বৈষ্ণব পদাবলীর অপ্রধান অথচ বিশিষ্ট কয়েকজন কবির পরিচয় দান কর।

বৈষ্ণব পদাবলীর বিশিষ্ট কবির পরিচয়


বলরামদাস :

বৈষ্ণব পদকর্তাদের প্রধান চতুষ্টয়কে বাদ দিলে যাদের কথা প্রথমেই মনে হয়, তাদের মধ্যে বলরামদাসের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযােগ্য। অন্যান্য পদকর্তাদের পরিচয় নিয়ে বারবার যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, বলরামকে নিয়েও আমাদের সেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে—এককথায় একে বলা চলে কবির পরিচয় সমস্যা। গৌরপদতরঙ্গিনী’র সম্পাদক বলরামদাস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, "বলরামদাসকে লইয়া সাহিত্যজগতে বিষম গােল। আমরা ১৯ জন বলরামের সন্ধান পাইয়াছি।" আরও সতর্ক পর্যবেক্ষণে অবশ্য এই সংখ্যাকে আরাে সীমিত করা সম্ভবপর। কিন্তু ডঃ সুকুমার সেন সর্ববিধ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই সংখ্যাকে পাচের নীচে নামাতে পারেননি ; কিন্তু কবির প্রকৃত পরিচয় উদ্ঘাটনে এই পাঁচ সংখ্যাটিও যথেষ্ট সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। বলরামদাসের নামে যে সকল পদ প্রচলিত রয়েছে, তাদের মধ্যে যেমন আছে বাঙলা ভাষায় রচিত পদ, তেমনি আছে ব্রজবুলির পদ। অতএব অতি সঙ্গত কারণেই অনুমান করা চলে যে, বলরামদাস নামক কোন কবি বাঙলা ভাষায় পদ রচনা করেছেন, কোন কবি ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেছেন এবং কোন কোন কবির পক্ষে বাঙলা এবং ব্রজবুলি উভয় ভাষায় পদ রচনা করাও অসম্ভব নয়। তবে একটি কথা এই প্রসঙ্গে স্বীকার করতেই হয় যে, বলরামদাস নামাঙ্কিত সব পদই সমান রসােত্তীর্ণ নয়। যে পদগুলি শ্রেষ্ঠ তাদের রচয়িতাকেই আমরা প্রধান বলরামদাস রূপে গ্রহণ করে তাঁর কাব্য-পরিচয় দান করবাে।


চব্বিশ পরগণা জেলার দোগাছিয়া গ্রামনিবাসী এক বলরামদাস ছিলেন ব্রাহ্মণ সপ্তান। অনুমান করা হয় ইনিই প্রধান বলরামদাস। এই বলরামদাস চৈতন্যদর্শনে বঞ্চিত বলে আক্ষেপ করলেও অনুমান করা যায় যে ইনি চৈতন্য-সমকালেই বর্তমান ছিলেন, কারণ ইনি নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন। বাঙলা ও ব্রজবুলি ভাষায় রচিত যে উৎকৃষ্ট পদগুলিতে ‘বলরামদাস' ভণিতা রয়েছে, ঐ পদগুলিই এই নিত্যানন্দ-শিষ্য বলরামের রচিত বলে গ্রহণ করা হয়। বুধরী গ্রামের অধিবাসী একজন বলরামদাস ছন্দো-বৈচিত্রযুক্ত এবং অলঙ্কারবহুল ভাষায় বেশ কিছু ব্রজবুলি পদ রচনা করেন। ইনি ছিলেন গােবিন্দদাস কবিরাজের জ্যেষ্ঠভ্রাতারামচন্দ্র কবিরাজের শিষ্য। এর রচিত পদগুলির উপভােগ্যতাও স্বীকৃত হয়ে থাকে। অপর একজন বলরামের পরিচয় পাওয়া যায় যিনি নিত্যানন্দদাস' ভণিতায় কিছু পদ রচনা করেন। ইনি 'প্রেমবিলাস' নামক গ্রন্থের রচয়িতা এবং নিত্যানন্দ-পত্নী জাহ্নবী দেবীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। এ ছাড়াও দু’জন বলরামের পরিচয় পাওয়া যায়ভণিতা থেকেই যাদের পৃথক অস্তিত্ব বের করে নেওয়া চলেএঁদের একজন 'বসু বলরাম' এবং 'দীন বলরাম' ভণিতা ব্যবহার করেছেন।


