সাধক কবি রামপ্রসাদের এবং কমলাকান্তের সাহিত্যকীর্তি বিষয়ে আলােচনা কর।

[] রামপ্রসাদ

বিচিত্র প্রতিভার পরিচয় দিলেও রামপ্রসাদ প্রধানতঃ সাধক কবি এবং শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতারূপেই বিখ্যাত। বৈষ্ণব পদাবলীর বিভিন্ন কবিদের পরিচয় প্রসঙ্গে আমরা বারবার যে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকি, রামপ্রসাদ-সম্বন্ধেও দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের ঐ রকম সমস্যার মুখােমুখী হতে হয়েছে। সাধারণভাবে আমরা জানি, কুমারহট্ট বা হালিশহরের বৈদ্যবংশীয় সাধক-কবি কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন-ই শাক্ত পদাবলীর স্রষ্টা এবং শ্রেষ্ঠ কবি। কিন্তু বিভিন্ন শ্যামাসঙ্গীতে 'রামপ্রসাদ' নামের সঙ্গে যুক্ত যে সকল ভণিতা পাওয়া যায়, তা থেকে স্বভাবতঃই সন্দেহ জাগে রামপ্রসাদ কি একজনই ছিলেন? 'দীন রামপ্রসাদ, দ্বিজ রামপ্রসাদ, শ্রীরামপ্রসাদ, দাস রামপ্রসাদ, প্রসাদ'- ইত্যাদি ভণিতা রামপ্রসাদ সমস্যাকে জটিলতর করে তুলেছে।


সম্ভবতঃ ১৭২০ খ্রীঃ চব্বিশ পরগণা জেলার কুমারহট্ট গ্রামে রামপ্রসাদ সেন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শ্যামাসঙ্গীত ছাড়াও 'কবিরঞ্জন' নামে যে 'কালিকামঙ্গল' তথা 'বিদ্যাসুন্দর' কাব্য রচনা করেন, তাতে আত্মপরিচয়-সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে তার পিতার নাম ছিল রামরাম সেন। সম্পন্ন পরিবারের সন্তান রামরাম সেন কর্মসূত্রে কলকাতার নিকটবর্তী কোন এক ধনীগৃহে বাস করতেন। রামপ্রসাদের প্রথম যৌবনেই পিতা রামরামের মৃত্যু হলে সংসার-ভার ন্যাস্ত হয় রামপ্রসাদের উপর। রামপ্রসাদ সম্ভবতঃ কোন এক ধনী ব্যক্তির সেরেস্তায় মুহুরীর কাজ করতেন। প্রবাদ এই, তিনি জমা-খরচের খাতায় শ্যামাসঙ্গীত রচনা করতেন। গুণগ্রাহী উক্ত ধনী ব্যক্তি রামপ্রসাদের ভক্তি এবং গীতরচনা দর্শনে মুগ্ধ হয়ে তার জন্য মাসােহারার ব্যবস্থা করে দেন। অতঃপর রামপ্রসাদ স্বগৃহে পঞ্চমুণ্ডীর আসন স্থাপন করে সাধন-ভজনে কালাতিপাত করতে থাকেন। নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তখন মাঝে মাঝে জমিদারী দর্শনে কুমারহট্টে আসতেন। তিনি রামপ্রসাদের গুণে আকৃষ্ট হয়ে তাকে কৃষ্ণনগরের রাজসভায় যােগদানের জন্য আমন্ত্রণ জ্ঞাপন করেন। কিন্তু রামপ্রসাদ তাতে স্বীকৃত হন নি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাকে প্রচুর ভূসম্পত্তি এবং 'কবিরঞ্জন' উপাধি দান করে সম্মানিত করেন। রামপ্রসাদ সম্ভবত ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি কোন এক সময় স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে গঙ্গাগর্ভে সমাধি লাভ করেন বলে প্রসিদ্ধি আছে। রামপ্রসাদ অসংখ্য শাক্ত পদ রচনা করা ছাড়াও 'কালীকীর্তন' এবং 'বিদ্যাসুন্দর' রচনা করেছিলেন।


