ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারগুলির বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।

ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারগুলির বৈশিষ্ট্য

অধিকার বলতে সমাজজীবনের এমন সব শর্তাবলিকে বােঝায় যেগুলির অভাবে কোনাে মানুষের পক্ষেই তার অন্তর্নিহিত গুণাবলি বিকশিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু সব অধিকারই মৌলিক নয়। মৌলিক অধিকার হল সেইসব অধিকার যেগুলি মানুষের মৌল প্রয়ােজন পূরণ করে। একারণেই ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত মৌলিক অধিকারগুলির বৈশিষ্ট্যসমূহ হল―


[1] অধিকারগুলি মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক: ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারগুলির প্রথম বৈশিষ্ট্য হল, অধিকারগুলি চরিত্রগত দিক থেকে মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অধিকারের ওপর কোনাে গুরুত্বারােপ করা হয়নি। সংবিধান প্রণেতাগণ অর্থনৈতিক অধিকার হিসেবে সম্পত্তির অধিকারকে গুরুত্ব দিলেও ৪৪তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।


[2] সার্বিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি: ভারতীয় সংবিধানে সংযােজিত মৌলিক অধিকারের মাধ্যমে সার্বিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। মৌলিক অধিকারের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিফলন ঘটলেও অর্থনৈতিক ন্যায়ের কোনােরূপ প্রকাশ ঘটেনি।


[3] অধিকারগুলি অবাধ নয়: ভারতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত নয়। সামাজিক শৃঙ্খলা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি, বিদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্করক্ষা, জনস্বার্থ ইত্যাদি কারণে মৌলিক অধিকারের ওপর বাধানিষেধ আরােপ করা যায়। এ ছাড়া প্রয়ােজনবােধে রাষ্ট্র নাগরিকদের অধিকারের ওপর 'যুক্তিসংগত বাধানিষেধ' আরােপ করতে পারে।


[4] অধিকারগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য: ভারতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য। অর্থাৎ, কোনাে নাগরিক তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে আদালতে আবেদন করতে পারে এবং আদালত তা পুনর্বহালের ব্যবস্থা করে। এ ছাড়াও সংবিধানের ১৩নং ধারা অনুযায়ী মৌলিক অধিকার ক্ষুগ্প করে কোনাে আইন প্রণীত হলে তা বাতিল হয়ে যায়।


[5] জরুরি অবস্থায় কার্যকর হয় না: দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে নাগরিকগণ মৌলিক অধিকার ভােগ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। সংবিধান অনুযায়ী দেশে জরুরি অবস্থা জারি থাকলে সংবিধানের ১৯নং ধারায় বর্ণিত মৌলিক অধিকার ভােগ থেকে নাগরিকগণ বঞ্চিত হন। এ ছাড়াও জরুরি অবস্থা বলবৎ থাকাকালীন রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৩৫৯নং ধারা অনুযায়ী আদেশ জারির মাধ্যমে আদালত কর্তৃক মৌলিক অধিকার কার্যকরী করার ব্যবস্থা বাতিল করতে পারেন।


[6] সকল মৌলিক অধিকার সকলের জন্য নয়: ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত মৌলিক অধিকারের কতকগুলি কেবল ভারতীয় নাগরিকরাই ভােগ করতে পারে, যেমন—মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, চাকরির ক্ষেত্রে সমানাধিকার ইত্যাদি। আবার কতকগুলি মৌলিক অধিকার আছে যেগুলি নাগরিক ও বিদেশি নির্বিশেষে সকলেই ভােগ করতে পারে, যেমন—আইনের চোখে সমানাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রভৃতি।


[7] অধিকারগুলি সংশােধনযােগ্য: ভারতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি সংশােধনযােগ্য, অলঙ্ঘনীয় নয়। ১৯৭১ সালে ২৪তম সংশােধন দ্বারা সংসদের হাতে মৌলিক অধিকার সংশােধনের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। এই ক্ষমতাবলে সংসদ 88তম সংবিধান সংশােধন করে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার থেকে বাদ দেয়।


[8] ধর্মনিরপেক্ষতা: ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলি অসাম্প্রদায়িক। স্বীকৃত অধিকারসমূহের মাধ্যমে কোনাে বিশেষ ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অনুকূলে বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যবস্থা করা হয়নি।


[9] সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা: ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকারের অধ্যায়ে সংখ্যালঘু ও অনুন্নত শ্রেণির জন্য বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। তপশিলি জাতি, উপজাতি, অন্যান্য অনুন্নত সম্প্রদায় ও ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের জন্য এই সুযােগ প্রসারিত করা হয়েছে।


[10] ইতিবাচক ও নেতিবাচক: ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারগুলিকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক এই দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। ইতিবাচক অধিকার বলতে সেই অধিকারগুলিকে বােঝায় যেগুলির মাধ্যমে জনগণকে কিছু সুযােগসুবিধা দেওয়া হয়েছে, যেমন, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার প্রভৃতি। আর নেতিবাচক অধিকার হল সেই অধিকার যেগুলি রাষ্ট্রকে কোনাে কিছু করা থেকে বিরত করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার ও আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়।


মূল্যায়ন: উপরােক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায় যে, ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারসমূহের প্রকৃতি মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অধিকারের কোনাে স্বীকৃতি নেই। অর্থনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি ছাড়া অধিকারের ধারণা সম্পূর্ণ হতে পারে না। মৌলিক অধিকারগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য। হলে সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে অধিকারগুলিকে পরিবর্তন বা বাতিল করা যায়। সুতরাং, সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলিকে বিশেষ মর্যাদা প্রদানের চেষ্টা করা হলেও বর্তমানে মৌলিক অধিকার এই মর্যাদা হারাতে চলেছে বলে মনে হয়।


মন্ত্রীসভা-চালিত এবং রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের মধ্যে পার্থক্য | রাষ্ট্রপতি-শাসিত ও সংসদীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য লেখাে।


ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করাে | ভারতে সংসদীয় ব্যবস্থার স্বরূপ বর্ণনা করাে।


অধিকার বলতে কী বােঝ? পৌর অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে আলােচনা করাে।


অধিকারের রূপভেদ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করাে। অর্থনৈতিক অধিকার এবং সামাজিক ও কৃষ্টিগত অধিকার সম্পর্কে আলােচনা করাে।


নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটি আলােচনা করাে । অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করাে।


জাতিপুঞ্জের ঘােষণাপত্রে বিবৃত মানবাধিকারসমূহ । মানবাধিকার এবং অন্যান্য অধিকারের মধ্যে পার্থক্য । মানবাধিকারের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ । মানবাধিকারের সংজ্ঞা


ভারতের সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমূহকে লিপিবদ্ধ করার কারণ । মৌলিক অধিকারের সংজ্ঞা এবং প্রকৃতি । ইতিবাচক ও নেতিবাচক মৌলিক অধিকার কাকে বলে? জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকারগুলির বৈধতা