লােকসাহিত্যে ছড়ার বিশিষ্টতা, ছড়ার সংজ্ঞা | বাংলায় ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলির বৈশিষ্ট্য | বাংলা ‘ছেলেভুলানাে ছড়া’ গুলির বৈশিষ্ট্য | 'খেলার ছড়া'

ছড়ার সংজ্ঞা দিয়ে লােকসাহিত্যে ছড়ার বিশিষ্টতা

ছড়া: সংস্কৃত ছটা থেকে প্রাকৃত ছড়া এবং প্রাকৃত ছড়া থেকে বাংলা ছড়ার উৎপত্তি। এর অর্থ পরম্পরা, গ্রাম্যকবিতা ইত্যাদি। প্রাথমিকভাবে ছড়া বলতে বােঝানাে হত মুখে মুখে রচিত এক বিশিষ্ট প্রকরণকে যার সঙ্গে কোনাে নাই- কোনাে ভাবে তােকজীবনের সংযােগ থাকত, আর যার রচনাশৈলীতে থাকত ছন্দ ও ধ্বনিময়তার সুরেলা বিস্তার।


ছড়ার বিশিষ্টতা: লােকসাহিত্যের প্রথম সৃষ্টি ছড়া। ছড়ার মধ্যে সুর থাকলেও ছড়া কখনােই লােকসংগীত নয়। ছড়ার সুরে লােকসংগীতের সুরের মতাে বৈচিত্র্য থাকে না। পক্ষান্তরে, কোনাে একটি বিশেষ ভাবকে অবলম্বন করে লােকসংগীত রচিত হয়। কিন্তু ছড়ায় এরকম কোনাে বিশেষ ভাবের সন্ধান পাওয়া যায় না। গীতিকার মতাে কাহিনি নয়, ছড়ায় যা থাকে তা হল কথার ছবি আঁকার চেষ্টা। আবার প্রবাদের মতাে ব্যঙ্গপ্রাধান্যও ছড়ায় নেই। সমাজের নানা অসংগতিতে ব্যঙ্গের চাবুক কযানােই প্রবাদের লক্ষ্য। অন্যদিকে শিশুমনের সঙ্গে ছড়ার যােগ থাকায় তার মধ্যে স্নেহ এবং আবেগের প্রকাশ ঘটে। সমালােচনা কিংবা আক্রমণহীন প্রশান্তিই ছড়ার প্রাণ। আবার ছড়ার সঙ্গে যখন হাততালি দিয়ে শিশুকে দোলানাে নাচানাে হয়, তখন শিশুর মধ্যে যে শারীরিক অনুভবের সঞ্চার হয়, তার সামাজিক তাৎপর্য অসীম। এভাবেই লােকসাহিত্যে ছড়াগুলি বিষয়, ব্যঞ্জনা এবং প্রয়ােগের দিক থেকে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে।


বাংলায় ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলির বৈশিষ্ট্য

বাংলা 'ঘুমপাড়ানি ছড়া'গুলির কেন্দ্রে রয়েছে শিশু। তাকে ঘুম পাড়ানাের নানা প্রণালী এই ছড়াগুলিতে ফুটে উঠেছে। বিষয় বৈচিত্র্য এই জাতীয় ছড়ায় থাকা সম্ভব নয়। যদিও এখানে রয়েছে এক ধরনের সর্বজনীন আবেদন।


আবার ঘুমপাড়ানি ছড়াকার যখন বলেন- "দোল দুলুনি/রাঙ্গা মাথায় চিরুনি/বর আসবে এখুনি/নিয়ে যাবে তখুনি"—তখন শিশুর অন্যতম আকর্ষণীয় শয্যা দোলনাকে আশ্রয় করে এমন এক ছবি তুলে ধরা হল যা আমাদের সকলকেই চিরন্তন শৈশবে পৌছে দেয়। এই চিত্রমাধুর্যই ছড়ার প্রাণ। আবার নিদ্রাহীন শিশুকে ঘুমপাড়ানাের জন্য যখন 'ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি’কে আহ্বান করা হয় তখন ছড়া যেন লােকোত্তরের প্রকাশ হয়ে যায়। অথচ এর মধ্যেই আবার জীবনের অনেক অপূর্ণতাও উকি দিয়ে যায়-

ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি 

মােদের বাড়ি এসাে, 

খাট নেই, পালঙ্ক নেই 

খােকার চক্ষু পেতে বসাে।


এইভাবেই ঐন্দ্রজালিক শক্তিতে ঘুমপাড়ানি ছড়া শিশুমনকে আকৃষ্ট করে, তার চোখে নিদ্রার আবেশ তৈরি করে দেয়। ফলে, 'আঁধার ঘরের আঙ্গিনায়' ঘুমের পরি আসে যায়, সেই পরির পাখার হাওয়াতেই মায়ের কোলে জেগে থাকা ছেলের দল ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই বাংলা ‘ঘুমপাড়ানি ছড়া’গুলিতে মা বা মাতৃসমাদের স্নেহভরা মনের মায়াময় বিস্তার ঘটে।


