নির্দেশমূলক নীতির গুরুত্ব বা তাৎপর্য । ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্দেশমূলক নীতিসমূহের মধ্যে মূল পার্থক্য

নির্দেশমূলক নীতির শ্রেণিবিভাগ


নির্দেশমূলক নীতিসমূহকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- [1] আর্থসামাজিক, [2] প্রশাসনিক, [3] উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কিত এবং [4] আন্তর্জাতিক আদর্শ-সংবলিত নির্দেশমূলক নীতিসমূহ।


মৌলিক অধিকার ও নির্দেশমূলক নীতির পার্থক্য

সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের সঙ্গে চতুর্থ অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্দেশমূলক নীতির কিছু মৌলিক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। মৌলিক অধিকারের সঙ্গে বিরােধ ঘটলে নির্দেশমূলক নীতি বাতিল হয়ে যায়। সুপ্রিমকোর্ট ১৯৫১ সালে মাদ্রাজ রাজ্য বনাম চম্পকম মামলার এবং ১৯৫৮ সালে হানিফ কুরেশি বনাম বিহার রাজ্য মামলার রায়দানকালে ঘােষণা করেন, নির্দেশমূলক নীতিপুলিকে মৌলিক অধিকারের পরিপূরক ও সংগতিপূর্ণ হতে হবে এবং রাষ্ট্রকে নির্দেশমূলক নীতিগুলি এমনভাবে কার্যকর করতে হবে যাতে মৌলিক অধিকারগুলি ক্ষুন্ন না হয়। মৌলিক অধিকার ও নির্দেশমূলক নীতিগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য পার্থক্যপুলি হল-


মৌলিক অধিকার


  • মৌলিক অধিকারগুলি রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যেসব কাজ করা উচিত নয়, মৌলিক অধিকারগুলি সেই নির্দেশ জারি করে।

  • মৌলিক অধিকারগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য।

  • কোনাে মৌলিক অধিকারকে কার্যকর করতে গেলে আইনসভাকে তার জন্য আলাদাভাবে আইন প্রণয়ন করতে হয় না।

  • সংবিধানের ১৩ নং ধারা অনুযায়ী আইনসভার কোনাে আইন অথবা, শাসন বিভাগের কোনাে নির্দেশ যদি মৌলিক অধিকারের বিরােধী হয়, তাহলে আদালত সেই আইন বা নির্দেশকে বাতিল ঘােষণা করতে পারে।

  • নাগরিকদের ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য মৌলিক অধিকারগুলি রাষ্ট্র কর্তৃত্বের পরিধিকে সংকুচিত করে।

  • মৌলিক অধিকারগুলি স্থিতিশীল মূল সংবিধানে মৌলিক‌ অধিকারগুলি যেভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছিল তা এখনও সেভাবেই রয়েছে। কোনাে নতুন মৌলিক অধিকার আজ পর্যন্ত সংযােজিত হয়নি।

  • মৌলিক অধিকারগুলির উদ্দেশ্য হল গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন করা সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলির প্রকৃতি মূলত রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত।


নির্দেশমূলক নীতি


  • নাগরিক অধিকারের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের কী কী কাজ করা উচিত, নির্দেশমূলক নীতিগুলি রাষ্ট্রকে সে সম্পর্কে বিভিন্ন ইতিবাচক নির্দেশ দিয়ে থাকে।

  • সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে বর্ণিত নির্দেশমূলক নীতিগুলির ব্যাপারে আদালতের কোনাে দায়বদ্ধতা নেই। নির্দেশমূলক নীতিগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য নয়।

  • নির্দেশমূলক নীতি কার্যকর করতে গেলে আলাদাভাবে আইন প্রণয়ন করতে হয়।

  • নির্দেশমূলক নীতির বিরােধী কোনাে আইন বা নির্দেশ আদালত বাতিল করতে পারে না।

  • নির্দেশমূলক নীতিগুলি বহুমুখী অর্থনৈতিক ও সামাজিক আদর্শকে রূপায়ণ করার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃত্বের পরিধিকে প্রসারিত করে।

