যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার গুণ-দোষ বা সুবিধা-অসুবিধাগুলি আলােচনা করাে।

যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার গুণ বা সুবিধা

যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার কয়েকটি উল্লেখযােগ্য গুণ বা সুবিধা আছে一


[1] ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রধান গুণ হল দেশের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতি অনুসরণ। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্র এবং অঙ্গরাজ্যগুলির সরকারের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতা বণ্টিত হওয়ায় কোনাে সরকারের কাছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় না।


[2] দুই ধরনের স্বার্থের সমন্বয়: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের সার্থক সমন্বয় ঘটে। নিজেদের আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় একদিকে যেমন অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলি গড়ে ওঠে, অন্যদিকে তেমনই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও জাতীয়তাবােধ নিয়ে গড়ে ওঠে জাতীয় সরকার।


[3] আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র সংরক্ষণ: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যগুলি সংরক্ষিত হয়। বস্তুজাতি-সমন্বিত বিশাল বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে বহু ধরনের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলি নিজ নিজ রাজ্যের ভাষা ও সংস্কৃতিগত আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করে।


[4] আঞ্চলিক সমস্যাসমাধানের সহায়ক: যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রধান গুণ হল রাজ্য সরকারগুলি আঞ্চলিক সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকায়, সেগুলির দ্রুত এবং কার্যকরী সমাধান সম্ভব হয়। এইভাবে আঞ্চলিক স্বার্থ ও স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদ জন্মাতে পারে না।


[5] স্বৈরাচার প্রতিরােধক: অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় একটি দুষ্পরিবর্তনীয় লিখিত সংবিধান যাবতীয় শাসনক্ষমতা কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে বণ্টন করায় স্বৈরাচারের আশঙ্কা থাকে না। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে না।


[6] গণতান্ত্রিক: অনেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক বলে মনে করেন। এই শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ নীতিকে বাস্তবায়িত করা যায় বলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শাসনকার্যে অধিক সংখ্যক জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ সন্তব।


[7] রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে সহায়ক: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হওয়ায় আঞ্চলিক স্তরে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে জনগণ আরও ব্যাপকভাবে শাসনকাজে অংশগ্রহণের সুযােগ পায়। এর ফলে জনগণের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে।


[8] আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব হ্রাস: অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সমগ্র দেশের প্রশাসন কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যগুলির জনপ্রতিনিধিদের হাতে থাকে বলে আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব হ্রাস পায়।


[9] প্রশাসনিক উৎকর্ষ: সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকে বলে উভয় সরকারের পক্ষে নিজেদের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুষ্ঠুভাবে প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করা সম্ভব হয়। এর ফলে প্রশাসনিক উৎকর্ষ ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।


যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার দোষ বা অসুবিধা


যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাও সম্পূর্ণ ভুটিমুক্ত নয়। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় নিম্নলিখিত অসুবিধা বা ত্রুটির কথা বলা হয়


[1] প্রশাসনিক জটিলতা: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর সমগ্র দেশের এবং রাজ্য সরকারগুলির ওপর নিজ নিজ রাজ্যের শাসনভার ন্যস্ত থাকে। এর ফলে একই বিষয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন আইন প্রণয়নের সম্ভাবনা থেকে যায়। এতে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।


[2] মন্তর গতিসম্পন্ন: যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত কোনাে বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে গেলে রাজ্যগুলির সম্মতির প্রয়ােজন হয়। সেক্ষেত্রে সম্মতি আদায়ের কারণে অহেতুক বিলম্ব দেখা দিতে পারে। অনেক সময় কোনাে-একটি বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রশ্নে ক্ষমতা বা এক্তিয়ারের ব্যাপারে কেন্দ্র-রাজ্য বিরােধের সৃষ্টি হতে পারে। এই কারণে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে মন্থর গতিসম্পন্ন বলে সমালোচনা করা হয়।


[3] দুর্বল শাসনব্যবস্থা: যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিধান অনুসারে অঙ্গরাজ্যগুলির স্বাধীন সত্তা ও স্বাতন্ত্রের সংস্থান থাকায় রাজ্যের আলিক সরকারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কেন্দ্রের থাকে না। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে মতবিরােধ দেখা দিলে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে।


[4] বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা: অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় দ্বৈত নাগরিকত্বের নীতি অনুসৃত হওয়ায় নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় আনুগত্য খণ্ডিত হয়। এর ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।


[5] আইনগত জটিলতা: জাতীয় সংকট, যুদ্ধ বা জরুরি অবস্থার সময়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে অনেকে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত বলে রায় দিয়েছেন। তাঁদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় আইনগত জটিলতা এত বেশি যে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সত্বর কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সহজ নয়।


[6] ব্যয়বহুল কাঠামাে: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার একটি বড়াে দুটি হল এর ব্যয়বহুল কাঠামাে। কেন্দ্রের জাতীয় সরকার ও অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য আঞ্চলিক সরকারের শাসনকার্য পরিচালনায় বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় হয়। এ ছাড়া কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির নির্বাচন এবং আঞ্চলিক স্বণ্যসিত সংস্থাপ্পুলির নির্বাচনেও প্রচুর খরচ হয়।


[7] আদালতের কর্তৃত্ব: যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে আদালতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। আদালত এই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে অনেক সময় শাসন বিভাগ এবং আইন বিভাগের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।


[8] কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের অবনতি: সংবিধান কর্তৃক কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দেওয়া থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামােয় এটা দেখা যায় যে, আর্থিক বিষয়ে রাজ্যগুলিকে বিশেষভাবে কেন্দ্রনির্ভর করে রাখা হয়। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির কারণে কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর ফলে কেন্দ্র রাজ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।


উপসংহার: যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দোষ-গুণ বিশ্লেষণের শেষে এ কথা বলা যায় যে, দ্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও বৃহদায়তন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা একান্ত অপরিহার্য।


সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদের ভূমিকার সীমাবদ্ধতা আলোচনা করাে। খসড়া কমিটির কয়েকজন সদস্যের নাম লেখাে। 


ভারতের সংবিধান সুপরিবর্তনীয়তা ও দুস্পরিবর্তনীয়তার মিশ্রণ-ব্যাখ্যা করাে। ভারতীয় সংবিধান কোন্ তারিখে গৃহীত হয় এবং কার্যকরী হয়? 


ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্র ব্যাখ্যা করাে। তুমি কি ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র' বলে মনে কর?  সংবিধানের মূল কাঠামাে (Basic Structure) কী?


ভারতের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে সংবিধানের প্রাধান্য ব্যাখ্যা করাে। 'সংবিধানের প্রাধান্য' বলতে কী বোঝায় | ভারতীয় সংবিধানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করাে।


এককেন্দ্রিক সরকার কাকে বলে? এককেন্দ্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ করাে।


এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার গুণ-দোষ বা সুবিধা-অসুবিধাগুলি আলােচনা করাে।


যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বলতে কী বােঝ? যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।