রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার দিক পরিবর্তনে জীবনানন্দ দাশের অবদানের মূল্যায়ন | আধুনিক বাংলা কাব্যধারায় জীবনানন্দ দাশের ঐতিহাসিক ভূমিকা

কবি জীবনানন্দ দাশ

রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই যারা বাংলা কাব্য-সাহিত্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারাসৃষ্টিতে অগ্রবর্তীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং স্বীয় কাব্য-সম্তারে আধুনিক বাংলা কাব্যকে যথােচিত মর্যাদা দান করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাদের অন্যতম এবং সম্ভবতঃ বিশিষ্টতম ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪ খ্রীঃ)। আত্ম-প্রচার বিমুখ এবং নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দীর্ঘ জীবনের অধিকারী ছিলেন না এবং সমকালে তাঁর কাব্যের যথাযােগ্য মূল্যায়ন না হওয়াতে তার প্রাপ্য মর্যাদাও লাভ করেন নি। কিন্তু পরবর্তীকালে তার কবিকৃতি যথার্থ মূল্য লাভ করেছে এবং কাব্য-সাহিত্যের সর্বাধিক প্রবল ধারাটি সম্ভবতঃ তাকেই অনুসরণ করেছিল। ফলে, সাম্প্রতিক কালের বিচারে, রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবিদের মধ্যে জীবনানন্দই সর্বাধিক পরিচিতি ও প্রীতি লাভ করেছেন। আধুনিক বাংলা কবিতার বিশিষ্ট এক আলােচক জীবনানন্দকে আধুনিক কবিদের মধ্যে সর্বাধিক বিমূঢ় বিভ্রান্ত অস্থির কবি বলে উল্লেখ করেছেন।


সাধারণভাবে জীবনানন্দ কবি-রূপে পরিচিত হলেও তার একাধিক উপন্যাস এবং গল্পেরও সন্ধান পাওয়া যায়। বস্তুত আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু-কবলিত হওয়ার ফলে তার রচনার সামগ্রিক পরিচয় সম্ভবতঃ এখনও জানা যায় নি। বিভিন্ন সাময়িকপত্রে মুদ্রিত এবং পাণ্ডুলিপি-আকারে অবস্থিত তার সমগ্র রচনা এখন পর্যন্ত সঙ্কলিত হয়ে উঠতে পেরেছে বলে মনে হয় না। যাহােক, তার যে সমস্ত রচনা গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়েছে, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য 'ঝরাপালক’ (১৯২৭), 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' (১৯৩৬), 'বনলতা সেন' (১৯৪২), 'মহাপৃথিবী' (১৯৪৪), 'সাতটি তারার তিমির' (১৯৬১) ও 'সুদর্শনা’ (১৯৭৩)। তার রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থ 'কবিতার কথা' এবং এ ছাড়া আপাতত তার দুটি উপন্যাস ও কয়েকটি ছােটগল্পেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। জীবনানন্দের গ্রন্থগুলির প্রকাশ-কাল থেকে তাঁর কাব্য রচনার কাল কিংবা পারম্পর্য অনুমান করা সম্ভবপর নয়। কারণ, অনেক বই তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে। অনেক কবিতার রচনাকালের সঙ্গে তার কাব্য-রচনার প্রকাশ-কালের কোন সঙ্গতি নেই, যেমন—রূপসী বাংলার রচনাকাল ১৯৩২ খ্রীঃ হলেও তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে ২৭ বৎসর পর।


জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক’ প্রকাশিত হবার পরই অশ্লীলতার অপরাধে তার কর্মচ্যুতি ঘটেছিল এমন একটা লােকশ্রুতি প্রচলিত আছে। এই প্রথম গ্রন্থে তিনি রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই কাব্যপথে যাত্রা শুরু করেছিলেন বলে বােঝা যায়। কিন্তু শীঘ্রই সচেতনভাবে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্তির প্রত্যাশায় তিনি রবীন্দ্র পরিমণ্ডলেরই অন্তর্ভুক্ত অথচ স্বাতযুক্ত অপর তিন কবির প্রভাবাধীন হয়ে পড়েনএরা হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মােহিতলাল মজুমদার এবং কাজী নজরুল ইসলাম। জীবনানন্দের প্রারম্ভিক পর্বের কাব্যমানস-গঠনে কীভাবে বাইরের প্রভাব পড়েছিল, সে-বিষয়ে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন- "এই গ্রন্থে সচেতনভাবেই তিনি সত্যেন্দ্রনাথের ইতিহাস-চেতনা ও দেশী শব্দের প্রয়ােগ, কাজী নজরুলের ভােগবাদ এবং তারুণ্যের জয়, মােহিতলালের ভােগবাদ, সমকালীন কবি প্রেমেন্দ্র-অচিস্তার রীতি এবং সর্বোপরি কল্লোল'-এর বিদ্রোহকে বরণ করে নিয়েছিলেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি এ সমস্ত প্রভাবকে কাটিয়ে উঠে এলিয়ট এবং পাউণ্ডের ধারা অনুসরণ করে কবি-ব্যক্তিত্বে আরূঢ় হলেন।"


