“মধ্যযুগে রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ জনচিত্তে যে প্রভাব বিস্তার করেছিল, ভাগবতের অনুবাদ তা' পারেনি।"-মন্তব্যটির গ্রহণযােগ্যতা বিচার কর।

বাঙলা সাহিত্যের মধ্যযুগে অনুবাদ সাহিত্যের উদ্ভবের কোন সামাজিক প্রয়োজন ছিল কি? এ যুগে রচিত অনুবাদ সাহিত্যের একটা সামাজিক পরিচয় দাও।


অন্ধকার যুগের অবসানে মধ্যযুগ:

খ্রীঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্যাপ্ত কালকে আমরা বাঙলা সাহিত্যের উদ্ভবকাল ব'লে চিহ্নিত করে থাকি। এই সময়সীমার প্রথম অর্ধাংশেরও অধিক কাল গৌড়বঙ্গে পাল বংশীয় নরপতিগণ এবং অবশিষ্ট অংশে সেন বংশীয় নরপতিগণ রাজত্ব করে গেছেন। পালরাজগণ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হলেও পৌরাণিক ধর্মের প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিলেন না, আর সেনরাজগণ ছিলেন একান্তভাবেই ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী। পূর্বোক্ত সময়সীমায় রচিত বাঙলা ভাষায় একটিমাত্র গ্রন্থই এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে-গ্রন্থটি বৌদ্ধ সহজিয়াপন্থী সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা রচিত সঙ্কেতে নিবদ্ধ সাধন-ভজন-সম্পর্কিত বিভিন্ন পদের সঙ্কলন 'চর্যাগীতি। দ্বাদশ শতকের একেবারে অন্তিম লগ্নে অথবা ত্রয়ােদশ শতাব্দীর উদ্বোধন কালেই বাঙলায় প্রথম তুর্কী আক্রমণ ঘটে। এরপর চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙলার বুকে চলে রাজনীতির জুয়াখেলা। বিধর্মী, বিভাষী, বিজাতীয় তুর্ক তাতারদের আক্রমণ ও অত্যাচারে বাঙালীর জীবনে নেমে এসেছিল অমার্জনীয় অন্ধকার। এই দেড় শতাব্দীর বন্ধ্যাকালকে আমরা বড় জোর বাঙালীর মানস-প্রস্তুতি’র কাল বলে স্বীকার করতে পারিএর বেশি কিছু নয়। বাংলার রাজনৈতিক আকাশে ইলিয়াস শাহী বংশের আবির্ভাবেই অমাবস্যার আঁধার ফিকে হয়ে এলাে বাঙালী ধীরে ধীরে আত্মরক্ষার খােলস ছেড়ে বেরিয়ে আসবার সুযােগ এবং সাহস পেলাে। বাঙলা সাহিত্যের ক্রান্তিকাল তথা অন্ধকার যুগের অবসান হলাে, দেখা দিল মধ্যযুগ।


জাগরণ-মুহূর্তে আত্মপ্রকাশের যে তাগিদ বাঙালী অনুভব করেছিল, তার কিছুটা রূপায়ণ ঘটেছিল সাহিত্য-সৃষ্টিতে। সদ্যজাগরিত জাতির তখন নতুন উদ্যম, সম্মুখে নতুন আশা। একটা কিছু করবার আকাঙ্ক্ষা তাকে পেয়ে বসেছে, অথচ সামনে কোন উচ্চ আদর্শ নেই, এছাড়া ভাষার আড়ষ্টতাও উদ্দেশ্যসিদ্ধির প্রতিবন্ধকতা করে। নতুন সৃষ্টির নেশায় তাই জাতিকে কিছুটা পিছন ফিরে তাকাতে হলাে। আমাদের পূর্বপুরুষগণ। সংস্কৃত ভাষায় যে অপূর্ব সম্পদ রেখে গেছেন, সেখান থেকে সহজেই পাওয়া যেতে পারে ভাব এবং ভাষা। আমাদের প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত এবং বিভিন্ন পুরাণে যে আদর্শ পুরুষ, জীবনযাত্রাপ্রণালী ও ভাবধারা বর্তমান রয়েছে, আমাদের নতুন জীবনের যাত্রাপথে ঐগুলিই আলােকবর্তিকারূপে দিকনির্দেশ করতে পারে। অতএব রামায়ণ- মহাভারত এবং ভাগবতপুরাণকে মাতৃভাষায় অনুবাদ করে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরার ব্যাপারে কবিদের উদ্যোগী হয়ে ওঠা ছিল একান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার অবশ্য এ ব্যাপারে বাধাও ছিল দুস্তর।


আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রকারগণ শুধু ধর্মসাহিত্যকেই নয়, কাব্যসাহিত্যকেও সংস্কৃত ভাষার নিগড়ে আবদ্ধ করে তাদের জনগণের নাগালের বাইরে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। শুধু তাই নয়, অনুবাদের মাধ্যমেও যাতে কেউ এদের সঙ্গে পরিচিত হতে না পারে, সেইজন্য নিষেধবাণী উচ্চারণ করে গেছেন সেকালের শাস্তকারগণ-

অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতাণি চ। 

ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্না রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।।


অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ এবং রামায়ণাদি কাহিনী মাতৃভাষায় কেউ শুনলেও তাকে রৌরব নরকে যেতে হয়। কাজেই শাস্ত্রকারদের এই নিষেধাজ্ঞা লঙঘন করে তার বাইরে যাওয়া বড় সহজ ব্যাপার ছিল না। যারা এই দুষ্প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন, এক সময় যে তাদেরও সর্বনেশে আখ্যা পেতে হয়েছিল, একটা বাংলা প্রবাদেই তার প্রমাণ রয়েছে—'কৃত্তিবেসে, কাশীদেশে আর বামুন ঘেসে—এই তিন সর্বনেশে'। বামুন ঘেসে’র পরিচয় জানা না গেলেও অপর দুজন যে সংস্কৃতে আবদ্ধ রামায়ণ মহাভারত বাঙলা ভাষায় অনুবাদ করার অপরাধেই নিন্দিত হয়েছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।


