব নিদর্শন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে প্রেমের ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ভক্তের সম্পর্ক কখনাে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক হতে পারে না বলেই বৈষ্ণব পদে দাস্যরসের পরিচয় পাওয়া যায় না বল্লেই চলে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা চলে যে বাঙলার বাইরে কোথাও কোথাও এই দাস্যভাব দেখতে পাওয়া যায়। মাতা যশােদার মনে বালক কৃষ্ণ বিষয়ে যে স্নেহব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে, তাকে অবলম্বন করে বেশি কিছু উৎকৃষ্ট বাৎসল্য রসের পদ রচিত হয়েছে বাল্যলীলা-পর্যায়ে। বালক কৃষ্ণ ক্রমে কিশার হয়ে সখাদের সঙ্গে গােষ্ঠে যেতেন—এই গােষ্ঠলীলা পর্যায়ের পদে সখ্যরসের প্রকাশ ঘটেছে। এই গােষ্ঠযাত্রার পথেই রাধাকৃষ্ণের পরস্পর দর্শন লাভ ঘটে, কৃষ্ণের বাঁশী শ্ৰীমতী রাধাকে আকুল করে তােলে—এখান থেকেই শুধু মধুর রূপ। বস্তুতঃ বৈষ্ণব পদাবলীর বৃহত্তম ও মহত্তম অংশ এবং রাধা কৃষ্ণলীলার সমগ্র অংশই মধুর রসাশ্রিত।


অধ্যাপক ডঃ সত্রাজিৎ গােস্বামীর মতে তাই- "বৈষ্ণব পদাবলীর ভিত্তি বৈষ্ণবীয় পঞ্চরস বলে উল্লেখ করা হলেও বস্তুত বৈষ্ণব পদাবলীর মূল ভিত্তি মধুর রস। পঞ্চরসরূপ পঞ্চস্তম্ভের উপর বৈষ্ণব পদাবলী স্থাপিত, কিন্তু মধুর রসটিই তার কেন্দ্রীয় স্তম্ভ, বাকি চারটি রস প্রান্তিক স্তম্ভ হিসাবেই পরিগণিত হতে পারে মাত্র।"


বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের সর্বাধিক প্রামাণিক গ্রন্থ রূপ গােস্বামী-বিরচিত উজ্জ্বলনীলমণি। উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থে মধুর বা উজ্জ্বল বা শৃঙ্গার রসের দুটি প্রধান ভেদ কল্পনা করা হয়েছে- বিপ্রলন্ত এবং সম্ভোগ। বিপ্রলম্ভ আবার চার শ্রেণীতে বিভক্ত- পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিত্ত্য ও প্রবাস। "মিলনের পূর্বে পরস্পরের দর্শনাদির দ্বারা নায়ক-নায়িকার চিত্তে উদ্বুদ্ধ রতি যখন বিভাবাদির সংযােগে আস্বাদনীয় অবস্থা লাভ করে, তখন তাহার নাম হয় পূর্বরাগ।" “প্ৰতিনায়িকাকে নায়ক যদি উৎকর্য দেন, তাহা হইলে নায়িকার মনে যে ঈষ্যাজনিত বােধের উদ্ভব হয়।" তাহারই আস্বাদযােগ্য অবস্থার নাম মান। "প্রেমের গভীরতার ফলে প্রিয় সন্নিকটে থাকিয়াও বিরহ-বােধজনিত যে বেদনা, তাহারই আস্বাদযােগ্য অবস্থার নাম প্রেমবৈচিত্ত্য।" এই প্রেমবৈচিত্ত্যরই অপর পরিচিত নাম আক্ষেপানুরাগ। দেশান্তর গমনাদি কারণে বিচ্ছিন্ন নায়ক-নায়িকা-হৃদয়ে যে বিরহ-বেদনার সৃষ্টি হয়, সেই বেদনার আস্বাদ্য অবস্থা 'প্রবাস'। প্রবাস-এর দুটি প্রচলিত নামান্তর মাথুর বা বিরহ।