বাঙলা এবং ব্রজবুলি উভয় ভাষাতেই বলরামদাসের ভণিতা পাওয়া যায়। ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদে ছন্দের ঝঙ্কার এবং অলঙ্কারের সার্থক,ব্যবহার পদগুলিকে শ্রবণ-সুভগ করে তুললেও এদের কাব্যগুণ তেমনভাবে প্রকাশিত হয়নি। এদের তুলনায় বাঙলা ভাষায় রচিত পদগুলি অনেক বেশি কাব্যশ্রীমণ্ডিত। বলরামদাস বিভিন্ন পর্যায়ের পদ রচনা করলেও তার খ্যাতি প্রধানতঃ নির্ভরশীল বাৎসল্যরসের পদ রচনায়। বলরামদাস কৃষ্ণের বাল্যলীলা এবং গােষ্ঠলীলার বিভিন্ন পদ রচনায় যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন ; আবার যশােদা-জননীর হৃদয়-উৎকণ্ঠা প্রকাশেও কবির আন্তরিকতা প্রশংসনীয়। বলরাম ছিলেন বালগােপালের উপাসক—তাই রাধাকৃষ্ণের লীলারহস্য তাঁর মনকে ততটা অধিকার করতে পারেনি বলেই মধুর রসের পদ রচনায় তার আগ্রহ ছিল অপেক্ষাকৃত কম। বাৎসল্যরসের প্রকাশকেই কবি আপন প্রতিভা প্রকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র বলে গ্রহণ করেছিলেন। বস্তুতঃ বলরামদাসই বাৎসল্যরসের শ্রেষ্ঠ কবিরূপে বিবেচিত হয়ে থাকেন। তার রচিত 'শ্রীদাম সুদাম দাম শুন ওরে বলরাম কিংবা 'বলরাম, তুমি মাের গােপাল লইয়া যাইছ ইত্যাদি পদগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বলরামদাসের রচনায় যে মানবিক এবং সহজ জীবন-রস-প্রীতি প্রকাশ পেয়েছে, তারই জন্য যে কোন পাঠক ঐ রচনার সঙ্গে আপনার হৃদয়কেও যােগযুক্ত করতে পারেন। বলরামদাসের বাৎসল্যের সঙ্গে সার্থকভাবেই তুলনা করা চলতে পারে।


বলরামদাস বাৎসল্যরসের বাইরে বিভিন্ন মধুর রসের পদ রচনা করলেও কোন মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দিতে পারেন নি। তবে অকৃত্রিম সরলতা এবং শুচিশুভ্র পরিবেশ সৃষ্টিতে তিনি যে সার্থকতা লাভ করেছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বলরামদাসের কৃতিত্ব-বিষয়ে ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "ছন্দ-অলঙ্কার, ভাষা- ভঙ্গিমা, কল্পনার অভিনবত্ব, চিত্রকল্পের সুবিহিত প্রয়ােগ প্রভৃতি আলােচনা করিলে তাহার এই পদগুলিতে বিশেষ কোন কবিত্ব ও নিপুণতা খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। তাহার কারণ তাহার পদে প্রত্যক্ষ শিল্পায়ন অপেক্ষা ব্যঞ্জনার ইঙ্গিত একটু বেশি। এইজন্য যাহারা বৈষ্ণব পদে ছন্দ ও অলঙ্কারের কারুকর্ম দেখিতে অভ্যস্ত তাহারা বলরামের এই সমস্ত জলবৎ তরল পদগুলিতে উগ্র স্বাদ পাইবেন না।"


রায়শেখর:

বৈষ্ণব কবিদের পরিচয়-সমস্যা বাঙলা সাহিত্যের যেন এক সুনিশ্চিত স্থায়ী জটিল সমস্যা। এক নামে বহু কবিই কাব্যরচনা করবার ফলে এদের মধ্যে যিনি মুল এবং প্রধান, তার রচনাতে অপরদের থেকে পৃথক করা যেমন এক অসাধ্য ব্যাপার তেমনি আবার একজন কবিই বহু বিচিত্র নামে নিজেকে প্রকাশ করবার ফলেও আর এক জাতীয় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গােবিন্দদাস এবং বলরামদাস বৈষ্ণবপদকর্তারূপে বিশেষ খ্যাতিমান—কিন্তু এদের প্রত্যেকটি নামেই অন্ততঃ একাধিক কবি বর্তমান ছিলেন। আবার বিপরীতক্রমেও দেখা যায় যে, 'রায়শেখর' নামে একজন পদকর্তা বিভিন্ন নামে নিজের পরিচয় দিয়েছেন বলে অনুমান করা হয়, যার ফলে ঐ বিভিন্ন নামের ব্যক্তিরা পৃথক ব্যক্তি অথবা তারা মিলে একজন তা নিশ্চিন্তভাবে বলা যায় না। অনেকে অনুমান করেন, 'রাজশেখর' নামক কবিই শেখর রায়, কবিশেখর, শেখরকবি, কবিশেখর রায়’ প্রভৃতি বিচিত্র নাম ব্যবহার করে গেছেন। শুধু 'শেখর' ভণিতায়ুক্ত পদও পাওয়া যায়, উনিও রায়শেখর কিনা বলা সম্ভব নয়। ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, "...স্বয়ং বিদ্যাপতির ভণিতাতেও 'কবিশেখর ভণিতা আছে। সুতরাং শেখর ও কবিশেখর এই তিনজন পৃথক কবি হবেন বলেই অনুমান।" আবার অন্য অনেকের মতে এরা একই ব্যক্তি।


