'বঙ্গদর্শন'-পূর্ববর্তী সাময়িক পত্রিকা | বাঙলা সাময়িকপত্রের আবির্ভাব ও আধুনিক সাহিত্যের গঠনে ইহার প্রভাব

বাঙলা সাময়িকপত্রের আবির্ভাব ও আধুনিক সাহিত্যের গঠনে ইহার প্রভাব


গদ্যভাষার মাধ্যম এবং মুদ্রণযন্ত্রের সহায়তা ভিন্ন কোন ভাষার সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ সম্ভব হয় না। বাঙলা মুদ্রণ শিল্পের প্রবর্তক শ্রীরামপুরের মিশনারী সম্প্রদায়। বাঙলা গদ্যচর্চায় এদের উৎসাহের কথাও সর্বজনবিদিত। এই মিশনারীরাই প্রথম বাঙলা সাময়িকপত্রিকা প্রকাশ করেন। বাঙলা গদ্যরীতির সরলীকরণে ও উন্নয়নে সাময়িকপত্রের দান অসামান্য, এইজন্যই বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাময়িকপত্রের বিকাশধারা একটা গুরুত্বপূর্ণ আলােচ্য বিষয়। আমাদের আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায় এক-একটা সাময়িক পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে শক্তিশালী লেখকগোেষ্ঠী গড়ে উঠেছে এবং এইসব পত্রিকাগােষ্ঠীর লেখকবৃন্দ বিশেষ যুগের ধ্যান-ধারণার নিয়ামকরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বকে এইসব সাময়িকপত্রের নামে চিহ্নিত করা হয়। তত্ত্ববােধিনী’, ‘বঙ্গদর্শন প্রভৃতি এইরূপ এক একটা যুগ-প্রবর্তক পত্রিকা। আধুনিক বঙ্গ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনেক বিষয়েই আমরা ইংরেজদের কাছে ঋণী। সাময়িকপত্রেও ইংরেজ মিশনারীরাই আমাদের পথপ্রদর্শক।


শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত দিগদর্শন প্রথম বাঙলা সাময়িক পত্রিকা। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান, মার্শম্যানের সম্পাদনায় এই বছরে মে মাসেই সমাচার দর্পণ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বাঙলাদেশের সাংবাদিকতা এবং সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে সমাচার দর্পণ’-এর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ৩৫ বছর কাল এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সমাচার দর্পণ সম্পাদনায় মার্শম্যানকে সহায়তা করতেন জয়গােপাল তর্কালঙ্কার, তারিণীচরণ শিরােমণি প্রভৃতি সংস্কৃত পণ্ডিত। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম অংশের সামাজিক ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই পত্রিকার পৃষ্ঠাগুলিতে সঞ্চিত হয়ে আছে। এর পরিচালকগণ খ্রীষ্টান মিশনারী হলেও প্রত্যক্ষভাবে ধর্মপ্রচারের কাজে পত্রিকাটিকে ব্যবহার করা হয় নি। সমকালীন সমাজজীবনের বহুমুখী স্রোতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকার ফলে এবং সাধারণ পাঠকদের কাছে সহজবােধ্য হবার প্রয়ােজনে সমাচার দর্পণের ভাষা যে কত সহজ, প্রাঞ্জল ও গতিশীল ছিল, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাঠ্যপুস্তকগুলির ভাষার সঙ্গে তুলনা করলেই বােঝা যায়। সমাচার দর্পণে’ প্রকাশিত 'বাবু' বিষয়ক ব্যঙ্গাত্মক নকশা পরবর্তীকালের সামাজিক ব্যঙ্গমূলক নকশা প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালের প্রেরণার উৎস।


কলকাতা থেকে বাঙালীর সম্পাদনায় প্রকাশিত প্রথম সাময়িক পত্র বাঙ্গাল গেজেটি (সাপ্তাহিক)। শ্রীরামপুর ছাপাখানার একজন প্রাক্তন কর্মচারী গঙ্গাকিশাের ভট্টাচার্য এই পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন। ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়; এর পরেই উল্লেখ করতে হয় রামমােহন রায়-কর্তৃক প্রকাশিত ব্রাহ্মণ সেবধি পত্রিকার কথা। ব্রাহ্মণ সেবধির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৮২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এর এক পৃষ্ঠায় বাঙলা এবং অপর পৃষ্ঠায় তার ইংরেজী অনুবাদ মুদ্রিত হত। খ্রীষ্টান মিশনারীদের সঙ্গে ধর্মসংক্রান্ত বিচার-বিতর্কই 'ব্রাহ্মণ সেবধি' প্রকাশের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।