বাংলা ‘ছেলেভুলানাে ছড়া’ গুলির বৈশিষ্ট্য

সংসারের অজস্র কাজের ফাঁকে অবােধ শিশুকে ভুলিয়ে রাখার জন্যই ছেলেভুলানাে ছড়াগুলির সৃষ্টি, মায়ের মুখেই তাই ছেলেভুলানাে ছড়ার বিকাশ। দুহাঁটুর উপরে শিশুকে বসিয়ে দোল দিতে দিতে মা ছড়া কাটেন, আর অবােধ শিশু সেই সুরের মায়াজালে আটকে পড়ে। বৃহত্তম অর্থে ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলি ছেলেভুলানাে ছড়ার অন্তর্গত হলেও শিশুদের ভােজন, শয়ন, বিশ্রাম, কান্না ইত্যাদি নানাকিছু ছেলেভুলানাে ছড়ার অন্তর্গত। "এ দুধ খায় কে রে/সােনা মুখ যার রে।/ঘন দুধের ছানা, সবাই বলে দেনা…"। দুধ মাখা ভাত, বিলের শাক, সরু চালের ভাত ইত্যাদি নানাকিছুর আয়ােজন থাকে ছেলেভুলানাে ছড়ায়। কান্না থামানাের জন্যও সেখানে থাকে অজস্র আয়ােজন-

হাল করিয়া হাসিয়া দুব দুধ খাইতে গাই। রাখাল রাখিতে দুব শ্যামের ছােট ভাই।


কখনও ছেলেভুলানাের জন্য বিয়েকে বিষয় করে তােলা হয়। যেখানে বিবাহ অভিযানের নায়ক করে কখনও শিশুটিকেই দেখানাে হয়, আবার কখনও তাকে বিয়ের গল্প বলা হয়। "এ্যাত টাকা লিচ্ছ বাফু দিলু বুড়াে বরে।/আর যদি লিতু দুটাকা দিতু ভাল ঘরে।" -শিশুকে শােনাতে গিয়ে ছড়া যেন এক সর্বমানবিক ব্যঞ্জনা লাভ করে। সােনা, মাইনকা (মানিক), মনা, কচিয়া (কচি), বাপাে (বাপ) ইত্যাদি স্নেহের সম্বােধনে ছেলেভুলানাে ছড়ায়। মাতৃহৃদয়ের অসামান্য প্রকাশ ঘটেছে।


'খেলার ছড়া' গুলি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলােচনা

খেলার ছড়াগুলি শিশুদের নিজেদের সৃষ্টি। অনেকসময় খেলাকে অবলম্বন করে ছড়াগুলি তৈরি হয়। কখনও ছড়াকে অবলম্বন করেও খেলার পরিকল্পনা হয়। এখানে দু-ধরনের ছড়া পাওয়া যায়।

বাইরের খেলাভিত্তিক ছড়া। বাইরের গ্রামীণ খেলার অন্যতম হাডুডু-কে নিয়ে লেখা ছড়া—"চু যা চরণে যাব।/পাতি নেবুর মাতি খাব।"


অন্দরের খেলা ভিত্তিক ছড়া। বৃষ্টির দিনে যখন বাইরে যাওয়া যায় না, সেই সময় ঘরের মধ্যে খেলায় গুণে গুণে নির্দিষ্ট কাউকে চোর ইত্যাদি বানানাের জন্য ছড়া কাটা হত-

আপন বাপন চৌকি চাপন,

ওল, ঢোল, মামার খােল

ওই মেয়েটি খাটিয়া চোর।


কখনও নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হলে তাকে মান্যতা দেওয়ার জন্য বলা হত—"আড়ি আড়ি আড়ি/কাল যাব বাড়ি/পরশু যাব ঘর/কি করবি কর..."। খেলার ছড়াকে কখনও প্রশ্নোত্তরের আকারেও রূপ দেওয়া হয়। এই ধরনের খেলার ছড়ায় দেখা যায়, খেলােয়াড়রা হাত ধরাধরি করে দুদলে বিভক্ত হয়ে মুখােমুখি দাঁড়ায়। একদল সুর করে ছড়া বলে সামনে পিছনে হাঁটে এবং অন্যদল থেকে একজনকে নিজের দলে টেনে নিয়ে আসে। এইসময় প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে যে ছড়াটি বলা হয়, সেটি হল-

এলাডিং বেলাডিং সইলাে

একটি খবর আইল।

কীসের খবর আইল ?

রাজামশাই একটি বালিকা চাইল।

কোন্ বালিকা চাইল ?


এর উত্তরে প্রতিপক্ষ দলের একটি বালিকার নাম বলে তাকে নিজের দলে নিয়ে আসার চেষ্টা চলে। উলটো দলও একইভাবে একই কাজ করে। খেলার ছড়া সংঘবদ্ধতা এবং শৃঙ্খলাবােধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। যদিও অঞ্চলভেদে এই খেলার ছড়ার বিভিন্ন রূপ দেখা যায়।


ধাঁধা বলতে কী বােঝ? ধাঁধার সঙ্গে শিক্ষা ও উপদেশ প্রদানের বিষয়টি কীভাবে জড়িত বুঝিয়ে দাও।

ধাঁধায় বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা নিজের ভাষায় আলােচনা করাে।

প্রবাদের সঙ্গে ধাঁধার পার্থক্য কোথায়?

প্রবাদের সংজ্ঞা দিয়ে এর সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।


প্রবাদ ও প্রবচন বলতে কী বােঝ? অন্তত চারটি বাংলা প্রবাদের উদাহরণ দাও।

বাংলা প্রবাদের গঠনবৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।

বাংলা প্রবাদের বৈচিত্র্য বিষয়ে আলােচনা করাে।

বাংলা প্রবাদে সমাজ বাস্তবতার যে প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় আলােচনা করাে।


লােককথার সংজ্ঞা দিয়ে বিভিন্ন প্রকার লােককথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

লােককথার অন্যতম শাখা রূপকথা সম্পর্কে আলােচনা করাে।

লােককথার অন্যতম শাখা ব্রতকথা বিষয়ে আলােচনা করাে।