কবি জীবনানন্দের সামগ্রিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে তার সমসাময়িক কবিদের তুলনায় তার বৈশিষ্ট্যটুকু তুলে ধরেছেন ডঃ দীপ্তি ত্রিপাঠী "এক বিমুঢ় যুগের সংশয়ী মানবাত্মার ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত পরিচয়টি ফুটে উঠেছে।..সত্যের অন্বেষায় তার সমগ্র জীবন উৎসর্গিত কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে তিনি লাভ করেন নি। বুদ্ধদেব প্রেমে বিশ্বাসী, বিষ্ণু দে সাম্যবাদী সমাজের আদর্শ। অমিয় চক্রবর্তীর মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও দিব্যচেতনার প্রতি একটি বিশ্বাসের ভাব রয়েছে। এমন কি সুধীন্দ্রনাথের না-ধর্মিতাও একটি বিশ্বাসের মতাে তাঁর কাব্যকে সংহতি দিয়েছে.. কিন্তু জীবনানন্দের অন্তর্লোকে যে সমুদ্র-মন্থন চলেছে, তার উগরানাে বিষ তাকেই পান করে নীলকণ্ঠ হতে হয়েছে। এজন্য তাঁর কাব্যের ট্রাজিক মহিমা এত বেশি মর্মভেদী।" ঝরাপালকে' কবি কিছুকাল পূর্বসূরীদের অনুসরণ করলেন, তারপর নিজের পথ কেটে বেরিয়ে এসে স্ব-কৃত পথেই চলতে লাগলেন।


জীবনানন্দের কাব্য-বিচারে তার যে বিশিষ্টতা সর্বপ্রথম পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটি তাঁর কাব্যের চিত্রধর্ম। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যকে বলেছেন 'চিত্ররূপময়' এবং বুদ্ধদেব বসু বলেন ? "ছবি আঁকতে তাঁর নিপুণতা অসাধারণ। তার উপর ছবিগুলাে শুধু দৃশ্যের নয়, গন্ধের ও স্পর্শেরও বটে, বিশেষভাবে গন্ধের ও স্পর্শের।" জীবনানন্দের বিভিন্ন কাব্যে যাবতীয় ইন্দ্রিয়ের বিশিষ্ট অনুভূতিগুলি পারস্পরিক মিশ্রণে বা বিপর্যয়ে ইন্দ্রিয়স্বাদে যে গভীরতা এনেছে, বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা নেই। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, এই সময় চিত্র-নির্মাণে কিংবা অন্যত্র উপমা-প্রয়ােগেও জীবনানন্দ কখনাে ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত গ্রহণ করেন নি, দেশজ দৃষ্টান্তগুলিকে নিজের মতাে করে তুলে এনেছেন। এই চিত্রময়তার প্রসঙ্গে অনেকেই তার মধ্যে ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। তাদের মতােই তিনিও যে চিত্রগুলি সৃষ্টি করেছেন, তা যেন কাছ থেকে কিছু বােঝা যায় না, দূরে গেলে একটা আদল ভেসে ওঠে; এখানেও সৃষ্টির পটভূমিতে রয়েছে একটা অস্পষ্টতার আবরণ, তার উপর দু' একটি টানে ছবি ফুটিয়ে তােলার চেষ্টা এবং বিষয়বস্তু বাছাই ব্যাপারেও নির্বিচার—সর্বোপরি ধ্রুপদী রীতির অস্বীকৃতি।