নিষেধ থাকা সত্ত্বেও কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস এবং আরও অসংখ্য লেখক যে নিষেধবাণী অমান্য করে বিভিন্নমহাকাব্য এবং পুরাণ-অনুবাদে অগ্রসর হয়েছিলেন, তার বহুতর কারণের মধ্যে প্রধান দুটি হলাে—যুগধর্মের পরিবর্তন এবং মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপােষকতা।


বাঙলায় তুর্কী আক্রমণের ফলে কিছুটা ইসলাম ধর্মের সাম্যবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছুটা বা আত্মরক্ষার তাগিদে বাঙলার উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তাদের সঙ্কীর্ণ মনােভাব অংশতঃ বিসর্জন দিয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং অনার্যদের সম্বন্ধে কিছুটা সহনশীল হতে বাধ্য হয়েছিল। সামাজিক আচার ব্যবহার এবং ধর্মীয় অনুশাসনে অনেকটাই শৈথিল্য এসেছিল। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যেও কিছুটা আত্মসচেতনতা দেখা দেওয়ায় তাদের মনােরঞ্জন এবং প্রয়ােজন-সাধনের উপযােগিতা দেখা দিয়েছিল। কাজেই শাস্ত্রে নির্দেশ কঠোরভাবে অনুসরণে সম্ভবতঃ আর তেমন বাধ্যবাধকতা না থাকায় অনেকেই সংস্কৃত গ্রন্থাদির অনুবাদে অগ্রসর হায়েছিলেন। দ্বিতীয় আর একটি প্রধান কারণ—মুসলমান সুলতানগণ কার্যতঃ এদেশবাসী হয়েই গিয়েছিলেন বলে তারা দেশীয় কাহিনী-বিষয়ে উৎসুক হয়ে সংস্কৃত ভাষায় আবদ্ধ মহাকাব্যাদি ভাষান্তরের জন্য কবিদের উৎসাহিত করেছিলেন। এ ছাড়াও “হিন্দুসমাজের সর্বশ্রেণীর মধ্যে নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে পৌরাণিক সাহিত্য, বিশেষতঃ রামায়ণ মহাভারতের প্রচার অত্যাবশ্যক। তাই তারা জনসমাজে অনুবাদের মারফতে রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য পৌরাণিক সাহিত্যের মূল নির্যাস প্রচারে ব্রতী হয়েছিলেন।" (ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)।


মুসলিম শাসন, মুসলিম সংস্কৃতি-বিস্তার এবং সার্বিক মুসলিম প্রাধান্যের পটভূমিকায় হিন্দুজাতির জাগরণের জন্য প্রয়ােজন ছিল তার সামনেও হিন্দুর প্রাচীন ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠিত করা। বাংলার ইতিহাসে এমন কোন কীর্তিমান পুরুষ কিংবা তার সাম্রাজ্যবিস্তার-কাহিনীর কোন উল্লেখযােগ্য নিদর্শন না থাকায় বাধ্য হয়েই সেকালের বাঙালী কবিকে শরণ নিতে হয়েছিল ধ্রুপদী সংস্কৃত মহাকাব্য এবং পুরাণের। সেখানে রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ বা পাণ্ডবাদির শৌর্যবীর্য এবং পৌরাণিক নরপতিদের কাহিনী নােতুন যুগের বাঙালীদের উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারে, এরূপ একটি মানসিকতা থেকেই অনুবাদ সাহিত্য চর্চা শুরু হয়ে থাকতে পারে—এ কথা অবিশ্বাস করার কারণ নেই। কারণ পৃথিবীর অন্যত্রও দেখা যায়, প্রাচীন ঐতিহ্যের অনুশীলন ও ধুপদী সাহিত্যের অনুবাদ নবজাগরণেরই একটা পূর্বশর্ত। কাজেই বাঙলায় চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও যােড়শ শতকীয় স্বর্ণযুগের পূর্বাভাষ-রূপে অনুবাদ-সাহিত্যের অনুশীলন একান্ত প্রাসঙ্গিক এবং স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।


এই অনুবাদসমূহ বাঙলা সাহিত্যের সমৃদ্ধিসাধনে যে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, এ বিষয়ে ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত অতিশয় মূল্যবান্ বিবেচিত হতে পারে। তিনি বলেন, “এইভাবে বাংলায় আর্য সংস্কারের প্রভাব না পড়লে বাঙলা সাহিত্য কোনদিনই লােকসাহিত্যের সীমা ছাড়তে পারত না। সাহিত্য যে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক কালের মধ্যে একটি সুগঠিত সাহিত্যকর্মরূপে সম্মানিত হয়েছে, তথাকথিত ব্রাহ্মাণ্য-সংস্কারের ছাপ না পড়লে এ সাহিত্যের এই ধরনের বিকাশ হতে পারত না অনুমান করি। তাই বাঙালী-সমাজের পুনর্গঠনের জন্য, বাঙালী ঐতিহ্যের সর্বভারতীয় প্রাণধারার সঙ্গে যােগস্থাপনের জন্য রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদাশ্রয়ী প্রভাবের এত প্রয়ােজন ছিল।"


অনুবাদ সহিত্যের তিনটি মাত্র ধারাই উল্লেখযােগ্যভাবে বাঙলা সাহিত্যের কলেবর বৃদ্ধিতে ও উৎকর্ষ-সাধনে সহায়তা করেছে। এই তিন ধারা - রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত।