বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব

আনুমানিক খ্রীঃ পূঃ পঞ্চদশ শতকের দিকে আর্যভাষাভাষী জনগােষ্ঠী উত্তর-পশ্চিম সীমাঞ্চল দিয়ে ভারতে উপনীত হয় এবং ভারতের আদিবাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে প্রধানতঃ জয়লাভের মধ্য দিয়ে সপ্তসিন্ধুর তীরে বসতি বিস্তার করে। ক্রমশঃ ভারতের আদি অধিবাসীদের সহিত যেমন একদিকে তাদের মিশ্রণ ঘটে, তেমনি তারা ঐ আদি অধিবাসীদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, দেবতা-ধর্ম-ভাবনা এবং আচার-আচরণও অনেকাংশে গ্রহণ করে। উভয়ের সংমিশ্রণের ফলে ভারতের বুকে যে সভ্যতা-সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়, তাকেই বলা হয় ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি।


এই আর্যভাষা-ভাষী জনগােষ্ঠী এবং তাদের উত্তরাধিকারীগণ সাধারণভাবে 'আর্য-জাতি নামে পরিচিত হয়ে থাকেন। একথা বলার সময়ে মনে রাখতে হবে যে, আর্য কোনাে জনজাতির নাম নয়, বিশেষ ভাষাগােষ্ঠীকেই ঐতিহাসিকগণ আর্য নামে অভিহিত করেছেন। এঁরা যে ভাষায় কথা বলতেন, সেই ভাষার কিছুটা মার্জিত রূপের নিদর্শন আমরা পাই তাদের রচিত সাহিত্যেএদের মধ্যে সর্বপ্রধান বৈদিক সাহিত্য। ঋক্, যজুঃ, সাম এবং অথর্ব—এই চারিটি বেদ এবং এদের সঙ্গে উঠেছে। ঐ যুগের ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন রয়েছে ঋগবেদে। পরবর্তী সাহিত্যে ভাষায় বেশ কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বৈদিক ভাষায় সমকালেই তৎসদৃশ কিন্তু সরলতর আর একটি ভাষা প্রচলিত ছিল, যে ভাষায় সম্ভবতঃ কিছু লৌকিক সাহিত্যও রচিত হয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ঐরূপ কোন সাহিত্য একাল পর্যন্ত এসে পৌছয়নি, তবে ঐ ভাষার কিছু কিছু নিদর্শন আমরা পরবর্তী সাহিত্যে পেয়েছি। আর্যদের আগমনের প্রায় হাজার বছর পরে ঐ লৌকিক সাহিত্য ব্যবহৃত ভাষার সংস্কার সাধন করা হয়ঐ ভাষাকেই বলা হয় সংস্কৃত ভাষা তথা লৌকিক 'সংস্কৃত' বা 'ধ্রুপদী সংস্কৃত'। মহামুনি পাণিনি-রচিত অষ্টাধ্যায়ী নামক ব্যাকরণটিই লৌকিক সংস্কৃতের নিয়ামক। রামায়ণ-মহাভারত-প্রভৃতি মহাকাব্য ও পুরাণ এবং কালিদাসাদির গ্রন্থ এই সংস্কৃত ভাষাতেই রচিত।


বৈদিক সংস্কৃত ও লৌকিক সংস্কৃত—এই দু’টি প্রচলিত ও একটি লুপ্ত এই তিনটি ভাষা ব্যতীত অন্ততঃ একটি কথ্যভাষাও সমকালে প্রচলিত ছিল। এই সমুদয় ভাষাকেই একালের ভাষাবিজ্ঞানিগণ একটি সাধারণ অভিধায় অভিহিত করেন—এই নামটি প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা’; সাধারণতঃ এটিকে আমরা সংস্কৃত ভাষা নামে অভিহিত করলেও “বৈদিক সংস্কৃত এবং 'লৌকিক সংস্কৃতে'র স্বাতন্ত্র-বিষয়ে অবহিত থাকা প্রয়ােজন। খ্রীঃ পূঃ পঞ্চদশ শতক থেকে খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত এই ভাষার স্থিতিকাল।