রামমােহন-যুগের সবচেয়ে খ্যাতিমান সম্পাদক ছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভবনীচরণের সংবাদ কৌমুদী (ডিসেম্বর, ১৮২১) সেই সময়ে হিন্দু সমাজের মুখপত্র ছিল। রামমােহন রায় প্রথমাবধি এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তার বহু প্রগতিশীল মতবাদ এই পত্রিকার মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। ক্রমে ধর্ম বিষয়ে রামমােহনের সঙ্গে মতবিরােধ দেখা দেওয়ায় ভবানীচরণ 'সম্বাদ-কৌমুদী' পরিত্যাগ করে যান এবং ১৮২২ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে সমাচার চন্দ্রিকা প্রকাশ করেন। সমাচার চন্দ্রিকার পর ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত বঙ্গদুতে র নাম উল্লেখযােগ্য। বঙ্গদূতের সম্পাদক ছিলেন নীলরত্ন হালদার এবং পরিচালকমণ্ডলীর মধ্যে। ছিলেন রামমােহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর ইত্যাদি। ইয়ং বেঙ্গলদের মুখপত্র সাপ্তাহিক জ্ঞানান্বেষণ ১৮৩১ সালের ১৮ই জুন প্রকাশিত হয়েছিল। গৌরীশংকর তর্কবাগীশ সম্পাদকীয় কাজ করতেন। ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারীর পর পত্রিকাটি ইংরেজি ও বাঙলায় প্রকাশিত হতে থাকে, প্রায় দশ বছর চলার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। বাঙলার নবজাগরণের একটি দিগদর্শনরূপে পত্রিকাটির মূল্য স্বীকার করতে হয়। এই পত্রিকাগুলির মুখ্য বিষয় ছিল ধর্ম ও সমাজ-সম্পর্কিত বিষয়। রামমােহনের প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রভাবে সমাজের মধ্যে যে নানামুখী বিচার-বিতর্ক আলােড়িত হচ্ছিল স্বভাবতই পত্রিকাগুলির রচনায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে। লক্ষ্য করবার বিষয় এইসব বিচার-বিতর্কের সূত্রেই নবগঠিত বাঙলা গদ্য বৃহৎ জনসমাজের চিন্তা-ভাবনার বাহন হয়ে ওঠে। পাঠ্যপুস্তকের গণ্ডী থেকে বাইরে এসে বাঙলা গদ্যকে সচল জীবনপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে এই পত্রিকাগুলি গদ্যভাষার বিকাশ ত্বরান্বিত করেছে।


বাঙলা সাময়িক পত্রিকার এক নতুন যুগের সূত্রপাত হয় সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১) থেকে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনা-পদ্ধতি থেকে বােঝা যায় সাময়িক পত্রিকা-সম্পর্কে তিনি একটি উন্নত আদর্শ সম্মুখে রেখে 'সংবাদ প্রভাকর' প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকাটিকে তিনি শুধুমাত্র সংবাদ পরিবেশন এবং ধর্মবিষয়ক বিতর্কের মধ্যে নিবদ্ধ না রেখে সাহিত্যচর্চার মাধ্যম করে তুললেন। বিশেষ কোন ধর্মমত বা সংস্কারমূলক আন্দোলনের মুখপত্ররূপেই এর আগে অপর পত্রিকাগুলি প্রকাশিত হত কিন্তু 'সংবাদ প্রভাকর' সংবাদ পরিবেশন-বিষয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে এবং সামগ্রিক সমাজচিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করে। এর সঙ্গে 'সংবাদ প্রভাকর'-এর একটা বড় আকর্ষণ ছিল সাহিত্যিক রচনাবলী। এই পত্রিকায় ঈশ্বর গুপ্ত বিস্মৃত-প্রায় সাহিত্যের সংকলন প্রকাশ করতেন। প্রাচীন কবিদের জীবনী-সম্পর্কিত আলােচনা এবং সমসাময়িক সাহিত্যের সমালােচনা দ্বারা তিনি নব্যবঙ্গের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করেন। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিম ও দীনবন্ধুর মতাে প্রতিভাসম্পন্ন লেখকদের তিনিই সংবাদ প্রভাকরের মাধ্যমে সাহিত্যক্ষেত্রে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন। ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নব্য-বাঙলার সাহিত্যচর্চার বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা ক্রমে সংগঠিত হয়ে ওঠে। এদিক থেকে সংবাদ প্রভাকরের ভূমিকা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রামমােহন এবং বিদ্যাসাগর দেবেন্দ্রনাথের মধ্যবর্তী যুগে ঈশ্বর গুপ্তই বাঙলা সাহিত্যে নায়কত্ব করেছেন। ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দের জুন থেকে 'সংবাদ প্রভাকর' দৈনিক সংবাদপত্ররূপে প্রকাশিত হতে থাকে, বাঙলা ভাষায় সংবাদ প্রভাকর ই প্রথম দৈনিক পত্রিকা।