রামপ্রসাদের 'কালীকীর্তনে'র সামান্য অংশমাত্রই পাওয়া গেছে বলে মনে হয়। কারণ প্রাপ্ত অংশে পার্বতী উমার কাহিনীই শুধু আংশিক বর্তমান। তার 'বিদ্যাসুন্দর' খুব উল্লেখযােগ্য রচনা বলে বিবেচিত হয় না। এই কাব্যটি ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দরের পর রচিত হয়েছিল। এতে ভারতচন্দ্রের প্রভাব বর্তমান, কিন্তু ভারতচন্দ্রের মনোেহারিত্ব এতে নেই। ডঃ শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য বলেন, "বিদ্যাসুন্দরের মত বিপুলায়তন ও বিষয়ধর্মী কাব্য রচনা প্রসাদী প্রতিভার স্বধর্ম নহে.....বিদ্যাসুন্দর কাব্য প্রসাদের সহজ প্রতিভার পরিচয় নহে। এজন্য সাহিত্য হিসাবে ইহার স্থান খুব উল্লেখযােগ্য নহে।"


কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেনের কৃতিত্ব একান্তভাবেই নির্ভরশীল তার শাক্ত পদাবলীর উপর। কিন্তু শাক্ত পদাবলীতেও রামপ্রসাদ সেনের অন্ততঃ একজন 'রামপ্রদাস'-নামধারী প্রতিদ্বন্দ্বী রয়ে গেছেন—তিনি 'দ্বিজ রামপ্রসাদ'। এই উভয় রামপ্রসাদের পদ এমনভাবে মিলে মিশে আছে যে তাদের পৃথক্ করা অসম্ভব ব্যাপার। ঢাকা জেলার মহেশ্বরদি পরগণার চিনিশপুর কালীবাড়ির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন অপর এক রামপ্রসাদ—ইনি ছিলেন ব্রাহ্মণ-সন্তান। অনুমান হয়, 'দ্বিজ রামপ্রসাদ' ভণিতা-যুক্ত যাবতীয় পদই তাঁর রচনা, এই ভণিতার বাইরেও তার পদ থাকা অসম্ভব নয়। চিনিশপুরের রামপ্রসাদও ছিলেন কালীসাধক। ইনিও সম্ভবতঃ বৈদ্য রামপ্রসাদের সমসাময়িক ছিলেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে, এরই কন্যার নাম ছিল জগদীশ্বরী এবং ইনিই রামপ্রসাদের বেড়া বাঁধতে সহায়তা করেছিলেন। গবেষক উঃ শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য কতকগুলি বিশিষ্ট লক্ষণের সাহায্যে কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ এবং দ্বিজ রামপ্রসাদের পদগুলিকে কতকাংশে পৃথক্ করবার পদ্ধতির কথাও বলেছেন; আবার কেউ কেউ 'কবিওয়ালা’ রামপ্রসাদ চক্রবর্তী-রচিত কিছু শাক্ত পদের কথাও উল্লেখ করেন। 'ডিক্রি-ডিস্মিস্' প্রভৃতি শব্দযুক্ত পদগুলি কবিওয়ালা রামপ্রসাদ রচিত বলেই তারা মনে করে থাকেন।