অনেকে মনে করেন, আধুনিক কাব্যের মূল সুর যে ক্লান্তি ও মৃত্যুচেতনাতা জীবনানন্দের কাব্যেও সমভাবেই বর্তমান। প্রাচীন মূল্যবােধ একালের যুগসন্কটে যেভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। অথচ নতুন কোন মূল্যবােধও সৃষ্টি হয়নি, এই নৈরাশ্য থেকেই কবির অবসাদ ও ক্লান্তি। এছাড়া বিভিন্ন কবিতায় সৌন্দর্য চেতনা, প্রেমস্পৃহা কিংবা সঙ্গতির সাধনায় যে অপমৃত্যুর কথা বলা হয়েছে, তাতেও মৃত্যু-চেতনাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জীবনানন্দের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি রূপসী বাংলার বিভিন্ন কবিতায় ইতিহাস, রূপকথা-আদি থেকেও তিনি যে চিত্রকল্প আহরণ করেছেন, তাতে ভাঙাঘাট, মাজাদীঘি, চূর্ণ মঠ, জীর্ণ বট প্রভৃতির মধ্যে মৃত বাংলার রূপই ফুটে- বস্তুতঃ এটিও তাে মৃত্যুচেতনায় আচ্ছন্নতা।


জীবনানন্দের প্রথম কাব্য ঝরাপালকেই তার ইতিহাস-চেতনা লক্ষিত হয়েছিল, পরে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির যুগে তা' মৃত্যু-চেতনায় পর্যবসিত হয়ে আবার বনলতা সেন-এ তার পুনরাবির্ভাব ঘটে। দৃশ্যমান বস্তুজগতের মধ্যে আমাদের মূল্যবােধ চিরন্তনতা লাভ করতে পারে না বলেই অনুভব করেছিলেন জীবনানন্দ। তাই তিনি বলেছিলেন, "মহাবিশ্বলােকের ইশারা থেকে উৎসারিত সময়চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতাে" এবং অন্যত্রও বলেছেন, "কবির পক্ষে সমাজকে বােঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতর থাকবে ইতিহাস-চেতনা ও মর্মে থাকবে কালজ্ঞান।" তাঁর 'বনলতা সেন' কবিতাটি এ বিষয়ে একটি উল্লেখযােগ্য দৃষ্টান্ত।


আবার এই ইতিহাস-চেতনাই তাঁকে সমাজ-চেতনায় প্রবর্তিত করেছে, সমকালীন বহু ঘটনার কাব্যিক রূপায়ণই তার প্রমাণ। সাতটি তারার তিমির গ্রন্থটি এ বিষয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য নিদর্শন-রূপে গণ্য হতে পারে।


বাংলা সাহিত্যে সুর-রিয়েলিজম্ (Sur-realism) বা পরাবাস্তববাদের প্রথম প্রবর্তকরূপে জীবনানন্দকেই গ্রহণ করা হয়ে থাকে। চেতন ও অচেতন, অন্তর ও বহির্জগতের মধ্যে যে সমস্ত দৈহিক ও মানসিক ব্যবধান—দূরে সরিয়ে দেওয়াই পরাবাস্তববাদীদের কাজ। জীবনানন্দ তাঁর অসংখ্য কবিতায় সত্য আর কল্পনা, ধ্যান এবং কর্মকে একত্র মিশ্রিত করে দিয়েছেন। তার 'বনলতা সেন', 'হরিণেরা' এবং 'অবশেষে' এবং আরও অনেক কবিতায় বাস্তবে আর চিত্রকল্পে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। 'বনলতা সেন' শ্রাবস্তীর কারুকার্য, বিদিশার নিশা, শেফালিকার হাসি যেমন একাকার হয়ে যায়, তেমনি গাছেরা একবার হয় হরিণ, একবার বাঘিনী—এইসব fantasy-ই সুররিয়ালিজমের প্রত্যক্ষ প্রভাবজাত।


শিল্প প্রকরণের দিক থেকেও জীবনানন্দের নিজস্বতা প্রকট। অপর কোন কবিই তার মতাে এমন সহজে ও স্বচ্ছন্দে মুখের ভাষাকে কাব্যের ভাষায় নিয়ে আসতে পারেন নি। 'পটুকান', 'শেমিজ', 'থুতনি', 'ঠ্যাং', 'ছুড়ি', 'মরখুটে', 'ছাতকুড়াে' প্রভৃতি শব্দকে তিনি অতি সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে কাব্যের পংক্তিভােজে খাপ খাইয়ে দিয়েছেন। শুধু দেশজ শব্দ ব্যবহারেই নয়, ইংরেজি বা অপর বিদেশি শব্দের প্রতিই সর্বাধিক পক্ষপাত দেখিয়েছেন। বৃহত্তম চরণ বিন্যাসে যেমন তিনি অকৃপণ, তেমনি ক্ষুদ্রতম চরণও অনায়াসে বৃহতের সঙ্গে চালিয়ে দিয়েছেন। আবার গদ্যকবিতা রচনায়ও তার কৃতিত্ব ছিল উল্লেখযােগ্য।