মিশরীয় হিয়েরােগ্নিফিক সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনা | এশিয়ার দুই প্রাচীন লিপি (চিনীয় লিপি, সিন্ধুলিপি) সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনা | ধ্বনিলিপি বা বর্ণলিপি, কীলক লিপি

ধ্বনিলিপি বা বর্ণলিপি

প্রকৃতপক্ষে শব্দলিপিই ধ্বনিলিপি-স্তরের প্রথম ধাপ। শব্দলিপির ক্ষেত্রে লিপিতে ব্যবহৃত প্রতীকগুলি এক-একটি শব্দেরই (word) প্রতীক ছিল। এরপর লিপির শব্দচিত্রের রেখাগুলি ক্রমশ সরল, সংক্ষিপ্ত ও সাংকেতিক হয়ে এক-একটি শব্দকে না বুঝিয়ে শুধু তার আদ্য দল (syllable)-কে প্রকাশ করতে লাগল। এই সরলীকরণের প্রক্রিয়াকে বলে শীর্ষনির্দেশ (Acrology)। এই প্রক্রিয়ায় শব্দলিপি পরিণত হল দললিপি (Syllabic Script)-তে। এরপর ধ্বনিলিপি বিকাশের শেষ ধাপে এসে লিপিতে ব্যবহৃত প্রতিটি রেখাচিহ্ন এক-একটি দল-এর প্রতীক না হয়ে সেই ভাষায় ব্যবহৃত এক-একটি একক ধ্বনির প্রতীক হয়ে উঠল। একক ধ্বনির লিপিই হল বর্ণ (Letter)। ধ্বনিলিপিকে তাই বর্ণলিপি (Alphabetic Script)-ও বলা যায়। রােমীয় লিপি প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বনিমূলক।


সবচেয়ে আধুনিক লিপি হল ধ্বনিলিপি। ইতিপূর্বে যা ছিল বিশেষ কোনাে বস্তু বা বিষয় বা ভাবের প্রতীক, তা হয়ে উঠল কোনাে ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনির প্রতীক। এটি তাই উচ্চারণ-ভিত্তিক লিপিপদ্ধতি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গােরুর মুখের ছবি থেকে ক্রমে ক্রমে ‘a' ধ্বনিচিহ্নের বা বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিক ধ্বনি/বর্ণ 'a'(আলফা) থেকে এসেছে ইংরেজি বর্ণ 'a'। এই 'a' বর্ণ দিয়ে শুরু হওয়া শব্দের সঙ্গে তাই গােরু-সম্পর্কিত কোনাে কিছুর যােগ না থাকাটাই স্বাভাবিক।


কীলক লিপি

প্রাচীন সুমেরীয় জাতির লিপিপদ্ধতির নামই কীলক লিপি। সুমেরীয়রা (পারস্যদেশীয়) পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার জন্মভূমি মেসােপটেমিয়ায় এসে তাদের লিপিপদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে। কাঁচা মাটির পাটাতনে কীলক বা বাটালি দিয়ে রেখাচিত্র এঁকে তারপর সেই মাটি রােদে পুড়িয়ে তারা কীলক লিপি তৈরি করত। প্রাচীন মেসােপটেমিয়ার মানুষ মনে করতেন যে, নেবাে নামক দেবতাই এই লিপি পদ্ধতির আবিষ্কর্তা। বিখ্যাত লিপি বিশারদ টমাস হাইড এই লিপির নামকরণ করেন কিউনিফর্ম (Cuneiform)। লাতিন ভাষায় 'Cuneus' শব্দের অর্থ পেরেক বা কীলক বা বাটালি এবং 'forma' শব্দের অর্থ আকৃতি। কীলকের মতাে খোঁচা খোঁচা চেহারার জন্যই এর নাম কীলক লিপি।