রামপ্রসাদ উমাসঙ্গীত এবং শ্যামাসঙ্গীত-উভয় ধারার স্রষ্টা এবং উভয় ধারাতেই তিনি যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি শুধু সঙ্গীত রচনা করেই ক্ষান্ত হননি, উক্ত সঙ্গীতে একপ্রকার বিশেষ সুর আরােপ করে সঙ্গীতগুলিকে আরও তাৎপর্যময় করে তুলেছে—এই বিশেষ সুরটি 'প্রসাদী সুর' নামেই সাধারণতঃ পরিচিত। এই বিশেষ সুরটি ছাড়া যেন শ্যামাসঙ্গীতের পূর্ণ আমেজ আসে না বলেই অপর সকল কবির শাক্ত পদগুলিও প্রসাদী সুরেই গীত হয়ে থাকে। এই প্রসাদী সুর ও সঙ্গীতের এমনই একটা মােহনীয় প্রভাব রয়েছে, যার ফলে তান্ত্রিক সাধনায় অদীক্ষিতরাও অন্ততঃ উমা সঙ্গীতের মাতা ও সন্তানের সহজ সম্বন্ধটির রসগ্রহণে অপারগ হয় না। রামপ্রসাদ রচিত উমাসঙ্গীতের এই বিশিষ্টতা বিষয়ে জনৈক সমালােচক লিখেছেন ঃ "রামপ্রসাদ আবার তাহার কালীস্তুতির সহিত দুর্গার বাল্য ও বিবাহিত জীবনের কাহিনী সংযুক্ত করিয়া এবং আগমনী ও বিজয়া বিষয়ক গান প্রবর্তন করিয়া বাঙালীর মাতৃ-কল্পনাকে সম্পূর্ণতা দান করিলেন। কালীর দুর্বোধ্য, ভয়-দেখানাে আচরণের সহিত উমার বাৎসল্য রসে অভিষিক্ত, স্নেহের দুলালী কন্যামূর্তি এক হইয়া গিয়া বাঙালীর মনে মায়ের কঠোর ও কোমরূপ যেন অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশিয়ে গেল শ্মশানের নিঃসঙ্গতা, ভয়াবহতা ও গৃহাঙ্গনের পরিচিত স্নেহআবেষ্টনের মধ্যে আর কোন ব্যবধান রহিল না। বিশ্ববিধানের দুৱেঁয়তা মমতা-পারাবারে ডুবিয়া গেল।"


উমাসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য:

রামপ্রসাদের উমাসঙ্গীতগুলির আরাে কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করবার মতাে। বাঙালীর গার্হস্থ্য ও সামাজিক জীবনও পদগুলির মধ্যে ধরা পড়েছে। মাতৃহৃদয়ের সে সকরুণ বেদনা সাধারণতঃ কোথাও কোথাও প্রকাশের ভাষা পায় না, তাও এখানে উপেক্ষিত হয় নি। বরং মাতৃত্বের বেদনা ও বাৎসল্য-মহিমাই উমাসঙ্গীতের কথা আগমনী ও বিজয়ার পদগুলিকে পরম মাধুর্যে মণ্ডিত করে তুলেছে। উমাসঙ্গীতের এই সামাজিক এবং সাহিত্য-মূল্য সাধারণ পাঠকের নিকট গ্রহণীয় হলেও ভক্ত পাঠক এর আধ্যাত্মিক দিকটাকেও উপেক্ষা করতে পারে না। এই উমাসঙ্গীতের যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ করে ডঃ শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন "বিশ্বজননীকে কন্যারূপে কল্পনা ও আরাধনা ভারতীয় অধ্যাত্মসাধনার অন্যতম আশ্রয় এবং এই সাধনাকে আশ্রয় করিয়াই মাতৃহৃদয়ের বাৎসল্য অপূর্ব অধ্যাত্মরূপ লাভ করিয়াছে। ......অধ্যাত্মসাধনার গৃঢ় রসকে দৈনন্দিন জীবনে এই ধরনের রূপান্তর বিরল। রামপ্রসাদের আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ইহাদের সহজ, সরল, অকপট প্রাণবন্ত ভাষা, এবং এই ভাষারূপের সঙ্গে বাঙালীর দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনের পরিচয় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ.এই জাতীয় গানের ভাষায় সকরুণ ইঙ্গিত, ইহার অনাবিল আবেশ এবং ইহাদের একান্ত ঘরােয়া সুরের মধ্যে করুণ মাধুর্যের ব্যাপ্তি বাঙালীর ভাবমুগ্ধ চিত্তকে এক মুহূর্তে জীবনের গভীরতার মধ্যে টানিয়া লয়।"


শ্যামা-সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য:

উমাসঙ্গীতে রামপ্রসাদ যে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন, তা আরাে যেন বিকশিত হয়ে উঠেছে। উমাসঙ্গীতে বিষয়ই শুধু বিশিষ্টতা লাভ করেছিল, স্বভাবতঃই তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, ভাব, ভাষা, ছন্দ-অলঙ্কারাদি ঐশ্বর্য। শ্যামাসঙ্গীতে স্বভাবতঃই রয়েছে যে নিগূঢ় অধ্যাত্মসাধনার ইঙ্গিত, তাতে জনজীবনের সঙ্গে যােগযুক্ত করবার মতাে অসাধ্যসাধন করেছেন রামপ্রসাদ। বাঙলার পল্লী জীবন থেকে উপমাদি অলঙ্কার সংগ্রহ করে সাধক কবি রামপ্রসাদ তাঁর কাব্যে যে অপরিমেয় ঐশ্বর্য সংযুক্ত করেছেন, তাতে শুধু অধ্যাত্মসাধনার ইঙ্গিতটিই সুব্যক্ত হয়নি, সমসাময়িক বাংলার সামাজিক জীবনেরও একটা বাস্তব ও বিশ্বাস্য চিত্রও তাতে ফুটে উঠেছে। বাঙলাদেশের জনমজুর, কুলু, কামার, চাষী বা মাঝির জীবনও রামপ্রসাদের শাক্তপদে একটা বিশেষ মাত্রা লাভ করেছে। এ প্রসঙ্গে রামপ্রসাদের কয়েকটি পদের উল্লেখ অসমীচীন হবে না ও 'মা আমায় ঘুরাবে কত', 'খুলে দাও মা চোখের ঠুলি’, ‘একে তাের জীর্ণ তরী', 'দু'খান তরী নিমক ভারী প্রভৃতি পদের মধ্যে রামপ্রসাদের মনােজীবনের চিত্রটি স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে।


রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীতে সাধনতত্ত্বও অব্যক্ত নয়। বেদ-বেদান্ত-পুরাণাদির প্রসঙ্গ কিংবা নানাবিধ তত্ত্বকথাও এই সমস্ত পদে বর্তমান, কিন্তু রামপ্রসাদ শাস্ত্রীয় বিষয়বস্তুর জটিলতা এবং দুর্বোধ্যতাকে পরিহার করে তার শাস্ত্ৰবােধকে জীবনবােধের সঙ্গে সমন্বিত করে নিয়েছেন। দৈনন্দিন জীবন ও অধ্যাত্মসাধনাকে এমনভাবে এক করে নেবার মধ্যেই কবির শাক্তসঙ্গীতের চরম সাহিত্যিক সার্থকতা সম্পাদিত হয়েছে।


বিভিন্ন জাতীয় ছন্দ রচনায় রামপ্রসাদ যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বলতে গেলে, রামপ্রসাদই সর্বপ্রথম লৌকিক ছড়ার ছন্দকে সার্থকভাবে বাঙলায় ব্যবহার করে পথপ্রদর্শকের মর্যাদা লাভ করেছেন। তবে চণ্ডীদাসের মতােই রামপ্রসাদের পদগুলিতে এই স্বতঃস্ফুর্ত সাবলীলতাই প্রধান অলংকার। শাক্তপদাবলীর অপর কবি কমলাকান্ত যেমন কাব্য-আঙ্গিক সম্পর্কে সচেতনতা দেখিয়েছেন, রামপ্রসাদে তা পাওয়া যাবে না; আর এখানেই রামপ্রসাদের স্বকীয়তা।


[খ] কমলাকান্ত

বৈষ্ণব পদকর্তাদের সংখ্যা প্রায় অগণিত এবং তাদের মধ্যে উৎকৃষ্ট কবির সংখ্যাও কম নয়। সেই তুলনায় শাক্তপদকর্তার সংখ্যা অনেক কম, উল্লেখযােগ্য কবি তাে মুষ্টিমেয় মাত্র। তা-ও এঁদের অনেকেই দু চারটি করে পদ রচনা করেছেন। রামপ্রসাদ ছাড়া আর একজন মাত্র কবিরই নাম উল্লেখ করা যায়, পদের সংখ্যা এবং উৎকর্ষে রামপ্রসাদের সঙ্গেই যার নাম উচ্চারিত হয়ে থাকে—ইনি সাধক কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। কমলাকান্ত বাঙলা ভাষায় 'সাধক-রঞ্জন নামক তন্ত্রসাধনার যে গ্রন্থ রচনা করেন, তাতে আত্মপরিচয়-সূত্রে নিজের সম্বন্ধে কিছু তথ্য পরিবেষণ করে গেছেন। কমলাকান্তের পৈতৃক বাসভূমি ছিল অম্বিকা কালনা। তিনি সম্ভবতঃ ১৭৭২ খ্রীঃ বর্ধমান জেলার চান্না গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার চারিত্রিক মাধুর্য এবং পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে বর্ধমান-রাজ তেজচন্দ্র বর্ধমান শহরের কোটালহাট অঞ্চলে তার আবাসস্থল নির্মাণ করিয়ে দেন। সম্ভবতঃ ১৮০৯ খ্রীঃ থেকে কবি সেই গৃহে বসবাস করেন এবং এখানেই তার সাধনপীঠ স্থাপন করে সাধন-ভজন করতেন। আর ১৮২১ খ্রীঃ সাধক কবি কমলাকান্ত দেহান্তরিত হন। বর্ধমান রাজবংশের কেহ কেহ কমলাকান্তের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।