বিলম্ভের এই চারটি বিভাগ ছাড়া শৃঙ্গার রসের অপর রুপ সম্ভোগ। 'সম্ভোগ’ নায়ক-নায়িকার মিলন-জাত উল্লাসময় ভাব। ইহাও বাস্তব নহে, কাব্যগত। বৈষ্ণব পদাবলীর ভাবসম্মেলন পর্যায়ের পদগুলিকেই সাধারণতঃ সম্ভোগ বলা হয়।


বৈষ্ণব পদাবলী সাধারণতঃ কীর্তন বুপে গীত হতাে বলে এগুলিকে বিভিন্ন 'পালা' আকারে সাজানাে হয়। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম থেকে মথুরা গমন পর্যন্ত কাহিনীকে অবলম্বন করে বিভিন্ন পালা গান রচিত হয়েছে, যেমন—জন্মলীলা, নন্দোৎসব, বাল্যলীলা, গােষ্ঠলীলা, কালীয় দমন, দানলীলা, হােলি প্রভৃতি।


আবার শ্রীমতী রাধিকার মনােভাব ও আচরণকে অবলম্বন করে মধুর রসের পদগুলি নায়িকার অষ্টাবস্থা-রূপে বর্ণনা করা হয়। নায়িকা রাধিকার এই অষ্টাবস্থা ও অভিসারিকা, বাসকসজ্জিকা, উৎকণ্ঠিতা, বিপ্রলব্ধা, খণ্ডিতা, কলহান্তরিতা, প্রেষিতভর্তৃকা ও স্বাধীনভর্তৃকা।


গৌরচন্দ্রিকা: গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ রাধাকৃষ্ণের যুগললীলার উপাসক হলেও তারা মনে করেন যে চৈতন্যদেবের মধ্যেই এই যুগললীলার প্রমূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। তাই তারা চৈতন্যদেবেরও উপাসক। সুতরাং রাধাকৃষ্ণ-লীলার মতই তাঁরা যে চৈতন্যলীলার পদ রচনা করেছেন, তা অত্যন্ত‌ স্বাভাবিক। তবে লক্ষণীয় এই–চৈতন্যদেবের প্রাক-সন্ন্যাস যুগের যৌবন সাধনাই বৈষ্ণব কবিদের অধিকতর আকর্ষণ করেছিল বলেই পদগুলিকে চৈতন্য-বিষয়ক না বলে গৌরাঙ্গ-বিষয়ক বলাই সমীচীন। গৌরাঙ্গদেবের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় অবলম্বন করে বহু পদ রচিত হলেও কতকগুলি পদ রচিত হয়েছে রাধাকৃষ্ণলীলার আদর্শে। এ জাতীয় পদগুলিকে বলা হয় গৌরচন্দ্রিকা।


পদাবলী কীর্তনের প্রারম্ভে গৌরচন্দ্রিকা-কীর্তন আবশ্যক। রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তনে যে জাতীয় রস বা কাহিনী পরিবেশিত হবে—গৌরচন্দ্রিকা থেকে সেই জাতীয় পদ গেয়ে কীর্তন আরম্ভ করতে হয়। রাধাকৃষ্ণের যুগললীলার যত প্রকার ভাববৈচিত্র্য বর্তমান, রাধাভাবে ভাবিত গৌরাঙ্গ-জীবনেও তদ্রপ ভাববৈচিত্র্য বর্তমান, রাধাভাবে ভাবিত গৌরাঙ্গ-জীবনও তদ্রুপ ভাববৈচিত্র্য কল্পনা করে বৈষ্ণবপদকর্তাগণ গৌরচন্দ্রিকার পদ রচনা করে গেছেন। কোনাে কোনাে বৈষ্ণব সাহিত্য-আলােচক মনে করেন যে, গৌরচন্দ্রিকাতে গৌরাঙ্গদেবের মাধ্যমে কেবল রাধাপ্রেমের স্বরূপই প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণ প্রেমের চিত্র গৌরচন্দ্রিকার দর্পণে প্রকাশিত নয়। কিন্তু অধ্যাপক ডঃ সত্রাজিৎ গােস্বামী মনে করেন, "গৌড়ীয় বৈষ্চবগণের নিকট শ্রীচৈতন্য একদেহে রাধা ও কৃষ্ণের পূর্ণযুগল মূর্তি। গৌরচন্দ্রিকা পদেও তাই উভয়ের প্রেমের স্বরূপই উদ্ঘাটিত। 'রাধাভাব দ্যুতিসুবলিত’ চৈতন্যের ‘রাধাপ্রেমমূর্তিই’ যদিও গৌরচন্দ্রিকার সিংহভাগ, তবু কৃষ্ণমূর্তি সেখানে অনুপস্থিত, এ কথা যুক্তি-সঙ্গত নয়। হেমকল্পতরুবূপী গৌরাঙ্গের ‘প্রেমরতনফল বিতরণ’-দৃশ্য কৃষ্ণের রাসলীলামূর্তিই।