১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তত্ত্ববােধিনী পত্রিকা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করেন এবং অক্ষয়কুমার দত্তকে এর সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্ব বহনের জন্য তিনি একটা 'পেপার কমিটি' গঠন করেন। এই কমিটির সদস্য ছিলেন বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু প্রভৃতি। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে 'তত্ত্ববােধিনী' প্রকাশ করলেও দেবেন্দ্রনাথ দল-মত-নির্বিশেষে প্রকৃত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের এই পত্রিকা-পরিচালনার কাজে আহ্বান জানান এবং সব ব্যাপারে নিজ মতের অনুবর্তী না হওয়া সত্ত্বেও সম্পাদক অক্ষয়কুমারকে স্বাধীনভাবে কাজ করবার অধিকার দেন। প্রধানত অক্ষয়কুমারের চেষ্টাতেই পত্রিকাটি সাহিত্য, সমাজবিদ্যা, পুরাতত্ত্ব ও বিজ্ঞানচর্চার প্রধানতম মাধ্যম হয়ে ওঠে। বঙ্কিম-পূর্ব যুগের প্রধান লেখকদের মধ্যে অনেকেই এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এঁদের সমবেত প্রচেষ্টায় অচিরকালের মধ্যে তত্ত্ববােধিনী একটা প্রথম শ্রেণীর সাময়িক পত্রিকায় পরিণত হয়। 'তত্ত্ববােধিনী' পত্রিকায়ই প্রথম জটিল ও গভীর জ্ঞানবিজ্ঞানের বিশ্লেষণমূলক আলােচনায় বাঙলা গদ্যের শক্তিসামর্থ্য সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত হয়। ডিরােজিওর শিষ্য রামগােপাল ঘােষ প্রমুখ ইয়ং বেঙ্গলরা সাময়িক পত্রিকাগুলিতে গালিগালাজের কুৎসিত প্রতিযােগিতা চলত বলে ঘৃণায় তাদের স্পর্শ করতেন না। 'তত্ত্ববােধিনী' পত্রিকার মননােজ্জল রচনাগুলিই তাদের বাঙলা রচনা পাঠে উদ্বুদ্ধ করে। এই পত্রিকা মননের ক্ষেত্রে বাঙালির আত্মমর্যাদাবােধ প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।


বাঙলা গদ্যসাহিত্যে সাময়িক পত্রের দান সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সুন্দর বলেছেন- “কোন দেশেই সংবাদপত্র, এমনকি সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকাও, সাহিত্যের পর্যায়ে স্থান পায় না। বাংলা সাহিত্যে সংবাদপত্রের স্থান নির্দেশ করিতে হইতেছে তিনটি বিশেষ কারণে—


  • (১) গদ্যরীতির সরলীকরণে ও উন্নয়নে ইহার উল্লেখযােগ্য অংশ আছে, 

  • (২) ধর্মবিষয়ক বিচার বিতর্ক, আক্রমণ ও জবাবের ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার অবতারণা করিয়া ইহা বাঙলার মনীষা ও লিপিকুশলতাকে পুষ্ট করিয়াছে, এবং 

  • (৩) সমাজের উৎকেন্দ্রিকতা ও উজ্জ্বলতার ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করিয়া ইহা বাঙলা বিদ্রুপাত্মক উপন্যাসের প্রেরণা জোগাইয়াছে—এখানেই সাহিত্যের সহিত ইহার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামমােহন, প্যারীচাঁদ ও কালীপ্রসন্ন এই সাংবাদিকতার সূত্র ধরিয়াই সাহিত্যের আসরে অবতীর্ণ হইয়াছেন।”


‘বঙ্গদর্শন-পূর্ববর্তী পর্বের এইখানেই সমাপ্তি। কারণ এর পরই উল্লেখযােগ্য সাময়িকপত্র বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’—যা নিজেই একটা যুগের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে।