মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার মধ্য ও অন্ত্য স্তরের পরিচয় | মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার বিস্তৃতিকাল ও আদি স্তরের পরিচয় | মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার সময়কাল পরিচয়

বৈদিক ভাষা থেকে কীভাবে সংস্কৃত ভাষার জন্ম হয়েছে তা আলােচনা করে এই ভাষার প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের নাম এবং সময়কাল লেখাে।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার আদিম নিদর্শন হল ঋগবেদের ভাষা বৈদিক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কথ্য বৈদিক ভাষা পরিবর্তিত হতে থাকে এবং এই ভাষার মধ্যে বিভিন্ন অনার্য ভাষার উপাদানও যুক্ত হতে থাকে। এ কারণে খ্রিস্ট জন্ম-পরবর্তীকালের ভারতীয় ব্রাহ়ণ্যশ্রেণি 'বেদের ভাষা'র বা 'দেবভাষা'র শুদ্ধতা রক্ষায় প্রয়াসী হন। সে কারণেই তারা কথ্য বৈদিক ভাষাকে ব্যাকরণের দ্বারা বেঁধে ফেলতে চান। বেশ কয়েকজন হিন্দু পণ্ডিত বৈদিক ভাষার ব্যাকরণ লেখার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এরপর আনুমানিক ৫০০ অব্দে পাণিনি রচনা করেন বৈদিক ভাষার ব্যাকরণ-গ্রন্থ 'অষ্টাধ্যায়ী'। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈয়াকরণ পাণিনি বহু শাখায় বিভক্ত, জটিল বৈদিক ভাষার বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই ভাষাকে একটি শিষ্ট ভাষায় পরিণত করেন। বৈদিক ভাষার সংস্কারকৃত রূপই হল সংস্কৃত ভাষা।


কালিদাস, অশ্বঘােষ, ভবভূতি, ভারবি, বিশাখদত্ত, শূদ্রক, বাণভট্ট প্রভৃতি কবি-নাট্যকার গদ্যকারদের রচনাগুলি এই ভাষাতেই রচিত। গঠন ও বৈশিষ্ট্যগতভাবে সংস্কৃত ভাষা (ক্লাসিকাল সংস্কৃত বা ধ্রুপদি সংস্কৃত) প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার অন্তর্গত। কিন্তু এর বিস্তৃতিকাল মূলত মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার যুগেই (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ) সীমাবদ্ধ ছিল।



মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার সময়কাল উল্লেখ করে এই পর্বটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও:

মধ্যভারতীয় আর্যভাষার সময়কাল আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।


মধ্যভারতীয় আর্যভাষাকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করা হয়। আদি স্তরের স্থিতিকাল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে ১ম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই পর্বে অন্যতম ভাষারূপ হল পালি। অশােকের অনুশাসনগুলিতে, বৌদ্ধধর্মশাস্ত্র ত্রিপিটক-এ পালি ভাষার নিদর্শন আছে। খ্রিস্টীয় ১ম শতক থেকে ৬ষ্ঠ শতক পর্যন্ত মধ্যভারতীয় আর্য ভাষার দ্বিতীয় স্তর। এই পর্বে অঞ্চলভেদে পাঁচটি প্রাকৃতের জন্ম হয়েছে— মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃত, শৌরসেনী প্রাকৃত, পৈশাচী প্রাকৃত, মাগধী প্রাকৃত, অর্ধমাগধী প্রাকৃত। মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের নিদর্শন রয়েছে হালের ‘গাথাসত্তসঙ্গ’, বাপতি রাজের গৌড়বহ', প্রবর সেনের ‘সেতুবন্ধ’ ইত্যাদি গ্রন্থে। সংস্কৃত নাটকের শিক্ষিত রমণী ও রাজপুরুষদের সংলাপে শৌরসেনী প্রাকৃতের ব্যবহার আছে। পৈশাচী প্রাকৃতের সাহিত্যিক নিদর্শন বিশেষ না থাকলেও সুতনুক প্রত্নলিপিতে মাগধী প্রাকৃতের নিদর্শন আছে। জৈন ধর্মসাহিত্যে রয়েছে অর্ধমাগধীর ব্যবহার। ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ থেকে নবম শতক পর্যন্ত মধ্যভারতীয় আর্য ভাষার অন্ত্যস্তর। এই পর্বে প্রতিটি প্রাকৃত থেকেই এক-একটি অপভ্রংশ ভাষার জন্ম হয়। এই ভাবেই মাহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, পৈশাচী, মাগধী এবং অর্ধমাগধী অপভ্রংশের জন্ম হয়। এইসব অপভ্রংশ ভাষা থেকেই নব্যভারতীয় আর্যভাষার স্তরে বাংলাসহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার জন্ম হয়।



মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার বিস্তৃতিকাল লেখাে। এর আদি স্তরের পরিচয় দাও।

মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা সাধারণভাবে প্রাকৃত ভাষা নামে পরিচিত। এই ভাষার বিস্তৃতিকাল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।


মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার তিনটি স্তর লক্ষ করা যায়- আদি, মধ্য ও অন্ত্য। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত বিস্তৃত আদি স্তরের নিদর্শন হল অশােকের অনুশাসন, বিভিন্ন প্রত্নলিপি এবং পালি সাহিত্য। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা অবলম্বনে রচিত হয়েছিল অশােকের অনুশাসন ও প্রত্নলিপিগুলি। অন্যদিকে, হীনযানপন্থী বৌদ্ধদের ধর্মপ্রচারের ভাষা হল পালি। হীনযানপন্থী বৌদ্ধদের প্রচারিত বাণী ও ধর্মগ্রন্থগুলি এই মধ্য ভারতীয় আর্যভাষায় লেখা। পালি ভাষার মধ্যে কোনাে বিশেষ অঞ্চলের কথ্য ভাষার বৈশিষ্ট্য প্রাধান্য পায়নি বলে এই ভাষাকে সাহিত্যিক ভাষা বলাই শ্রেয়। পালির অপর নাম মাগধী। তাই অনেকেই বলে থাকেন মগধই হল পালি ভাষার উৎপত্তিস্থল। অবশ্য, পালি ভাষার সঙ্গে মাগধী প্রাকৃতের নয়, শৌরসেনী প্রাকৃতের সাদৃশ্য লক্ষ করেছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। পালি ভাষায় রচিত নিদর্শনগুলির মধ্যে 'ত্রিপিটক' এবং বুদ্ধের জীবনকাহিনি নিয়ে লেখা 'জাতকের গল্প' উল্লেখযােগ্য। পালি ভাষায় লেখা উৎকৃষ্ট কবিতা-সংকলন গ্রন্থ হল ‘সুনিপাদ’ এবং 'থেরগাথা'।


মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার মধ্য ও অন্ত্য স্তরের পরিচয় দাও:

মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার দ্বিতীয় স্তরটি দ্বিতীয় শতক থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভিন্ন সাহিত্যিক প্রাকৃত এবং বৌদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় এই পর্বের নিদর্শন পাওয়া যায়। কথ্য বৈদিক ভাষা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে প্রাকৃত ভাষার রূপ লাভ করে। জিশুখ্রিস্টের জন্মের আগেই এই প্রাকৃত ভাষা অঞ্চলভেদে চারটি পৃথক রূপ পায়—

  • উত্তর-পশ্চিমা,

  • দক্ষিণ-পশ্চিমা,

  • প্রাচ্যা মধ্যা এবং

  • প্রাচ্যা। 


প্রাকৃত ভাষার দ্বিতীয় স্তরে গিয়ে উত্তর-পশ্চিমা রূপটি থেকে পৈশাচী প্রাকৃত, দক্ষিণ-পশ্চিমা রূপটি থেকে শৌরসেনী প্রাকৃত ও মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত, প্রাচ্যা-মধ্যা রূপটি থেকে অর্ধ-মাগধি প্রাকৃত, প্রাচ্যা রূপটি থেকে মাগধী প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি হয়। এই পাঁচটিই সাহিত্যিক প্রাকৃত। আদর্শ প্রাকৃত ভাষা হিসেবে সংস্কৃত নাটকে সাধারণ মানুষের সংলাপে বা কাব্যে মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত ব্যবহৃত হত। সংস্কৃত নাটকে শিক্ষিত নারী এবং রাজপুরুষের কণ্ঠে শৌরসেনী প্রাকৃত ব্যবহৃত হয়েছে। পৈশাচী প্রাকৃতের সাহিত্যিক নিদর্শন তেমন না থাকলেও মাগধী প্রাকৃতের নিদর্শন রয়েছে সুতনুক প্রত্নলিপিতে। জৈন ধর্মসাহিত্য রচিত হয়েছে অর্ধমাগধী প্রাকৃতে। মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার মধ্য পর্বে বিভিন্ন প্রাকৃত ভাষা ছাড়াও বৌদ্ধ সংস্কৃত ভাষার নিদর্শনও পাওয়া যায়। 'মহাবৈপুল্যসূত্রম, 'ললিতবিস্তর', 'সদধর্মপুণ্ডরীক' প্রভৃতি গ্রন্থ বৌদ্ধ সংস্কৃত ভাষা বা 'গাথা ভাষা'র নিদর্শন।


মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার অন্ত্য-স্তরে (সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দী) সাহিত্যিক প্রাকৃতের কথ্যবূপগুলি থেকে পৃথক পৃথক অপভ্রংশের জন্ম হয় এবং শেষ স্তরে জন্মলাভ করে অবহটঠ। এই স্তরে এসে তাই তৈরি হয় পৈশাচী, মহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, মাগধী এবং অর্ধমাগধী অপভ্রংশ-অবহটঠের। এই পাঁচটি ভাষা থেকেই নব্য ভারতীয় আর্যভাষার যুগে বাংলা প্রভৃতি আধুনিক ভাষাগুলি জন্মলাভ করে।


অস্ট্রিক ভাষাবংশ এবং অস্ট্রিক ভাষাভাষীদের সাধারণ পরিচয় দাও। অস্ট্রিক ভাষাবংশের অস্ট্রোনেশীয় (Austronesian) ভাষা শাখাটির পরিচয় দাও।

ভারতে প্রচলিত অস্ট্রিক ভাষার উপশাখাটির নাম কী? এই উপশাখাটির বিস্তৃত পরিচয় দাও।

দ্রাবিড় ভাষাবংশের বিস্তৃত আলােচনা করাে।

ভারতে প্রচলিত সাহিত্যগুণসম্পন্ন দ্রাবিড় ভাষাগুলির মধ্যে তামিল ও মালয়ালমের পরিচয় দাও।


'কন্নড়' ও 'তেলুগু' ভাষার পরিচয় দাও।

ভােট-চিনা ভাষাবংশের বিস্তৃত আলােচনা করাে।

ভারতে প্রচলিত ভােট-চিনা ভাষাবংশজাত ভাষাগুলি সম্বন্ধে আলােচনা করাে।

প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার বিস্তৃত পরিচয় দাও।


পৈশাচী, মহারাষ্ট্রী এবং অর্ধমাগধী অপভ্রংশ-অবহটঠ ভাষা থেকে সৃষ্ট নব্য-ভারতীয় আর্যভাষাগুলির পরিচয় দাও।

শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ ভাষা থেকে সৃষ্ট নব্য- ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির পরিচয় দাও।

মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ ভাষা থেকে সৃষ্ট নব্য-ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির পরিয় দাও।

ওড়িয়া, বাংলা ও অসমিয়া ভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক আলােচনা করে এই তিনটি ভাষার পরিচয় দাও।


'সংস্কৃত ভাষা বাংলা ভাষার জননী'—এই মত গ্রহণযােগ্য কি না তা যুক্তিসহ আলােচনা করাে।

বাংলা ভাষার ইতিহাসে যুগের বিন্যাস দেখিয়ে প্রত্যেক যুগের সময়সীমা নির্দেশ করাে।

ভারতীয় আর্য ভাষা বলতে কী বােঝ? এই ভাষার ক্রমবিকাশের স্তর কটি ও কী কী? প্রতিটি স্তরের সময়সীমা নির্দেশ করাে।

উদাহরণসহ মধ্যযুগের বাংলা ভাষার চারটি ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করাে। এই ভাষার দুটি গ্রন্থের নাম লেখাে।


ভারত চার ভাষাবংশের দেশ—এই চার ভাষাবংশের পরিচয় দাও।

হিন্দুস্থানি ভাষা অর্থাৎ হিন্দি ও উর্দু ভাষা কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা লেখাে।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে বাংলা ভাষা উদ্ভবের ধারাটি উদাহরণসহ আলােচনা করাে।