'শিবায়ন'-কে কি মঙ্গলকাব্যরূপে অভিহিত করা চলে? এর বিশিষ্টতা উল্লেখ করে এই কাব্যের একজন প্রধান কবির কৃতিত্বের পরিচয় দাও।

"শিবায়ন কাব্যের বিষয় প্রধানতঃ পৌরাণিক হওয়া সত্ত্বেও লৌকিক জীবনের সঙ্গে এর সম্পর্কই সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ।" -উক্তিটির যাথার্থ্য বিষয়ে আলােচনা কর।


শিবের উদ্ভব :

'শিবায়ন’ বা 'শিবমঙ্গল' শিবের মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল। আবার তিনটি প্রধান মঙ্গলকাব্যের উদ্দিষ্ট দেবতা মনসা, চণ্ডী ও ধর্মঠাকুর মূলতঃ অনার্য সমাজ থেকে আগত, কিন্তু শিব পৌরাণিক দেবতা—এইদিক থেকে শিবায়নের বৈশিষ্ট্য অবশ্যস্বীকার্য। আবার এ কথাও সত্য-আদিতে শিবও ছিলেন প্রাগার্য দেবতা, তবে সুদীর্ঘকাল অনার্য সমাজ থেকে নবাগত দেবদেবীদেরও তিনি সহজেই আপন করে নিতে পেরেছিলেন। তাই দেখি, অপরাপর মঙ্গলকাব্যের দেখণ্ডে শিবই প্রধান দেবতা এবং বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীগণ তার সঙ্গেই সহজ আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ হয়ে দেবসমাজে কিছুটা আভিজাত্য লাভ করে নিজেদের আসন পাকা করে নিয়েছেন। কাজেই প্রতিটি মঙ্গল কাব্যেরই দেবখণ্ডে শিবকাহিনী বর্ণিত হওয়াতে প্রকারাস্তরে সব মঙ্গলকাব্যকেই শিবমঙ্গল-যুক্ত কাব্য বলে অভিহিত করলে নিতান্ত মিথ্যা বলা হয় না।


শিব বৈদিক দেবতা না হলেও কোন অর্বাচীন দেবতা নন, বরং বৈদিক দেবতাদের চেয়েও তিনি প্রাচীনতর। সিন্ধু সভ্যতায় যে সকল সীলমােহর পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে ধ্যানারসীন শিবমূর্তির পশুপতিরূপকে এখন পণ্ডিতজন প্রায় সর্বাবাদিসম্মতভাবেই স্বীকার করে নিয়েছেন বলা চলে। অতএব শিব যে প্রাগার্য দেবতা—একথা স্বীকৃত। দ্রাবিড়-সমাজের ‘শিবন্' এবং 'শেম্ব' নামক দেবতাদ্বয় যে আর্য 'শিবশম্ভু'তে পরিণত হয়েছেন, শুধু শব্দসাদৃশ্য থেকেই তা মেনে নেওয়া চলে। হিমালয়ের কৈলাসবাসী পূর্বেই তাঁর আ্যীকরণ সম্পন্ন হয়ে যাওয়াতে তিনি অনেক কাল আগেই পৌরাণিক দেবতায় পরিণত হয়েছিলেন। দেবসমাজে শিব নিকষ কুলীন নন বলেই সম্ভবতঃ ‘রজতগিরিসন্নিভ’ দেবতা যিনি হিমালয়-কন্যা পার্বতীকে বিবাহ করেছেন এবং মহাভারতে "কিরাত-বেশে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, পশুপতিরূপে তিনি ব্যাধ বা কিরাত জাতির বধ্য পশুকুলের সঙ্গে জড়িত, সেই মহাদেব যে আবার কিরাত-জাতির সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তা' কি অস্বীকার করা যায় ? পুরাণে রুদ্র ও শিব অভিন্ন। রুদ্র বৈদিক দেবতাপুরাণে তিনি সংহারকর্তা, কিন্তু নামটি 'শিব' অর্থাৎ 'মঙ্গলময়'। অতএব পৌরাণিক শিব-কল্পনায় প্রাগার্য সিন্ধু সভ্যতার পশুপতি মুর্তি, দ্রাবিড় জাতির ‘শিবন-শে' কিরাত জনগােষ্ঠীর মহাদেব এবং বৈদিক 'রুদ্র'এ সমস্ত উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটেছে; শঙ্কর সঙ্কর-জাতীয় দেবতা বলেই বৈদিক দেবতায় উন্নাসিকতা তার মধ্যে থাকবার কথা নয়, তাই তিনি আশুতােষ—অল্পে তুষ্ট এবং সব অবস্থাতেই মানিয়ে নিতে পারেন। পুরাণে এবং মঙ্গলকাব্যের দেবখণ্ডে আমরা এই শিবকেই দেখতে পাই।