আনুমানিক বুদ্ধদেবের সমকালে অর্থাৎ খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার কথ্যরূপটি যে পরিবর্তিত রূপ ধারণ করে, সাধারণভাবে এটি 'প্রাকৃত ভাষা নামে পরিচিত হলেও ভাষাবিজ্ঞানীরা এটিকে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা’ নামে অভিহিত করে থাকেন। আনুমানিক খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীঃ দশম শতক পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার বৎসরের কাল সীমায় বিধৃত এই মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা অন্ততঃ তিনটি সুস্পষ্ট পর্যায়ে পরিণতি লাভ করেছে। এর প্রাচীন রূপটি অর্থাৎ প্রাচীন প্রাকৃতের কাল খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। পালিভাষায় রচিত বিভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থ, অশােক এবং সমসাময়িক অপরদের গিরিগাত্রে ও স্তম্ভে রচিত অনুশাসন বা গিরিলিপি এই যুগের অন্তর্ভুক্ত। এর দ্বিতীয় পর্যায় বা মধ্য প্রাকৃতের স্থায়িত্বকাল আনুমানিক খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতক থেকে খ্রীঃ ষষ্ঠ শতক। বিভিন্ন সংস্কৃত নাটকে নারী ও অশিক্ষিত পুরুষদের ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রাকৃতমাহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, মাগধী, অর্ধমাগধী, পৈশাচী প্রভৃতি এই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। মধ্যযুগের এই মধ্যস্তরের প্রাকৃতকে সাধারণভাবে সাহিত্যিক প্রাকৃত নামে অভিহিত করা হয়। মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে অনেক কাব্য-মহাকাব্যাদি রচিত হয়েছে আর অর্ধ্মাগধী ভাষায় রচিত হয়েছে জৈনদের যাবতীয় শাস্ত্রগ্রন্থ। প্রাকৃতের অন্ত্যপর্বের স্থায়িত্বকাল খ্রীঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীঃ দশম শতক পর্যন্ত সাধারণভাবে এই অন্ত্য প্রাকৃতকে বলা হয় অপভ্রংশ এবং এরই অর্বাচীন রূপের নাম অবহটঠ (অপভ্রষ্ট)। সাহিত্যিক প্রাকৃতগুলিই কালে কালে বিভিন্ন অপভ্রংশ ও অবহটঠে রূপান্তরিত হয়। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে শৌরসেনী অপভ্রংশ/অবহটঠ ছাড়া অপর কোন অবহটুঠের নিদর্শন পাওয়া যায় না। তবে ভাষাবিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাসমাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধী অপভ্রংশ এবং মাহারাষ্ট্রী প্রকৃত থেকে মাহারাষ্ট্রী অপভ্রংশেরও উদ্ভব ঘটেছিল। যাহােক একসময় 'শৌরসেনী অবহটঠ' সমগ্র উত্তর ভারতের শিষ্ট-ভাষারূপে পরিগণিত হয়েছিল। শিষ্ট সমাজে এর ব্যবহার অন্ততঃ খ্রীঃ চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত যে প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ বিদ্যাপতি কর্তৃক অবহট্ঠভাষায় রচিত দুটি গ্রন্থ। তবে এই বিষয়ে একটি ভিন্ন অভিমতও অনুমিত হয়। প্রাকৃতের তিনস্তরেই মাগধীর পাশাপাশি গৌড়বঙ্গে 'আদি গৌড়ী প্রাকৃত', 'গৌড়ীপ্রাকৃত' এবং 'অন্ত্য গৌড়ীপ্রাকৃত’ বা 'দেশী' নামে একটি ধারাও প্রচলিত ছিল।


