ভারতের সংবিধানে বর্ণিত শােষণের বিরুদ্ধে অধিকার। ভারতীয় নাগরিকদের জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার

সংসদের মৌলিক অধিকার পরিবর্তন সংক্রান্ত ক্ষমতা


২৪তম সংবিধান সংশােধনী অনুযায়ী ভারতীয় সংসদ সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে উল্লিখিত মৌলিক অধিকার-সহ সংবিধানের যে-কোনাে অংশের পরিবর্তন করতে সক্ষম। তবে সংসদকে সংবিধানের মৌল কাঠামাে পরিবর্তনের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।


শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার

ভারতীয় সংবিধানে শােষণের বিরুদ্ধে অধিকার একটি তাৎপর্যপূর্ণ মৌলিক অধিকার। মানবসমাজে শােষণের ইতিহাস বহু পুরােনাে। বস্তুতপক্ষে, সমস্ত রকম শােষণের হাত থেকে মুক্তি না পেলে প্রকৃত স্বাধীন নাগরিক গড়ে ওঠে না। ভারতীয় সংবিধানে শােষণের বিরুদ্ধে অধিকার সংবিধানের ২৩ এবং ২৪ নং ধারায় স্বীকৃতি লাভ করেছে।


[1] ২৩ নং ধারা: সংবিধানের ২৩(১) নং ধারায় বলা হয়েছে, মানুষ নিয়ে ব্যাবসা বা মানুষ ক্রয়বিক্রয়, বিনা মজুরিতে বেগার খাটানাে এবং বলপূর্বক শ্রমদানে বাধ্য করা ইত্যাদি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এখানে মানুষের ক্রয়বিক্রয় নিষেধ বলতে দাসপ্রথা এবং অসৎ উদ্দেশ্যে নারী ও শিশু ক্রয়বিক্রয় নিষেধের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে ২৩(১) নং ধারায় কিছু ব্যতিক্রম উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলি হল―


  • (i) রাষ্ট্র যদি মনে করে তাহলে জনস্বার্থে ধর্ম বর্ণ জাতি শ্রেণি নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিককে শ্ৰমদানে বাধ্য করতে পারে, 


  • (ii) তা ছাড়া রাষ্ট্র সামরিক শিক্ষাগ্রহণ ও সমাজসেবার কাজকে বাধ্যতামূলক করতে চেয়ে আইন প্রণয়ন করলে, ওই আইন সংবিধানের ২৩(১) নং ধারার বিরােধী বলে গণ্য হবে না।


[2] ২৪নং ধারা: সংবিধানের ২৪ নং ধারা অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সের শিশুদের খনি, কারখানা বা অন্য কোনাে বিপজ্জনক কাজে নিয়ােগকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, এই মৌলিক অধিকারটিকে বাস্তবায়িত করার জন্য সংসদ কয়েকটি প্রয়ােজনীয়। আইন প্রণয়ন করে। সেগুলি হল 'Factories Act 1948, 'The Mines Act, 1952', এবং The Child Labour (Prohibition and Regula tion) Bill, 1986' প্রভৃতি। সম্প্রতি ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর ভারত সরকারের শ্রমমন্ত্রক শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি আদেশ জারি করেছেন। এর ফলে ঘরে ও বাইরে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত কোনাে শিশুকে শ্রমে নিয়ােগ নিষিদ্ধ বলে ঘােষণা করা হয়েছে।


মূল্যায়ন: দীর্ঘকাল যাবৎ ঔপনিবেশিক শােষণে নিষ্পেষিত ভারতবর্ষে স্বাধীনতার পরে রচিত সংবিধানে শােষণের বিরুদ্ধে যে অধিকার লিপিবদ্ধ হয়েছে তা আদৌ যথেষ্ট নয় বলে অনেকে মনে করেন। ভারতে আজও বেগার শ্রম এবং অভিশপ্ত শিশুশ্রম বহাল তবিয়তে রয়েছে। লক্ষলক্ষ শিশুশ্রমিক প্রকাশ্যে বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত রয়েছে। অল্প মজুরি দিয়ে স্বার্থান্ধ মালিক গােষ্ঠী তাদের উজ্জ্বল সন্তাবনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করে চলেছে। একুশ শতাব্দীর এই উন্নত প্রযুক্তির সভ্যতায় ভারতবর্ষে নারী পাচার আজ শুধু একটি সামাজিক সমস্যা নয়, এ হল এক জ্বলন্ত অভিশাপ। সংবিধান-বিশেষজ্ঞ কে ভি রাও যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, শােষণের বিরুদ্ধে অধিকারের কথা ঘােষিত হলেও বাস্তবে ভারতীয় সংবিধানে এই অধিকার স্বীকৃত হয়নি।