শিবায়নের বৈশিষ্ট্য:

পৌরাণিক শিবের মাহাত্ম্য বর্ণনাই যদি শিবায়ন' কাব্যের বিষয়বস্তু হতাে, তবে এটিকে আর মঙ্গলকাব্য বলা সঙ্গত হতাে না। এটি হতাে তবে বাংলা পুরাণ অথবা পুরাণের অনুবাদ কিংবা সারসঙ্কলন। কিন্তু শিবায়ন কাব্যের কাহিনী বিশ্লেষণ করলে আমরা পৌরাণিক শিব ছাড়াও অপর এক লৌকিক শিবের সন্ধান পেয়ে থাকি। মঙ্গলকাব্যের লক্ষণযুক্ত এই কাহিনীটির জন্যই 'শিবায়ন' কাব্য মঙ্গলকাব্য বলে অভিহিত হবার যােগ্যতা অর্জন করেছে।


যাবতীয় মঙ্গলকাব্যের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে 'শিবায়ন' কাব্যকেই সর্বাপেক্ষা অর্বাচীন বলে মনে হলেও, সম্ভবতঃ শিবায়ন কাব্যের উদ্ভব ঘটেছিল চৈতন্য-পূর্ব যুগেই। চৈতন্য-জীবনীকার বৃন্দাবন দাস তৎকাল-প্রচলিত 'শিবের গায়েন'-এর কথা উল্লেখ করেছেন এবং শিবের গান শুনে স্বয়ং মহাপ্রভু যে শংকর মূর্তি ধারণ করতেন, এই দুর্লভ সংবাদটি বৃন্দাবন দাস আমাদের জানিয়ে গেছেন। এ থেকে পরােক্ষভাবে আমরা শিবের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রেরও একটি পরিচয় পেয়ে থাকি। বস্তুতঃ বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে এবং বৈষ্ণবােত্তম চৈতন্যদেবের মনে শিবের এই মর্যাদাবােধহেতু শিবকে আমরা জাতীয় দেবতার আসনে স্থান দিতে পারি।


পূর্বে শিবের উদ্ভব-বিষয়ে আলােচনা-প্রসঙ্গে যে প্রাগার্য, অনার্য ও আর্য ধারণার সংমিশ্রণের কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে বৌদ্ধ ও জৈন প্রভাব। এ-বিষয়ে ডঃ আশুতােষ ভট্টাচার্য বলেন “গৌতম বুদ্ধের জীবনাদর্শ হইতে পৌরাণিক শিবের পরিকল্পনা হইয়াছিল, সেইজন্য বাংলার বৌদ্ধগত পৌরাণিক শৈব ধর্মমতের মধ্যে নিজের আদর্শেরই সন্ধান পাইল। জিন তীর্থঙ্করের জীবনাদর্শও গৌতম বুদ্ধ এবং এই পৌরাণিক শিবের আদর্শ হইতে স্বতন্ত্র ছিল না সেইজন্য এই বিরাট জৈন সম্প্রদায়ও ক্রমে নব-প্রতিষ্ঠিত শৈব সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিলীন হইয়া গেল। এইভাবে দেখিতে পাই, খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর পর হইতে বাংলার শৈবধর্ম এক বিরাট সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।” বাংলার সর্বসম্প্রদায়ের নিকট গ্রহণযােগ্য এই জাতীয় শিব’ই বাংলার যাবতীয় সম্প্রদায়ের মঙ্গলকাব্যসমূহের দেবখণ্ডে মর্যাদার আসন লাভ করেছেন। তবে শিবায়ন কাব্যে শিবের এক স্বতন্ত্র এবং বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে বলেই এত সব মঙ্গলকাব্যে শিবকাহিনী বর্ণিত হওয়া সত্ত্বেও পৃথক শিবায়ন কাব্যের সার্থকতা রয়েছে।


কাব্য-পরিচয়: শিবায়ন কাব্যের দু’টি ধারা- (১) একটি ‘মৃগলুব্ধ’ বা শিব-চতুর্দশীর মাহাত্ম্যসূচক কাব্য, (২) অপরটিই প্রকৃত 'শিবায়ন' বা 'শিবমঙ্গল কাব্য'। বিভিন্ন পুরাণ থেকে শিব কাহিনী সংগ্রহ করে এই ‘মৃগলুব্ধ’ কাহিনী রচিত হয়েছে। এটি একান্তভাবেই পৌরাণিক কাহিনীর সারসঙ্কলন—মঙ্গলকাব্যের কোন লক্ষণই এতে উপস্থিত নেই। অতএব মঙ্গলকাব্যরূপে এর আলােচনা নিষ্প্রয়ােজন। দ্বিতীয় ধারার কাব্য 'শিবায়ন' বা 'শিবমঙ্গল' কাব্যটিই প্রকৃতপক্ষে মঙ্গলকাব্যধারায় অন্তর্ভুক্ত হবার যােগ্যতা রাখে। অতএব শিবায়ন কাব্য বলতে আমরা শুধু এই ধারাটিকেই গ্রহণ করবাে।


অপর সকল মঙ্গলকাব্যের মতােই 'শিবায়ন কাব্যেও রয়েছে দু'টি অংশ—একটি দেবখণ্ড এবং অপরটি নরখণ্ড বা মূল কাহিনী। এই দেবখণ্ডও হরপার্বতীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত। কিন্তু এই খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত শিব একান্তভাবেই পৌরাণিক শিব—এই কাহিনীও অপরাপর মঙ্গলকাব্যে বর্ণিত দেখণ্ডেরই অনুরূপ। এতে শিবায়ন কাব্যকারগণ কোন উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিতে পারেন নি। এর দ্বিতীয় খণ্ড বা নরখণ্ডের নায়কও শিব, কিন্তু এই শিব একান্তভাবেই লৌকিক শিব। কোন পুরাণে এই শিবের সন্ধান পাওয়া যাবে না। লৌকিক বাংলার নিম্নবিত্ত সমাজে এই লৌকিক শিবের উদ্ভব- ইনি স্বয়ং কৃষিজীবী এবং কৃষিজীবী বাঙালী জীবনের প্রতীক। অপর সকল মঙ্গলকাব্যে উদ্দিষ্ট দেবতা নরসমাজে দেব-মানবে কিংবা মানবে-মানবে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে আত্মপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়ে থাকেন, এখানে সেই দ্বন্দ্ব সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। এখানে শিব স্বয়ং কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত এবং তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠা বা মাহাত্ম্য প্রচারের কোন চেষ্টাই লক্ষিত হয় না। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতাে তিনি এখানে কোন ভক্ত বা মানুষকে আশ্রয় করেন নি, তিনিই কাব্যের নায়ক। অতএব 'শিবায়ন' কাব্যকে শিবের মাহাত্ম্য প্রচার কাহিনী না বলে শিবকাহিনী বলে অভিহিত করাই সঙ্গত।