প্রথম যুগে এটি চিত্রলিপি থাকলেও পরবর্তীকালে এটি ক্রমে ক্রমে ভাবলিপি ও ধ্বনিলিপিতে পরিবর্তিত হয়। ব্যাবিলনীয় এবং আসিরীয়— এই দুই প্রধান মেসােপটেমীয় ভাষা পাথরের ওপর বা কাদার টালির ওপর লেখা হত এই লিপিতেই। পারস্যদেশে আর্যদের প্রাচীন পারসিক ভাষা লেখার জন্যও এই লিপি ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে এই লিপি বিলুপ্ত। কীলক লিপির সবচেয়ে প্রাচীন নমুনাটি (প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের পুরানাে) পাওয়া গেছে। উরুক শহরে। এ ছাড়া, প্রাচীন সুমেরের নিসপুরে একটি মন্দিরের নীচে একটি সিলমােহর পাওয়া গেছে যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার কিউনিফর্মে লেখা।


মিশরীয় হিয়েরােগ্নিফিক

খ্রিস্টজন্মের চার হাজার বছর আগে মিশরে চিত্রপ্রতীকলিপির উদ্ভব হয়। গ্রিকরা মিশরীয় পুরােহিতদের মধ্যে এই লিপি-পদ্ধতির প্রচলন পর্যবেক্ষণ করে এই লিপিকে ‘খােদিত পবিত্র লিপি নামে অভিহিত করেন বলে এই লিপির নাম দেওয়া হয় 'হিয়েরােগ্লিফিক (Hieroglyph) ('হিয়ে়ারাস' = পবিত্র; 'গ্লিফেইন' = খােদাই করা)।


হিয়েরােগ্লিফিক চিত্রলিপি হলেও পরবর্তীকালে দল (syllable) এবং ধ্বনির প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হত। এতে স্বরচিহ্ন ছিল না। কতকগুলি চিহ্ন যেমন একটিমাত্র ব্যঞ্জনের প্রতীক ছিল, তেমনি আবার কোনাে কোনাে চিহ্ন একাধিক ব্যঞ্জনকে প্রকাশ করত। ডান থেকে বাম এবং বাম থেকে ডান— উভয় প্রকারের হিয়েরােগ্লিফিক পাওয়া যায়। প্রথমে এই লিপি পাথর বা কাঠে লেখা হলেও পরে প্যাপিরাস নামক নলখাগড়াকে পিটিয়ে পাতলা ফালি বানিয়ে তার ওপর কালি ও কলম দিয়ে লেখা হত। প্রথম যুগে এই লিপি অত্যন্ত জটিল ছিল এবং প্রায় পাঁচশাের মতো রেখাচিত্র ব্যবহৃত হত। ক্রমে এই লিপির রেখাচিত্রের সংখ্যা কমে আসে এবং টানা লেখার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। এইভাবে ক্রমে ক্রমে সহজতর হিয়েরেটিক (Hieratic) এবং আরও সহজ ডেমােটিক (Demotic) লিপির (২০০-৩০০ খ্রিস্টাব্দে) সৃষ্টি হয়। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে নীলনদের মােহনায় 'সাঁ জুলিয়া দ্য রসেত্তা’ দুর্গের দেয়ালে ফরাসিরা আঁকিবুকি-কাটা একটি কালাে পাথর দেখতে পান। সেটি ছিল ১৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মিশরের রাজা টলেমি এপিফানেস-এর সম্মানে লেখা একটি ঘােষণাপত্র। মিশরীয় এবং গ্রিক—এই দুই ভাষাতেই রচিত ঘােষণাপত্রটি ছিল কিছু হিয়েরােগ্লিফিক লিপিতে, কিছু ডেমােটিক লিপিতে, আর কিছু গ্রিক লিপিতে লেখা।


