ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত নির্দেশমূলক নীতিগুলির তাৎপর্য আলােচনা করাে।

ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত নির্দেশমূলক নীতিগুলির তাৎপর্য

ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংকল্প ঘােষণা করা হয়েছে। এই সংকল্পের বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে নির্দেশমূলক নীতিসমূহ সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, শাসনকার্য পরিচালনা ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এই নীতিগুলিকে অনুসরণ করবে।


কিন্তু সংবিধানে বর্ণিত এই নীতিগুলিকে বলবৎ করার ক্ষেত্রে কিছু গুটি বা দুর্বলতা থাকায় নীতিগুলি আজও উপেক্ষিত। দুর্বলতাগুলি হল一


[1] নীতিগুলি আদালতে বলবৎযােগ্য নয়। তাই এই নীতিপুলিকে সংবিধানের শােভা বা সংবিধান-প্রণেতাগণের সদিচ্ছার প্রকাশ বলা যায়।


[2] নীতিগুলির রূপায়ণের বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। ফলে নীতিগুলি আজও উপেক্ষিত।


[3] নীতিগুলিকে প্রয়ােগ করার জন্য সংবিধানে প্রয়ােজনীয় বিধির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।


[4] নীতিগুলি নাগরিকদের জন্য কোনাে অধিকারের স্বীকৃতি দেয়নি।


নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে রূপায়ণের ক্ষেত্রে কিছু আইনগত ও অন্যান্য অসুবিধা থাকলেও, নীতিগুলির গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে কোনােমতেই অস্বীকার করা যায় না।


[1] রাজনৈতিক তাৎপর্য: আইনগত সমর্থন না থাকলেও নির্দেশমূলক নীতিগুলির রাজনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে উপেক্ষা করা যায় না। নীতিগুলি হল সরকারের প্রতি সাংবিধানিক নির্দেশ। ক্ষমতায় আসীন কোনাে দল যদি ওই নীতিগুলির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, তাহলে নির্বাচকমণ্ডলীর নিকট ওই দলকে জবাবদিহি করতে হয়। বিরােধী দলগুলি নীতিগুলির রূপায়ণে শাসকদলের উদাসীনতা ও অক্ষমতার সুযােগ নিয়ে জনমত গড়ে তােলে। ফলে জনসাধারণ পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতাচ্যুত করে অন্য দলকে ক্ষমতায় আনতে পারে। একারণে সরকার নীতিগুলিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়।


[2] সাংবিধানিক তাৎপর্য: সাংবিধানিক দিক থেকেও নীতিপুলি একেবারে গুরুত্বহীন নয়। কারণ কেন্দ্রের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোনাে রাজ্য যদি নীতিগুলিকে কার্যকর না করে, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্যকে সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ দিতে পারে। ওই নির্দেশ পালনে কোনাে রাজ্য অস্বীকার করলে কেন্দ্র সংবিধানের ৩৬৫ ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।


[3] আইনগত তাৎপর্য: নীতিগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য নয় বলে এই নীতিগুলির আইনগত গুরুত্ব নেই বলে যে ধারা প্রচলিত আছে তা ঠিক নয়। কারণ বিভিন্ন মামলায় (বালসারা বনাম বােম্বাই রাজ্য-১৯৫১, বিহার রাজ্য বনাম কামেশ্বর সিং-১৯৫২ প্রভৃতি) রায় দানের ক্ষেত্রে আদালত নির্দেশমূলক নীতিসমূহের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে এই অভিমত ব্যক্ত করেছে যে, নীতিগুলির ভিত্তিতে সামাজিক স্বার্থে প্রণীত আইনসমূহের ব্যাখ্যা ও বৈধতা বিচার করা সমীচীন। এ ছাড়াও সুপ্রিমকোর্টের রায় অনুসারে ৩৯(খ) ও ৩৯(গ) নং ধারায় বর্ণিত নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে রূপায়িত করার জন্য সংবিধানের ১৯ নং ধারায় বর্ণিত মৌলিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করে আইন প্রণীত হলেও, তা বাতিল হবে না।


[4] নৈতিক তাৎপর্য: নির্দেশমূলক নীতিগুলির মূল লক্ষ্য হল ভারতীয় জনগণের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। সরকার নীতিগুলিকে কার্যকর করতে বিলম্ব করলে ন্যায়বিচার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবে এবং সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঘােষিত ন্যায়বিচারের আদর্শ থেকে সরকার বিচ্যুত হবে। ফলে জনমতের রােষ শাসকদলের ওপর বর্ষিত হবে।


[5] সামাজিক তাৎপর্য: নির্দেশমূলক নীতিগুলির অন্যতম গুরুত্ব ও তাৎপর্য হল সাংবিধানিক উপায়ে সমাজের পরিবর্তন সাধন করা। গ্রেনভিল অস্টিন একারণে নীতিগুলিকে সামাজিক বিপ্লবের উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার বলে আখ্যা দিয়েছেন। যেমন, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভারতের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায়, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে।


[6] শিক্ষাগত তাৎপর্য: নির্দেশমূলক নীতিগুলি জনসাধারণ ও সরকারকে তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে। তাই নীতিগুলির শিক্ষাগত মূল্যকে অস্বীকার করা যায় না।


মূল্যায়ন: সবশেষে বলা যায় যে, নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে সম্পূর্ণরূপে মূল্যহীন বলে গণ্য করা যায় না। যদিও নির্দেশমূলক নীতিগুলি কার্যকর না করলে আইনত সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া যায় না, কিন্তু এর প্রভাব জনসাধারণের মধ্যে পড়তে পারে। কারণ এই নীতিগুলি জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ফলে এই নীতিগুলির বাস্তবায়ন না ঘটলে সরকার জনসমর্থন লাভ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এই দিক থেকে নীতিগুলির গুরুত্ব অনস্বীকর্য।


ভারতের সংবিধানে সম্পত্তির অধিকারের সাংবিধানিক মর্যাদা কী? ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার সম্পর্কে আলােচনা করাে।


সংবিধানে ২২ নং ধারায় বর্ণিত গ্রেফতার বা অটিক সংক্রান্ত ব্যবস্থাদি-সহ নিবর্তনমূলক আটক আইন । ভারতের সংবিধানে সংরক্ষিত সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার । সম্প্রতি সংযােজিত ১১ নং মৌলিক কর্তব্য


ভারতের সংবিধানে বর্ণিত শােষণের বিরুদ্ধে অধিকার । ভারতীয় নাগরিকদের জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার 


ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলির সীমাবদ্ধতা । ভারতের শাসনতন্ত্রে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলির বৈশিষ্ট্য । ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ধারাগুলি কীভাবে সংশােধন করা যায়?


কোন্ সংবিধান সংশােধনীর মাধ্যমে মৌলিক কর্তব্যগুলি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে? ভারতীয় সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলির প্রকৃতি মূল্যায়ন করাে।


রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্দেশমূলক নীতিসমূহ । রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্দেশমূলক নীতিগুলির বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করাে।


নির্দেশমূলক নীতির গুরুত্ব বা তাৎপর্য । ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্দেশমূলক নীতিসমূহের মধ্যে মূল পার্থক্য