কাহিনী-বিশ্লেষণ ও আলােচনা: ‘শিবায়ন’ কাহিনীর দেবখণ্ডে দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগ, সতীর পার্বতীরূপে জন্মগ্রহণ, মহাদেবের সঙ্গে বিবাহ, হরগৌরীর সংসার যাত্রা এবং দারিদ্র্যের জন্য পরস্পরের প্রতি দোষারােপ এবং সর্বশেষ সমস্যা সমাধানের উপায়স্বরূপ দেবী পার্বতীর পরামর্শে মহাদেবের চাষবাস-আদির উদ্দেশ্যে মর্ত্যভূমিতে আগমন বর্ণিত হয়েছে। এরপরই মর্ত্যখণ্ড বা নরখণ্ড যেখানে মহাদেব ইন্দ্রের নিকট থেকে জমি পাট্টা নিয়ে মনুষ্যোচিত জীবন যাপন আরম্ভ করেন। ভীমের সহায়তায় জমি চাষ করে মহাদেব প্রচুর শস্য লাভ করে কৈলাসের কথা ভুলে গেলেন। এরপর বিভিন্ন লৌকিক ঘটনা কোচপট্টিতে মহাদেবের যাতায়াত, কুচনীর কাছ থেকে ভিক্ষাগ্রহণ, দেবী পার্বতী কর্তৃক স্বর্গ থেকে মর্ত্যলােকে মশা, মাছি, ডাশ প্রভৃতি প্রেরণ, বাগদিনী রূপে দেবীর মর্ত্যলােকে আগমন ও মহাদেবকে ছলনা, শাঁখারিবেশি মহাদেব-কর্তৃক দেবীকে ছলনা প্রভৃতি ঘটনা পরস্পরের মধ্য দিয়ে হরপার্বতীর পুনর্মিলন বর্ণিত হয়েছে। 'শিবায়ন কাব্যে কোন দ্বন্দ্ব সংঘাত না থাকায় এর গতি অনেকটা মন্থর। মহাদেব এখানে বাঙালী কৃষকের প্রতিনিধি। পল্লী বাঙলার প্রকৃত জনজীবনের কাহিনীই এর ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। এইদিক থেকে শিবায়ন কাব্যকেই সমস্ত মঙ্গলকাব্যের মধ্যে সর্বাধিক বাস্তবধর্মী বা 'রিয়ালিস্টিক বলে অভিহিত করা চলে। ধর্মমঙ্গল কাব্যের লাউসেন, রঞ্জাবতী, মনসামঙ্গলের চাদ বা লখিন্দর অথবা চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতি, খুল্লনা বাঙালী দরিদ্র পল্লীবাসীর প্রতিনিধি নয়, এমনকি ব্যাধসন্তান কালকেতুকেও কৃষিজীবী বাঙালীর প্রতিনিধি বলে গ্রহণ করা যায় না। 'শিবায়ন' কাব্যের শিবই বাঙালী চাষী জীবনের প্রতীক—তারই জীবনযাপন পদ্ধতি, তার পরিজন ও অন্তঃপুরের চিত্র ‘শিবায়নে যথাযথভাবে রূপায়িত হয়েছে বলেই এর আকর্ষণযােগ্যতা অনেক বেশি। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীগণ পরিপূর্ণভাবে মানবিক গুণসম্পন্ন নন—এদের কেউ দেবতা, কেউ বা অপদেবতা শুধু শিবায়ন কাব্যের হরপার্বতীর চরিত্রই একান্তভাবে বাস্তব ও মানবধর্মী হয়ে উঠেছে। জনৈক ঐতিহাসিক যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “এ দেবাদিদেব ও জগন্মাতা পার্বতীর কৈলাসজীবন নয়, এ অতীত বাংলার কোন শিবদাস ভট্টাচার্য এবং তস্য ভার্যা পার্বতী ঠাকুরাণীর জীবন কাহিনী।"


গ্রন্থে শিবচরিত্রের যে বিকৃতি সাধন করেছেন কবি, তার জন্য দায়ী সমসাময়িক যুগমানস। এ কথা ভুললে চলবে না যে কাব্যটি রচিত হয়েছিল সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে। গ্রন্থের অপর একটি উল্লেখযােগ্য চরিত্র নারদ। গ্রন্থে বর্ণিত বহু অকাণ্ড কুকাণ্ডের জন্য নারদ প্রত্যক্ষভাবে দায়ী হলেও নারদ কিন্তু ভাড়দত্তের মত খলচরিত্র নন বরং তাঁর চরিত্রে রয়েছে বিদূষকের ভূমিকা। তার ভূমিকা বিশ্লেষণে তাকে সত্যকার বাঙালীর একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত বলেই মেনে নিতে হয়।