আইন-নির্দিষ্ট পদ্ধতি


ভারতীয় সংবিধানের ২১নং ধারায় বলা হয়েছে যে, 'আইন-নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছাড়া কোনাে ব্যক্তিকে তার জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আইন-নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী কোনাে আইন ন্যায়নীতিবিরােধী কি না আদালত তা বিচার করতে পারে না, শুধুমাত্র যে আইন অনুযায়ী ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হবে সেই আইনটি বিধিসম্মতভাবে আইনসভা কর্তৃক প্রণীত কি না তা বিচারের ক্ষমতা আদালতের রয়েছে।


জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার


ভারতীয় সংবিধানের ২১ নং ধারায় বলা হয়েছে আইন-নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছাড়া কোনাে ব্যক্তিকে তার জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু আইন-নির্দিষ্ট পদ্ধতি এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণা ও প্রকৃতি নিয়ে যথেষ্ট মতবিরােধ রয়েছে। আজ পর্যন্ত এই সম্বন্ধে কোনাে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছােনাে যায়নি। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অর্থ সংকীর্ণ ও ব্যাপক দুরকমই হতে পারে। ভারতীয় সংবিধানে এটি সংকীর্ণ অর্থে স্বীকার করা হয়েছে বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।


১৯৭৮ সালে সুপ্রিমকোর্ট মানেকা গান্ধি বনাম ভারত ইউনিয়ন মামলার রায়ে ঘােষণা করে যে, ব্যক্তির জীবন ও স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আইন নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে কি না তা দেখার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট আইনটি যুক্তিসংগত বা ন্যায়সংগত কি না তা বিচার করার ক্ষমতাও আদালতের আছে। তবে আইন-নির্দিষ্ট পদ্ধতি কথাটির অর্থ নিয়ে জটিলতা থেকে গেছে। ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বর্ণিত 'আইনের যথাবিহিত পদ্ধতির পরিবর্তে জাপানি সংবিধানের 'আইন-নির্দিষ্ট পদ্ধতি কথাটিকে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেন। আইন-নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী আদালত কোনাে আইন ন্যায়নীতিবিরাধী কি না তা বিচার করতে পারে না, শুধুমাত্র যে আইন অনুযায়ী ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হবে, সেই আইনটি বিধিসম্মতভাবে আইনসভা কর্তৃক প্রণীত কি না তা বিচারের ক্ষমতা আদালতের থাকবে।


প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বর্তমানে সংবিধানের ২১ নং ধারায় উল্লিখিত জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার ১৯৭৮ সালের ৪৪তম সংবিধান সংশােধনীর পর একটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। এই সংশােধনী অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কোনাে অবস্থাতেই ২১নং ধারায় উল্লিখিত জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার স্থগিত রাখতে পারবেন না।


সম্প্রতি ২০০২ সালে ৮৬তম সংবিধান সংশােধনী আইনের মাধ্যমে ২১(ক) নামে নতুন একটি ধারা সংযােজন করে শিক্ষার অধিকারকে মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এই ধারায় ঘােষণা করা হয়েছে যে, রাষ্ট্র ৬-১৪ বছর বয়সি বালকবালিকাদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করবে।


জাতিপুঞ্জের ঘােষণাপত্রে বিবৃত মানবাধিকারসমূহ । মানবাধিকার এবং অন্যান্য অধিকারের মধ্যে পার্থক্য । মানবাধিকারের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ । মানবাধিকারের সংজ্ঞা


ভারতের সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমূহকে লিপিবদ্ধ করার কারণ । মৌলিক অধিকারের সংজ্ঞা এবং প্রকৃতি । ইতিবাচক ও নেতিবাচক মৌলিক অধিকার কাকে বলে? জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকারগুলির বৈধতা


ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারগুলির বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।


ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকারটি আলোচনা করাে । ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত স্বাধীনতার অধিকার সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােচনা করাে।


ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কী বােঝায়? ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দাও।


ভারতের সংবিধানে সম্পত্তির অধিকারের সাংবিধানিক মর্যাদা কী? ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার সম্পর্কে আলােচনা করাে।


সংবিধানে ২২ নং ধারায় বর্ণিত গ্রেফতার বা অটিক সংক্রান্ত ব্যবস্থাদি-সহ নিবর্তনমূলক আটক আইন । ভারতের সংবিধানে সংরক্ষিত সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার । সম্প্রতি সংযােজিত ১১ নং মৌলিক কর্তব্য