এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার গুণ-দোষ বা সুবিধা-অসুবিধাগুলি আলােচনা করাে।

এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার গুণ বা সুবিধা

এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার যেসব গুণ বা সুবিধার কথা উল্লেখ করা যায়, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল


[1] সরল, সুদৃঢ় ও দায়িত্বশীল প্রশাসন: গার্নারের মতে, এককেন্দ্রিক সরকার সাংবিধানিক দিক থেকে অনেক সরল প্রকৃতির। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সারা দেশে একই ধরনের আইন চালু থাকায় প্রশাসনিক জটিলতা অপেক্ষাকৃত কম হয়। এ ছাড়া অন্যান্য শাসনব্যবস্থার চেয়ে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় অভিন্ন আইনের মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালিত হওয়ায় এটি অনেক সুদৃঢ় হয়। সর্বোপরি এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় সমগ্র দেশের শাসনভার কেন্দ্রের ওপর ন্যস্ত থাকায় কেন্দ্র‌ এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে।


[2] জাতীয় সংহতির সহায়ক: এককেন্দ্রিক শাসনে সারা দেশে একই আইন ও শাসন চালু থাকে বলে দেশের ঐক্য ও সংহতি সুনিশ্চিত হয়। নাগরিকরা শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অনুগত থাকে। ফলে আঞ্চলিকতা, বিচ্ছিন্নতা প্রভৃতি সমস্যা থাকে না।


[3] প্রশাসনিক নমনীয়তা: দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে প্রশাসনিক‌ নমনীয়তা নিঃসন্দেহে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার একটি বিশেষ গুণ। কেন্দ্রীয় সরকার এখানে দরকারমতাে আঞ্চলিক সরকার গড়ে তুলতে পারে এবং সেই সরকারের ক্ষমতার হাসও ঘটাতে পারে। এর ফলে প্রয়ােজন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।


[4] মিতব্যয়ী প্রশাসন: একটিমাত্র সরকার সমগ্র দেশের প্রশাসন পরিচালনা করে বলে, এক্ষেত্রে প্রশাসনিক খরচ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। অধ্যাপক গার্নারের মতে, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের চেয়ে এককেন্দ্রিক সরকার অনেকটাই কম ব্যয়সাপেক্ষ।


[5] ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উপযােগী: অনেকে মনে করেন, ছােটো ছােটো‌ রাষ্ট্রের পক্ষে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বেশি উপযােগী। যেসব দেশে জনসমাজের মধ্যে জাতিগত ও সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য খুব বেশি নয়, সেখানে এককেন্দ্রিক সরকারের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।


[6] সংকট মােকাবিলায় দক্ষ: এককেন্দ্রিক সরকার দেশের প্রশাসন পরিচালনায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে এবং তা রূপায়ণ করতে সক্ষম। এই কারণে এককেন্দ্রিক সরকার অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে জাতীয় সংকটজনিত পরিস্থিতির দ্রুত মােকাবিলা করতে পারে।


[7] সাংবিধানিক নমনীয়তা: এককেন্দ্রিক সরকারের সংবিধান নমনীয় বা সুপরিবর্তনীয় হওয়ার ফলে জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে যে-কোনাে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সহজ হয়। সরকার দ্রুত সংবিধান সংশােধন করে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ছাড়া যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবিধানকে সহজে পরিবর্তন করা যায়। ফলে বিক্ষোভের সম্ভাবনা থাকে না।


এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার দোষ বা অসুবিধা


এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থাও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। এই ধরনের শাসনব্যবস্থার নিম্নলিখিত ত্রুটি বা অসুবিধার কথা বলা হয়一


[1] অগণতান্ত্রিক: এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি হল স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থার অনুপস্থিতি। এই শাসনব্যবস্থায় সকল ক্ষমতার উৎস হল কেন্দ্রীয় সরকার। আঞ্চলিক সরকারগুলির কোনাে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তা নেই। তারা সব বিষয়ে কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় অনেকে এককেন্দ্রিক শাসনকে অগণতান্ত্রিক বলেন।


[2] সুশাসন ও বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে উপযােগী নয়: সমগ্র দেশের জন্য একই আইনের মাধ্যমে একই ধরনের প্রশাসন পরিচালনা বৃহৎ আকারের রাষ্ট্রগুলিতে সুশাসনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা কেন্দ্রীয়ভাবে বিচারবিবেচনা করা যায় না। এই কারণে বৃহৎ আকার, জনবল এবং ব্যাপক বৈচিত্র্যসম্পন্ন রাষ্ট্রের পক্ষে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা উপযােগী নয় বলে মনে করা হয়।