‘শিবায়নে' সুসঙ্গত ও কল্যাণবােধসঞ্জাত কৌতুকরসাশ্রিত মধুর রসের যে সন্ধান পাওয়া যায়, মধ্যযুগের পক্ষে তা ঈর্ষণীয় বলেই মনে হয়।


(ক) রামেশ্বর ভট্টাচার্য: কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য ছিলেন অষ্টাদশ শতকের শক্তিমান কবি এবং 'শিবায়ন' কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর পিতার নাম লক্ষ্মণ এবং মাতা রূপবরতী। তিনি মেদিনীপুর জেলার যদুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও জনৈক ব্যক্তির অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং কর্ণগড়ের রাজার আশ্রয় লাভ করেন। রাজা যশােবন্ত সিংহের আদেশেই কবি রামেশ্বর তার কাব্য রচনা করেন। রামেশ্বর তার কাব্যের নাম উল্লেখ করেছেন ‘শিবসঙ্কীর্তন’রূপে তবে সাধারণভাবে তার কাব্যটি 'রামেশ্বরের শিবায়ন' নামেই সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেছে।


কবি রামেশ্বর তাঁর কাব্যরচনাকাল বলে যে শ্লোকটি রচনা করেছেন, তার অর্থ উদ্ধার করা দুষ্কর। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত উপাদান বিচার করে পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে রামেশ্বর সম্ভবতঃ ১৭১২ খ্রীঃ তার কাব্য রচনা করেছিলেন। কবির কাব্যের উভয় খণ্ডেই শিবের চরিত্র অঙ্কনে কবির দৃষ্টি ছিল সমান সজাগ। পৌরাণিক শিবকাহিনী রচনায় তিনি শুধু বিভিন্ন পুরাণের সহায়তাই গ্রহণ করেন নি, কালিদাসের 'কুমারসম্ভব' কাব্যকেও যথাসম্ভব কাজে লাগিয়েছেন। তবে পৌরাণিক শিবকাহিনী রচনা করতে গিয়ে তিনি যেমন কতকগুলি বাঁধাবাঁধি ধারণার মধ্যে পড়ে গিয়ে স্বচ্ছন্দ হবার সুযােগ পাননি, তেমনি তিনি মনের সুখে আপনাকে ছড়িয়ে দেবার পূর্ণ সুযােগ নিয়েছেন লৌকিক শিবের কাহিনী রচনায়। এই অংশে একদিকে হরগৌরীর সংসার এবং অপরদিকে মর্ত্যলােকে শিবের স্বাধীন, কিন্তু উন্মার্গ জীবনযাত্রা-উভয় ক্ষেত্রেই কবির সার্থকতা অপরিসীম। কৈলাসে হরগৌরীর সংসারের একটি পারিবারিক চিত্র-পরিবারের পরিজনবর্গ মধ্যাহ্নভােজনে ব্যস্ত


“তিন ব্যক্তি ভােক্তা, একা অন্ন দেন সতী।

দুটি সুতে সপ্ত মুখ পঞ্চমুখ পতি।..

তিন জনে বার মুখ পাঁচ হাতে খায়। 

এই দিতে এই নাই হাড়ি পানে চায়।..

সুক্তা খেয়ে ভােক্তা চায় হস্ত দিয়া শাকে। 

অন্নপূর্ণা অন্ন আন রুদ্রমূর্তি ডাকে।। 

কার্ত্তিক গণেশ ডাকে অন্ন আন মা। 

হৈমবতী বলে বাছা ধৈর্য ধরে খা।।"


কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর কথা স্মরণে রেখেও বলা যেতে পারে যে এমন বাস্তব চিত্রের নিদর্শন সমগ্র মধ্যযুগের কাব্য-সাহিত্যেই দুর্লভ। হরগৌরীর সংসারে নিত্য অভাব আর এই অভাবের জ্বালা পুড়িয়ে পাক করে দিয়েছে প্রতিটি চরিত্রকে। এমন অভাবের চিত্র এমন সর্বব্যাপ্ত দুঃখের চিত্র আধুনিক- পূর্ব বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায় না। পার্বতীর হাতে শাখা নেই, বড় দুঃখেই তিনি বলেন


লজ্জায় লােকের মাঝে লুকাইয়া রই। 

হাত নাড়া দিয়া বাড়া কথা নাহি কই।।


দেবী হাত নাড়া দিয়ে কথা বলবার সুখ পান না বলে দুঃখ করেও মহাদেব মুখ নাড়া দিতে ছাড়েন না-তিনি বলেন


বাপ বটে বড় লােক বল গিয়া তারে।

জঞ্জাল ঘুচুক যাও জনকের ঘরে।


খুব উচ্চতর আদর্শ সৃষ্টি করতে না পারলেও রামেশ্বর শিবদুর্গার চিত্রাঙ্কনে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। যদিও তাঁদের দেবীমহিমা মানবসত্তাকে অতিক্রম করতে পারেনি। রামেশ্বরের 'শিবশঙ্ককীর্তন' কাব্যপাঠেই বােঝা যায় যে যুগপ্রভাবে মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীগণ স্বর্গত্যাগ করে মর্তভূমিকেই যেন তাদের স্বাভাবিক আবাসভূমি বলে গ্রহণ করেছিলেন। গতানুগতিক কাহিনী রচনার বাইরে ছন্দসৃষ্টিতে, ভাবভূমিষ্ঠ বাক্য গঠনে, অলঙ্কার-নির্মিতিতে কিংবা হাস্যকৌতুক সৃষ্টিতে রামেশ্বর যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা, কেবলমাত্র রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের সঙ্গেই তুলিত হতে পারে। অনুপ্রাস-সৃষ্টিতে কবির স্বভাবসিদ্ধ প্রবণতা ছিল, 'ভব্যভাব্য ভদ্রকাব্য ভণে রামেশ্বর' কিংবা 'মটরের মর্দনে মুসুর গেল উড়্যা' প্রভৃতিতে অবশ্য অনুপ্রাসের একটু বাড়াবাড়িই লক্ষ্য করা যায়। রামেশ্বরের কিছু কিছু ভাবগর্ভ উক্তি বহু-প্রচলিত প্রবাদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। যেমন— 'দিনে হও ব্রহ্মচারী, রাত্রে গলাকাটা' কিংবা ‘পুঞ্জী আর প্রবঞ্চনা বাণিজ্যের মূল' প্রভৃতি। রামেশ্বরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ডঃ সুকুমার সেন যথার্থই মন্তব্য করেছেন - "অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে রামেশ্বর অন্যতম। ইহার কাব্যে ভারতচন্দ্রের মত ভাষার চটক নাই সত্য কিন্তু সহানুভূতি এবং মানবিকতা রামেশ্বরের শিবায়নে যেমন আছে এমন অষ্টাদশ শতাব্দীর অপর কোন কবির কাব্যে পাই না।”


এই প্রসঙ্গে একটি কথা স্মরণযােগ্য। কবি রামেশ্বর যে কালে বর্তমান ছিলেন, ইতিহাসের বিচারে সেই কালটি ছিল 'অবক্ষয় যুগের প্রারম্ভ কাল। বাদশা ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বিভিন্ন রাজ্যগুলি যেভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছিল এবং বিদেশীয় বণিকগণ দেশের স্থানে স্থানে ব্যবসা বাণিজ্যের সূত্রে কাঁচা পয়সার লেনদেন করছিল, তার ফলে দেশে প্রাচীন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, অথচ নােতুন ব্যবস্থাও গড়ে উঠতে পারেনি। এই ডামাডােলে সমগ্র দেশে একটা অস্থিরতা দেখা দেয়। পুরাতন মূল্যবােধ তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। দেশময় এই অবক্ষয় সমাজ জীবনে যে প্রভাব বিস্তার করেছিল, সমকালীন কবি রামেশ্বরের কাব্যে তারই প্রতিফলন ছিল অনিবার্য। তাই অতিশয় ক্ষমতাবান লেখক হওয়া সত্ত্বেও যুগপ্রভাবেই রামেশ্বর তাঁর কাব্যকে দোষমুক্ত করে গড়ে তুলতে পারেন নি।


