উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলা গদ্যের বিকাশে শ্রীরামপুরের মিশনারীগণের দান | শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনে বাঙলা গদ্যচর্চার পরিচয় দাও এবং বাঙলা গদ্যের‌ বিকাশে শ্রীরামপুরের মিশনারীদের সম্পর্কে আলােচনা

বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশন ও ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অবদান

উইলিয়ম কেরির প্রচেষ্টা: বাঙলা দেশে সংগঠিতভাবে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের জন্য অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষদিকে (১৭৯৩ খ্রীঃ) জন টমাস উইলিয়ম কেরিকে (১৭৬২-১৮৩৪) বাঙলা দেশে নিয়ে আসেন। জনসাধারণের মধ্যে ধর্মপ্রচার করতে হলে দেশীয় ভাষার মাধ্যম অবলম্বন করা প্রয়ােজন। টমাস এ বিষয়ে প্রথম থেকেই উদ্যোগী ছিলেন; কেরির মতাে একজন প্রতিভাসম্পন্ন ভাষা-বিজ্ঞানীর সহায়তা লাভ করায় ইংরেজ মিশনারীদের কর্মধারায় নতুন উদ্দীপনা সঞ্চারিত হল। কেরি এদেশে এসে যথার্থভাবে কাজ আরম্ভ করার মতাে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের সঙ্গে মিশনারীদের সম্পর্ক ভালাে না থাকায় কোম্পানির কর্তৃত্বাধীন কোন এলাকায় স্থায়িভাবে প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা অসম্ভব হয়। ইতিমধ্যে কেরি একটি কাঠের তৈরী মুদ্রণযন্ত্র সংগ্রহ করেন, বাঙলা ভাষায় বাইবেল অনুবাদের কাজও অনেকদূর অগ্রসর হয়, কিন্তু একটি স্থায়ী কেন্দ্র গড়ে তােলবার মতাে স্থানের অভাবে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে কোন কাজই এঁরা ভালােভাবে আরম্ভ করতে পারেন নি। কোম্পানীর কর্মচারীদের প্রতিকুলতাহেতু কলকাতায় তাদের কর্মধারা বিঘ্নিত হচ্ছিল। অবশেষে মিশনারীগণ ইংরেজ রাজত্বের বাইরে ডেনিশ শাসনাধীন শ্রীরামপুরকেই নির্বাচন করেন। ওয়ার্ড ও মার্শম্যান ছিলেন কেরির প্রধান সহযােগী, তারা ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে, এদেশে এসেছিলেন। ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারী কেরি খিদিরপুর থেকে শ্রীরামপুর এসে অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে মিলিত হন এবং পূর্বকথিত কারণে ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন ও প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন; ১২ই জানুয়ারি থেকে যথারীতি মিশনের কাজ শুরু হল। গদ্যভাষা গড়ে তােলার দিক থেকে এদের রচনাবলীর মূল বিষয়ে মতান্তর আছে, কিন্তু মুদ্রণযন্ত্রের বৈপ্লবিক সহায়তায় ব্যাপক জনসমাজের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যম হিশাবে গদ্যের শক্তিবৃদ্ধির ঐতিহাসিক কৃতিত্ব শ্রীরামপুরের মিশনারীদেরই প্রাপ্য। 


মুদ্রিত বাঙলা গ্রন্থ প্রকাশের যথার্থ ইতিহাসের সূচনা হয়েছে শ্রীরামপুরে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপনের পর থেকে। শ্রীরামপুর থেকে বাইবেলের অনুবাদ এবং অন্যান্য ধর্মপুক্তিকা রচনাকেই তার একমাত্র ব্রত বলে গ্রহণ করেননি, কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারত এবং বাঙলা গদ্যের প্রথম পাঠ্যপুস্তকগুলিও এখানেই মুদ্রিত ও রচিত হয়েছিল ও এই প্রেস থেকেই বাঙলা ভাষার প্রথম সাময়িক পত্র এবং সংবাদপত্রও ছাপা হয়। কোন সাহিত্যই মুদ্রণযন্ত্রের সহায়তা ভিন্ন আধুনিক যুগে উত্তীর্ণ হতে পারে না; অতএব বাঙলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূচনা শ্রীরামপুরের মিশনারীদের সহায়তায়ই সম্ভব হয়েছিল, একথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রাখা দরকার। এই ঐতিহাসিক ঘটনা সম্ভব হয়েছিল উইলিয়ম কেরির নেতৃত্বে, তাই বাঙালী সংস্কৃতির ইতিহাসে তার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।