  • নির্দেশমূলক নীতিগুলি পরিস্থিতির তাগিদে পরিবর্তিত ও সংযােজিত হয়।

  • রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্দেশমূলক নীতিগুলি জনকল্যাণকামী সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলার পক্ষপাতী। নির্দেশমূলক নীতিগুলি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।


নির্দেশমূলক নীতির দুটি উৎস


নির্দেশমূলক নীতির দুটি উৎস হল- [1] ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রের আদর্শ, [2] ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন।


নির্দেশমূলক নীতির গুরুত্ব বা তাৎপর্য


নির্দেশমূলক নীতিগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য না হওয়ায় অনেকে এগুলিকে সংবিধান-রচয়িতাদের নৈতিক উপদেশ ও 'রাজনৈতিক ইস্তাহার বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা বিভিন্ন কারণে এই নীতিগুলির তাৎপর্যকে অস্বীকার করতে পারি না।


[1] এই নীতিগুলি হল জনকল্যাণের জন্য সরকারের প্রতি সংবিধানের নির্দেশ। এর জন্য কোনােরকম আইনগত সমর্থন না থাকলেও নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন যথেষ্ট রয়েছে। এই প্রসঙ্গে ড. আম্বেদকরের অভিমত হল, যদি কোনাে সরকার এই নীতিগুলি উপেক্ষা করে তাহলে সেই সরকারকে নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।


[2] সংবিধান বিশেষজ্ঞ পানিক্কারের মতে, মৌলিক অধিকারগুলি যখন ভারতে রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তখন নির্দেশমূলক নীতিগুলি আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতীয় গণতন্ত্রকে পরিপূর্ণতা দানের চেষ্টা করেছে।


[3] আপাতদৃষ্টিতে নীতিগুলির কোনাে আইনগত তাৎপর্য নেই বলে মনে হলেও এই ধারণা ঠিক নয়। সুপ্রিমকোর্ট নির্দেশমূলক নীতির ওপর ভিত্তি করে আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিচার করেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বিহার রাজ্য বনাম কামেশ্বর সিং (১৯৫২), বালসারা বনাম বোম্বাই রাজ্য (১৯৫১), কেরল শিক্ষা বিল (১৯৫৮) প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।


[4] নির্দেশমূলক নীতিসমূহের প্রতি সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও সদর্থক মনােভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি বিভিন্ন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন নির্দেশমূলক নীতিকে বাস্তবায়িত করেছে। একাধিকবার সংবিধান সংশােধনও করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে জমিদারি প্রথা বিলােপ, ব্যাংক-বিমা জাতীয়করণ, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রবর্তন, সমাজ উন্নয়ন পরিকল্পনা, অবৈতনিক প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়।


[5] সংবিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কে সি হােয়ারের মতে, নির্দেশমূলক নীতির আদর্শ প্রাচীন হলেও এদের পুনরাবৃত্তি প্রয়ােজন। কারণ এই নীতিগুলি জনগণকে তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে। এম ভি পাইলির মতে, নির্দেশমূলক নীতিগুলি হল ভারতীয় জনগণের ন্যূনতম আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।


ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কী বােঝায়? ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দাও।


ভারতের সংবিধানে সম্পত্তির অধিকারের সাংবিধানিক মর্যাদা কী? ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার সম্পর্কে আলােচনা করাে।


সংবিধানে ২২ নং ধারায় বর্ণিত গ্রেফতার বা অটিক সংক্রান্ত ব্যবস্থাদি-সহ নিবর্তনমূলক আটক আইন । ভারতের সংবিধানে সংরক্ষিত সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার । সম্প্রতি সংযােজিত ১১ নং মৌলিক কর্তব্য


ভারতের সংবিধানে বর্ণিত শােষণের বিরুদ্ধে অধিকার । ভারতীয় নাগরিকদের জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার 


ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলির সীমাবদ্ধতা । ভারতের শাসনতন্ত্রে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলির বৈশিষ্ট্য । ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ধারাগুলি কীভাবে সংশােধন করা যায়?


কোন্ সংবিধান সংশােধনীর মাধ্যমে মৌলিক কর্তব্যগুলি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে? ভারতীয় সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলির প্রকৃতি মূল্যায়ন করাে।


রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্দেশমূলক নীতিসমূহ । রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্দেশমূলক নীতিগুলির বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করাে।