যােড়শ শতকের শেষভাগে অথবা সপ্তদশ শতকের গােড়ার দিকে 'কবিশেখর নামক এক কবি গোপাল বিজয় নামক এক বাঙলা কাব্য এবং একাধিক সংস্কৃত কাব্য রচনা করেছিলেন। অনুমান করা যায়, ইনিই পদকর্তা রায়শেখর। তিনিই 'গােপালবিজয়' কাব্যে যে আত্মপরিচয় দান করেছেন, তা থেকে জানা যায় যে কবির পৈতৃক নাম ছিল দৈবকীনন্দন এবং পিতার নাম চতুর্ভুজ।


সিংহবংশে জন্ম নাম দৈবকীনন্দন। 

শ্ৰী কবিশেখর নাম বলে সর্বজন ॥


কবি রায়শেখর ছিলেন বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। ব্রজবুলি ভাষায় রচিত তার পদগুলিই অধিকতর উৎকর্ষ লাভ করলেও সাধারণ বাঙলা ভাষায় এবং লােচনের ধামালীর মতাে চটুল ছন্দেও তিনি অনেক পদ রচনা করেছেন। ব্রজবুলিতে তার কৃতিত্ব-বিষয়ে ডঃ সুকুমার সেন বলেন, “ব্রজবুলিতে কবিতা রচনার দক্ষতায় গোবিন্দদাসের পরেই কবিরঞ্জন এবং রায়শেখরের নাম করতে হয়।" বিদ্যাপতির রচনা বলে প্রচলিত সখি, হামারি দুখের নাহি ওর পদটি কিন্তু প্রাচীনতর ও প্রামাণিক পুথিতে শেখরে'র ভণিতাতেই পাওয়া যায়—এ থেকেই রায়শেখরের কবিপ্রতিভার উৎকর্ষ প্রমাণিত হয়। শুধু এটিই নয়, এ জাতীয় রায়শেখরের আরাে কিছু কিছু পদ বিদ্যাপতির নামে প্রচলিত রয়েছে।


অন্যান্য কবির পরিচয়:


বৈষ্ণবপদকর্তার সংখ্যা শতাধিক বললেও যথেষ্ট বলা হয় না। এঁদের মধ্যে প্রধানদের বাদ দিলেও এমন কিছু কিছু কবি রয়েছেন যাদের কৃতিত্ব অস্বীকার করবার মতাে নয়। নিম্নে অল্প কয়েকজনের পরিচয় দেওয়া হলাে।


লােচনদাস- চৈতন্যমঙ্গল' রচয়িতা লােচনদাস-রচিত ধামালী বিশেষ উল্লেখযােগ্য। পদগুলি নদীয় নাগরী-ভাবের। চটুল ছড়ার ছন্দে রচিত পদগুলিতে একজাতীয় গ্রাম্য সৌন্দর্য বর্তমান। 'চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি' এবং 'অমিয়া মথিয়া কেবা নবনী তুলিল গাে' প্রভৃতি সাধারণ পদে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।


নরােত্তমদাস ঠাকুর- খেতুরীর রাজবংশের সন্তান নরােত্তমদাস ঠাকুরই প্রথম স্বগ্রামে এক মহােৎসব-উপলক্ষ্যে প্রথম কীর্তন গানের প্রবর্তন করেন। প্রার্থনাসূচক পদ-রচনায় তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।


কবিরঞ্জন- বাঙলা এবং ব্রজবুলি ভাষায় অনেক পদ রচনা করলেও ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনায় তিনি বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি 'ছােট বিদ্যাপতি' নামে পরিচিত ছিলেন; তার অনেক পদও বিদ্যাপতির নামে প্রচলিত রয়েছে।


জগদানন্দ- ইনি সপ্তদশ শতকের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা-বাঙলা এবং ব্রজবুলিউভয় ভাষায় পদ-রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ধ্বনিমাধুর্য এবং শব্দচিত্র রচনায় তিনি শ্রেষ্ঠ কবিদের সমকক্ষতা দাবি করতে পারেন। 'মঞ্জুবিকচ কুসুমপুঞ্জ মধুপশব্দ গুঞ্জ' পদটি তারই রচনা।


সৈয়দ মর্তুজা, নসির মামুদ, আলাওল প্রভৃতি মুসলমান কবিও কিছু কিছু বৈষ্ণব পদ রচনা করেছেন।