মিশনের প্রেস থেকে প্রথম প্রকাশিত বাঙলা বই Gospel of St, Matthew-এর অনুবাদ 'মঙ্গল সমাচার মাতিউর' রচিত হয়। মূল গ্রীক থেকে এ বই অনুবাদ করা হয়েছিল। মূল অংশের শেষে কালের অল্প বিবরণ এবং কতক ভবিষ্যৎ বাক্যে যীশুখ্রীষ্টের বিষয়’ নামে পাঁচ পৃষ্ঠার একটি পরিশিষ্ট যোগ করা হয়েছিল। এই অংশটুকু স্বাধীন রচনা, অনুবাদ নয়। এই পুস্তকটি ১৮০০ সালেই ছাপা হয়। পুস্তিকাটির ভাষায় তদ্ভব শব্দের প্রাধান্য, এটি কথ্য ভাষানুসারী এবং সেই কারণেই কিছুটা সহজ, তৎসম শব্দের বানান প্রায়ই অর্ধ-তৎসমের মত করা হয়েছে। মূলের বাক্যগঠন অনুসরণের ফলে বাক্যবিন্যাসরীতি বাঙলা ভাষার রীতি-বিরুদ্ধ। এটি শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত প্রথম বাঙলা বই। পরিশিষ্ট অংশ স্বাধীনভাবে রচিত, তাই বাঙলা গদ্যের ইতিহাসে এই অংশেরই মূল্য বেশী।


শ্রীরামপুরে আসবার আগেই উইলিয়াম কেরি তার ভাষা-শিক্ষক রামরাম বসুর সহায়তায় বাইবেলের অনুবাদ শেষ করেছিলেন। ধর্মপুস্তক' নামে এক গ্রন্থ ১৮০১ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রকাশিত হয়। সমগ্র নিউ টেস্টামেন্ট এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম অংশের অনুবাদ এই গ্রন্থে প্রকাশ করা হয়েছিল। বাঙলা গদ্যের ইতিহাসের স্মরণীয় এই গ্রন্থটি রচনার কৃতিত্ব কোন একজনের প্রাপ্য নয়। কেরি প্রধান উদ্যোগী ছিলেন এবং তিনিই ছিলেন শ্রীরামপুরের মিশনারীদের সকল কর্মের প্রেরণা-উৎস। তবুও গ্রন্থ রচনা বিষয়ে তিনি রামরাম বসু ও জন টমাসের সহায়তা যে গ্রহণ করতেন একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। শ্রীরামপুর থেকে এই গ্রন্থের শেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৩২-৩৩ খ্রীষ্টাব্দে। প্রতি সংস্করণেই ভাষার সংস্কার সাধন করা হয়েছে। কিন্তু রচনাশৈলী বিশেষ উন্নত হয় নি। সংশােধনে বাক্যগঠনরীতি পরিমার্জিত হলেও তদ্ভব শব্দের স্থানে তৎসম শব্দের ব্যবহার তথা ভাষায় সংস্কৃতায়নে তার স্বাচ্ছন্দ্য হ্রাস পেয়েছিল। তবুও এই প্রচেষ্টায় বিশেষভাবে কেরির অকৃত্রিম নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়। কেরিই ছিলেন শ্রীরামপুর মিশনের প্রধান নায়ক, কিছুদিন পরে তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করে চলে যাওয়ায় গ্রন্থ রচনার দিক থেকে মিশনের ভূমিকার গুরুত্ব কমে যায়।


শ্রীরামপুর মিশনের কাজে টমাস ও রামরাম বসুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। জন টমাস (১৭৫৭-১৮০১) ছিলেন জাহাজের ডাক্তার, পরে পাদ্রী হয়ে ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়ােগ করেন। মিশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি উন্মাদ হয়ে যান এবং অল্পকাল পরই মৃত্যুবরণ করেন। টমাসই প্রথম রামরাম বসুকে মুন্সিরূপে (১৭৮৭ খ্রীঃ) নিযুক্ত করেন। পরে ইনি কেরির মুন্সি হন। ইংরেজদের দেশীয় ভাষা শিক্ষাদানে তিনি অগ্ৰণীয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। এ ছাড়া কেরির সহায়কদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ছিলেন যশুয়া মার্শম্যান (১৭৬৮-১৮৩৭খ্রীঃ) এবং উইলিয়ম ওয়ার্ড (১৭৬৯-১৮২৩ খ্রীঃ)। মার্শম্যান গ্রীক, লাতিন, হিব্রু প্রভৃতি ভাষায় কৃতবিদ্য ছিলেন। তিনি শ্রীরামপুর মিশনের শিক্ষাবিভাগীয় অধিকর্তা ছিলেন। রামমােহনের সঙ্গে বিতর্কে তিনিই ছিলেন প্রধান প্রতিযােগী। ওয়ার্ড ছিলেন প্রেসের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক এবং সংবাদপত্র সম্পাদনায়ও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন।


শ্রীরামপুর মিশনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাংলায় সাময়িকপত্র প্রকাশ। বাংলা ভাষায় প্রথম মাসিক পত্র 'দিগদর্শন' এখান থেকেই ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়। 'দিগদর্শন' প্রকাশের এক মাসের মধ্যে মিশন ‘সমাচার দর্পণ' নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে। উভয় পত্রিকারই সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান। সাময়িক পত্রিকা অবলম্বন করেই উত্তরকালে বাঙালা গদ্যভাষার দ্রুত বিকাশ সম্ভব হয়েছে, শ্রীরামপুর মিশন এইদিক থেকেও অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।