বস্তুতঃ রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনীর ছকে ফেলেই গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদগুলি রচিত হয়েছে বলেই গৌরচন্দ্রিকাতেও কৃষ্ণলীলার অনুরূপ পূর্বরাগ, অভিসার, বিরহ-আদি বিভিন্ন জাতীয় পদের সন্ধান পাওয়া যায়। বস্তুতঃ গৌরাঙ্গদেবকে অবলম্বন করে রচিত সমস্ত পদগুলিকেই গৌরচন্দ্রিকা বলা যায় না। অনেকগুলি পদে গৌরাঙ্গ বর্ণনা বা গৌরাঙ্গ-বন্দনা করা হলেও সেখানে রাধাকৃষ্ণ প্রেমের কোনাে ছায়াপাত ঘটে নি। ফলে এই পদগুলিকে সাধারণ গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদ বলা যেতে পারে।


বাঙলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীগুলি এক ঈর্ষণীয় স্থান অধিকার করে আছে। সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যের যদি এমন কোন শাখার নাম উল্লেখ করতে হয়, যা বিশ্বসাহিত্যে পরিবেষণযােগ্য, তবে বৈষ্ণব সাহিত্যই সেই একমাত্র শাখা। আধুনিক যুগেও বৈষ্ণব সাহিত্যের সঙ্গে সমকক্ষতা করতে পারে, এমন কাব্য একান্তই মুষ্টিমেয়। ভাবে, ভাষায়, ছন্দে, অলঙ্কারে এবং ব্যঞ্জনায় বৈষ্ণব পদাবলীগুলি অপূর্ব সার্থকতা অর্জন করেছে।


বৈষ্ণব কবিতার বিশিষ্টতা বিষয়ে জনৈক সুধী সমালােচক বলেন - "ইহারা সম্পূর্ণ বঙ্গীয় বাংলাদেশের, বঙ্গপ্রকৃতির ও বাঙালী চরিত্রের সঙ্গে সুসমঞ্জস। বাঙালী হৃদয়ের ভাবুকতা, সৌন্দর্যবােধ ও সুকোমল মাধুর্য নিঃশেষে প্রকাশিত হইয়াছে বৈষ্ণব পদাবলীতে। আরও কয়েকটি গুণে বৈষ্ণব কবিতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত বঙ্গীয় কবিতা হইতে স্বতন্ত্র ; সেগুলি হইতেছে কবিচিত্তের বিশাল বিস্তৃতি, অনুক্ততা ও গভীরতা। বৈষ্ণব পদাবলী অধ্যায্মসাধনার উপযােগী অথচ পূর্ণভাবে মানবীয়, সাম্প্রদায়িক গােষ্ঠীসাহিত্য অথচ অদ্ভুতভাবে সার্বজনীন, জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলেরই আস্বাদ্য। অতিরিক্ত ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা বা যুগচেতনা ইহাকে দেশে ও কালে আবদ্ধ করে নাই। ইহারা চির স্বাধীন ও চির নবীন। ইহারা বাঙালী কবিকৃতির চূড়ান্ত নিদর্শন।"