এশিয়ার দুই প্রাচীন লিপি

এশিয়ার দুই প্রাচীন লিপি হল—

  • চিনদেশের চিনীয় লিপি এবং

  • ভারত উপমহাদেশের সিন্ধুলিপি।


চিনীয় লিপি: খ্রিস্টপূর্ব দুহাজার অব্দে প্রাচীন চিনে মরমিয়া (mystic) সাধনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত আটটি প্রতীকচিত্র থেকেই উদ্ভূত হয় প্রাচীন চিনা চিত্রলিপি। চিনা চিত্রলিপি পরবর্তীকালে ভাবলিপিতে উত্তীর্ণ হলেও এখনও পর্যন্ত তা দললিপি বা ধ্বনিলিপির স্তরে এসে পৌঁছােয়নি। আধুনিক চিনা ভাষাতে এবং কিছুটা পরিবর্তিত আকারে জাপানি ভাষাতে এই লিপিই ব্যবহৃত হয়।


সিন্ধুলিপি: ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুনদের অববাহিকায় আবিষ্কৃত ভগ্নাবশেষের মধ্যে থাকা সিলমােহর, শিলালিপি থেকে সে যুগের লিপিরও সন্ধান পাওয়া যায়। সিন্ধু লিপি ছিল মূলত চিত্রলিপি। এই লিপিতে প্রায় ৪০০ বিভিন্ন চিহ্নের খোঁজ পাওয়া যায়। সেই চিহ্নগুলির মাথায় স্বরচিহ্নবােধক বিভিন্ন রেখাও দেখা যায়। এই লিপির সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি। তবে এই লিপির সঙ্গে সুমেরীয়, প্রােটো-এলমাইট, হিট্টাইট, মিশরীয়, ক্রিট দেশীয় এবং চিনা লিপির কিছু কিছু সাদৃশ্য দেখা গেছে। এসব দেখে ধারণা করা যায় যে, ওইসব দেশের সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার যােগাযােগ ছিল। ব্রাম্মী লিপির সঙ্গেও সিধুলিপির সাদৃশ্য আছে। লিপিবিশারদ হান্টার সাহেব-সহ অনেক লিপিবিশারদ মনে করেন যে, ভারত উপমহাদেশেই প্রচলিত কোনাে প্রাচীনতর লিপি থেকে সিন্ধুলিপি উদ্ভূত হয়েছে এবং সিসিলীয় লিপি ও সাইপ্রাসের প্রাচীন সাইপ্রায়েট লিপিও প্রকৃতপক্ষে সিন্ধুলিপি-উদ্ভূত।


মানবসভ্যতার প্রথম যুগে কোন্ কোন্ লিপিপদ্ধতি প্রচলিত ছিল? এর মধ্যে একটি বিস্তৃতভাবে আলােচনা করাে।

স্মারক-চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির পরিচয় দাও।

প্রাচীন চিত্রলিপি এবং ভাবলিপি সম্বন্ধে আলােচনা করাে।

প্রাচীন চিত্রপ্রতীকলিপি সম্বন্ধে আলােচনা করাে।


খরােষ্ঠী লিপি সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনা করাে।

প্রত্ন-বাংলা লিপি থেকে আধুনিক মুদ্রণ-যুগের বাংলা লিপির ক্রমবিবর্তন আলােচনা করাে।

ব্রাহ্মী লিপি থেকে কীভাবে বিভিন্ন আধুনিক ভারতীয় এবং বহির্ভারতীয় লিপি উদ্ভূত হয়েছে, তা আলােচনা করাে।

আধুনিক পৃথিবীর যাবতীয় বর্ণমালা সৃষ্টি হয়েছে কোন আদি বর্ণমালা থেকে? পৃথিবীতে বর্ণমালার উদ্ভব ও বিবর্তন সংক্ষেপে আলােচনা করাে।


ব্রাহ্মী লিপি থেকে বাংলা লিপি বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়গুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

সিন্ধুলিপি ও কীলক লিপি সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

ব্রাহ্মী লিপির উৎস সম্বন্ধে যে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে, তার বিবরণ দাও।