আনুমানিক খ্রীঃ দশম শতকের দিকেই প্রাকৃত তথা অবহট্ঠ ভাষা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা-নব্য ভারতীয় আর্যভাষারূপে এর পরিচয়। অসমীয়া, ওড়িয়া, হিন্দী, মারাঠী, পাঞ্জাবী প্রভৃতি এই নব্য ভারতীয় আর্যভাষার অন্তর্ভুক্ত। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, বাঙলা এবং অন্যান্য পূর্ব ভারতীয় আর্যভাষাগুলি মাগধী অবহট্ঠ থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। তবে বাঙলা-অসমীয়া-ওড়িয়া ধারাটি পূর্বকথিত গৌড়ীপ্রাকৃত থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার কথ্যরূপের যে ধারাটি পূর্বাঞ্চলে ‘প্রাচ্যা’-রূপে প্রচলিত ছিল, ক্রম-বিবর্তন-সূত্রে ঐটি মধ্যভারতীর আর্যভাষা তথা প্রাকৃতের আদিস্তরে শুতনুকা লিপিতে পরিণত হয়। অশােকের সমকালীন ‘শুতনুকা’ লিপিতে যে পূর্বীপ্রাচ্যার নিদর্শন রয়েছে, আগের সেই ভাষাই ক্রমবিবর্তিত হয়ে মাগধী প্রাকৃত মাগধী অপভ্রংশ ও মাগধী অবহট্‌ঠের ভিতর দিয়ে বাংলা এবং এর সহােদরা ভাষাগুলির জন্মদান করেছে।


আনুমানিক খ্রীঃ দশম থেকে খ্রীঃ দ্বাদশ শতক পর্যন্ত নব্য ভারতীয় আর্যভাষার উদ্ভবকাল বলে মনে করা হয়। এই ভাষাগুলির সৃষ্টিকালে সমগ্র উত্তর ভারতে শৌরসেনী অবহটঠের ছিল একাধিপত্য। শিষ্ট সমাজে এই ভাষার ব্যবহারই সমধিক জনপ্রিয় ছিল বলেই সম্ভবতঃ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা তথা নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় রচিত সাহিত্যকীর্তি একান্ত দুর্লভ। অবশ্য উচ্চসমাজে সংস্কৃত ছিল বিশেষভাবে সমাদৃত। একই কালে অবহট্ঠ এবং আঞ্চলিক ভাষা যে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হতাে, সৌভাগ্যক্রমে তার প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম গ্রন্থ 'চর্যাপদ' রচিত হয়েছিল সম্ভবতঃ খ্রীঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যেই এবং সম্ভবতঃ এটিই নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় রচিত প্রাচীনতম সাহিত্য। যে সকল সিদ্ধাচার্য চর্যাপদ রচনা করেছিলেন, তাঁদের একজন সরহপাদ। ইনি যে আবার অবহটঠ ভাষায়ও কিছু 'দোহা' রচনা করেছিলেন তার সন্ধান পাওয়াতেই আঞ্চলিক ভাষা ও প্রাচীনতর অবহটঠ ভাষার যুগপৎ প্রচলনের সিদ্ধান্ত সমর্থিত হয়। অবহট্ঠ ভাষা আরাে পরে, অন্তঃত পঞ্চদশ শতকেও যে ব্যবহৃত হতাে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিদ্যাপতি-কর্তৃক অবহটঠ ভাষায় রচিত দুখানি গ্রন্থ থেকে।


বাঙলা এবং এর নিকটতম সহােদরা-স্থানীয় ওড়িয়া ও অসমীয়া ভাষা সম্ভবতঃ খ্রীঃ দ্বাদশ শতক পর্যন্তও স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেনি। এর পরই ওড়িয়া এবং যােড়শ শতাব্দীর দিকে অসমীয়া ভাষা পৃথক ভাষায় পরিণত হয়। এর পর এদের গতিপথ স্ব-স্ব ধারায় চিহ্নিত হয়েছিল।


দেশ-কাল-পাত্রভেদে ভাষা এবং সাহিত্যের রূপান্তর ঘটলেও জীবজগতের মতই এখানেও বংশপ্রভাবকে অস্বীকার করা চলে না। পরিবেশ অবশ্যই ভাষা ও সাহিত্যের গঠনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে থাকে কিন্তু তৎসত্ত্বেও সুপ্রাচীন কাল থেকে ভাষা এবং সাহিত্যের যে ধারা অবস্থান্তরের মধ্য দিয়ে নব্য-ভারতীয় আর্যভাষা ও সাহিত্যের জন্মদান করেছে, তার প্রভাবও সামান্য নয়। বস্তুতঃ প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতীয় আর্যভাষা এবং সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাঙলা কিংবা অপর কোন নব্য ভারতীয় আর্যভাষা ও সাহিত্যের চর্চা সম্ভবপর নয়। এই কারণেই বিস্তৃতভাবে না হলেও সংক্ষিপ্ততম আকারে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতীয় আর্যভাষার যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া হলাে।