(খ) অন্যান্য কবি 


  • রামকৃষ্ণ রায়— 'কবিচন্দ্র’ উপাধিধারী রামকৃষ্ণ রায় শিবায়ন কাব্যের একজন শক্তিমান কবি ছিলেন। তার পিতার নাম কৃষ্ণ রায়, মাতা রাধাদাসী। তিনি জাতিতে কায়স্থ, নিবাস ছিল হাওড়া জেলার রসপুর গ্রাম। কবি সম্ভবতঃ প্রথম জীবনেই আঃ ১৬২৫ খ্রীঃ কাব্যটি রচনা করেন। তার কাব্যের নাম 'শিবায়ন' বা 'শিবের মঙ্গল'। ২৬ পালায় বিভক্ত তার কাব্য যাবতীয় শিবায়নের মধ্যে সর্ববৃহৎ। এতে তিনি 'হরিবংশ, কালীখণ্ড, স্কন্দপুরাণ, বালিকাপুরাণ’ প্রভৃতি বহু পুরাণ থেকে শিবকাহিনী সংগ্রহ করে তার গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করেন। ফলতঃ কাহিনীগুলি পরস্পরবিচ্ছিন্ন, কোন ঐক্যসূত্রে সামগ্রিকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। মূল কাহিনীর সঙ্গে সম্পর্করহিত বহু কাহিনীও তিনি রচনা করেছেন যার সার্থকতা সংশয়াতীত নয়। এদের মধ্যে আছে-মনসা-কাহিনী, সমুদ্রমন্থন, বলিরাজ ও সাগর রাজার গল্প, অন্ধকবধ, পরশুরাম-রাবণের গল্প, উষা-অনিরুদ্ধ কাহিনী প্রভৃতি। কবি ছন্দ-রচনায় যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা একমাত্র ব্রজবুলি ভাষায় রচিত বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গেই তুলিত হতে পারে। রামকৃষ্ণ-রচিত শিবায়নে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য— এর কিছু গদ্যপংক্তি। যেমন— 'অতঃপর তারা প্রভৃতি দেবতারা সকল শিবের করে প্রহলিকা প্রবন্ধে গৌরীকে সমর্পণ করিয়া কথােপকাল পাল করিয়া হরকে ইঙ্গিত করিতেছেন, অবধান করহ।' -এ প্রায় আধুনিক গদ্যের ধার ঘেঁষে যায়। রামকৃষ্ণের কৃতিত্ব বিষয়ে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন - "বাংলাদেশের যদি কোন কবি গ্রাম্য মঙ্গলকাব্যকে পুরাণের সীমানায় তুলে ধরতে প্রয়াস করে থাকেন, তবে তিনি হলেন শিবমহের কবি পণ্ডিত রামকৃষ্ণ রায়। কাহিনীর ঘনপিনদ্ধ গ্রন্থন-নৈপুণ্য চরিত্রগুলির পৌরাণিক মহিমা ও সংযম, সর্বোপরি কবির মার্জিত ভাষা ও পরিমিত অলঙ্করণ প্রশংসনীয় গৌরব লাভ করেছে; কাব্যের একমাত্র ত্রুটি, তিনি জীবনের লঘু তরল দিকটিকে উপেক্ষা করেছিলেন।”


  • কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী— কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী রামায়ণ মহাভারত এবং যাবতীয় মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন। তাঁর 'শিবমঙ্গল' কাব্যেই তিনি বােধহয় সর্বপ্রথম 'মৎস্যধরা পালা, শপরা পালা’ প্রভৃতি লৌকিক পালা যােগ করেন। লৌকিক শিবের পরিচয় এই কাব্যেই প্রথম যথাযথভাবে ধরা পড়েছে বলে অনুমান করা হয়।