[3] আমলানির্ভর: সমগ্র দেশে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে প্রশাসন পরিচালনার সময় সরকারি আমলাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে আমলাদের ক্ষমতা বহুলাংশে বেড়ে যায়, যার ফলে শাসনব্যবস্থা আমলাতান্ত্রিক হয়ে ওঠে।


[4] জাতীয় সংহতির পরিপন্থী: এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর স্বতন্ত্র স্বার্থ সংরক্ষণে কোনাে পৃথক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এর ফলে সংখ্যালঘুদের মনে যে অসন্তোষ দেখা দেয়, তা জাতীয় সংহতির বিরােধী হয়ে দাঁড়ায়।


[5] স্বৈরাচারের আশঙ্কা: এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় স্বৈরাচারের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এই ব্যবস্থায় শাসনক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে ক্ষমতাসীন শাসকগােষ্ঠীর ক্ষমতালােভী এবং স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে।


[6] রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের পরিপন্থী: এককেন্দ্রিক শাসনে স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থা না থাকায় প্রশাসন পরিচালনায় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের সুযােগ কম। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশের রাজনৈতিক কার্যকলাপে জনগণের আগ্রহের অভাব লক্ষ করা যায়| এই অবস্থা জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের সহায়ক নয়।


[7] আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিকাশের পরিপন্থী: এককেন্দ্রিক সরকারে সমগ্র দেশের জন্য এক ও অভিন্ন প্রশাসন থাকায় বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি বিকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়।


[8] বিচ্ছিন্নতাবাদের আশঙ্কা: এককেন্দ্রিক সরকারের পক্ষে দেশের‌ প্রতিটি অঞ্চলের প্রতি সমান নজর দেওয়া সম্ভব হয় না। এর ফলে কোনাে কোনাে অঞ্চলের মানুষের দাবিদাওয়া উপেক্ষিত থেকে যায়। এই উপেক্ষার ফলে বঞ্চিত জনগণের মধ্যে তৈরি ক্ষোভ থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদ জন্ম নিতে পারে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন।


[9] বহুত্ববাদের প্রতিবন্ধক: আধুনিক গণতন্ত্র বহু মত ও পথের আদর্শসমন্বিত বহুত্ববাদে (Pluralism) বিশ্বাসী। বহুত্ববাদ অনুসারে ক্ষমতার একটিমাত্র কেন্দ্র থাকা ঠিক নয়, কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ নয়। বলা বাহুল্য, এককেন্দ্রিক সরকারে আধুনিক গণতন্ত্রের এই ধারণা বাস্তবায়িত হওয়ার কোনাে সুযােগ নেই।


উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, একই জাতি-অধ্যুষিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকরী। কিন্তু বৃহদায়তন ও বহু ভাষাভাষী-অধ্যুষিত বৈচিত্র্যময় দেশের ক্ষেত্রে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বিশেষ উপযােগী নয়।


ভারতীয় সংবিধানের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে | ভারতীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।


গণপরিষদ কাকে বলে? গণপরিষদের গঠন ও উদ্দেশ্য আলোচনা করাে। ভারতের সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদের ভূমিকা আলােচনা করাে।


সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদের ভূমিকার সীমাবদ্ধতা আলোচনা করাে। খসড়া কমিটির কয়েকজন সদস্যের নাম লেখাে। 


ভারতের সংবিধান সুপরিবর্তনীয়তা ও দুস্পরিবর্তনীয়তার মিশ্রণ-ব্যাখ্যা করাে। ভারতীয় সংবিধান কোন্ তারিখে গৃহীত হয় এবং কার্যকরী হয়? 


ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্র ব্যাখ্যা করাে। তুমি কি ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র' বলে মনে কর?  সংবিধানের মূল কাঠামাে (Basic Structure) কী?


ভারতের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে সংবিধানের প্রাধান্য ব্যাখ্যা করাে। 'সংবিধানের প্রাধান্য' বলতে কী বোঝায় | ভারতীয় সংবিধানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করাে।


এককেন্দ্রিক সরকার কাকে বলে? এককেন্দ্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ করাে।