সাধক কমলাকান্তের জীবনে বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল বলে জনশ্রুতি আছে। জগজ্জননী কালী বাদ্দীকন্যারূপে তাকে দেখা দিয়েছিলেন; তার সঙ্গীতে মুগ্ধ দস্যুদল তার নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল প্রভৃতি কাহিনী সত্য না হলেও সমসাময়িক মানুষের মনে যে তিনি অতিশয় শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছিলেন এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।


কমলাকান্ত ন্যূনাধিক তিনশত পদ রচনা করেছিলেন। এদের মধ্যে উমাসঙ্গীত এবং শ্যামা সঙ্গীত—উভয় জাতীয় পদই রয়েছে তবে উমাসঙ্গীত তথা আগমনী-বিজয়ার গানে কমলাকান্ত যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে, তা অতুলনীয় বিবেচিত হয়ে থাকে। এমন কি উমাসঙ্গীতের স্রষ্টা স্বয়ং রামপ্রসাদের পদগুলিও কাব্যাংশে কমলাকান্তের পদের তুলনায় হীনপ্রভ বলে মনে হয়।


উমার বাল্যলীলা, কন্যা উমার জন্য মা মেনকার অন্তর-বেদনা, কন্যাকে পিতৃগৃহে না আনার জন্য স্বামী হিমালয়ের প্রতি অনুযােগ-অভিযােগ, উমার প্রতি আদর-যত্ন এবং তার ফিরে যাবার ব্যাপারে মেনকার ঘােরতর আপত্তি প্রভৃতি বর্ণনায় কমলাকান্ত এমন গার্হস্থ্য পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন, যাকে বাঙালী-জীবনের শাশ্বত রূপেই গ্রহণ করা চলে। আবার শ্যামাসঙ্গীত-রচনাতেও কমলাকান্তের কৃতিত্ব উপেক্ষণীয় নয়। আরাধ্যা দেবীর স্বরূপ এবং কবির নিজস্ব ধ্যান-ধারণা-প্রকাশে তার কয়েকটি পদ সত্যই অপূর্ব লাভ করেছে। সদানন্দময়ী কালী', 'তাই শ্যামারূপ ভালবাসি, শুকনাে তরু মঞ্জুরে না' মজিল মনভ্ৰমরা প্রভৃতি গানের ভাষা এবং বিন্যাস-পদ্ধতি অতিশয় মার্জিত ও দৃঢ়বদ্ধ। কল্পনা, ভক্তিভাব প্রভৃতির সঙ্গে উৎকৃষ্ট রচনারীতির মিশ্রণে কমলাকান্তের পদগুলি রসােত্তীর্ণ হয়ে কালজয়ী হবার সুযােগ পেয়েছে। রামপ্রসাদের সঙ্গে কমলাকান্তের কবিপ্রতিভার প্রধান পার্থক্য কবিতার সচেতন অলংস্কৃতিতে। রামপ্রসাদের পল্লীপ্রাণতা কমলাকান্তে অনুপস্থিত। কমলাকান্ত ছন্দ ভাষা উপমা রূপকের ব্যবহারে অতিসচেতন কবি। অধ্যাপক ডঃ সত্রাজিৎ গােস্বামী তুলনামূলক বিচারে তাই মন্তব্য করেছেন, “কাব্যশরীর নির্মাণে চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির যে পার্থক্য, শাক্তপদের রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তেরও সেই পার্থক্য।”