প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিতর্কটি কী?

সূচনা: কোনাে কোনাে পণ্ডিত প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন যে, প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না, বিশেষ করে মধ্যযুগের পশ্চিম ইউরােপীয় ধাঁচের সামন্ততন্ত্র তাে নয়ই।


সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব: বিতর্ক

[1] সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বের সপক্ষে মতামত: ঐতিহাসিক ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ড. রামশরণ শর্মা, ড. ডি. ডি. কোশাম্বী, ড. দ্বিজেন্দ্রনাথ ঝা, অধ্যাপক বি. এন. এস. যাদব, এস. গােপাল, ভকতপ্রসাদ মজুমদার প্রমুখ মনে করেন যে, প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। এই প্রসঙ্গে তারা প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের উপাদান হিসেবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির অস্তিত্বের কথা তারা তুলে ধরেন一


  • দাসপ্রথা: সামন্ততন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল। দাসপ্রথার অস্তিত্ব। বৈদিক সাহিত্য, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র ও অন্যান্য উপাদান থেকে প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়।


  • অগ্রহার ব্যবস্থা: প্রাচীনযুগে ভারতে রাজা, অভিজাত ও অন্যান্য ধনী ব্যক্তিরা পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধর্মস্থানে এবং ব্রাহ্মপদের ভূমিদান করতেন। এই দানপ্রথা অগ্রহার ব্যবস্থা নামে পরিচিত। অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে জমিতে দানগ্রহীতার ব্যক্তিগত অধিকার স্থাপিত হয় এবং জমির ওপর রাজার বা রাষ্ট্রের মালিকানা হ্রাস পায়।


  • কৃষকের বদ্ধ জীবন: আদিমধ্যযুগে (৬৫০-১২০০ খ্রি.) কৃষককে ‘হালকর’, ‘বদ্ধহল’ প্রভৃতি শব্দ দ্বারা চিহ্নিতকরণের বিষয়টি থেকে পণ্ডিতগণ ব্যাখ্যা করেন। যে, এযুগে কৃষকরা জমির মালিকানা থেকে বঞ্চিত হয়ে শুধু প্রভুর জমিতে শ্রমদানে বাধ্য হয়েছিল।


  • শিল্প-বাণিজ্যের অবনতি: আদিমধ্যযুগে স্বনির্ভর গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির প্রসার ঘটেছিল যেখানে কৃষক গ্রামজীবনের প্রয়ােজনের অতিরিক্ত উৎপাদনে আদৌ আগ্রহী ছিল না। বিভিন্ন পুরাণ থেকে বৈশ্যদের কলিযুগে বাণিজ্যের পেশা ছেড়ে কৃষিকাজে নিযুক্ত হওয়ার ইঙ্গিত মেলে।


  • নগরের অবক্ষয়: শিল্প বাণিজ্যের অবনতির ফলে প্রাচীন ভারতে এক সময় নগরগুলির অবক্ষয় শুরু হয়। ড. রামশরণ শর্মার মতে, 'নগরের রকত্তাল্পতা ভারতে আদিমধ্যুগে সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল।


[2] সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বের বিপক্ষে মতামত: ঐতিহাসিক ড. দীনেশচন্দ্র সরকার, হরবনস মুখিয়া, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, ড. রণবীর চক্রবর্তী প্রমুখ মনে করেন যে, প্রাচীন ভারতে কখনােই পশ্চিম ইউরােপের মতাে সুস্পষ্ট সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না। এই প্রসঙ্গে তারা প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের অনস্তিত্বের উপাদান হিসেবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির কথা তুলে ধরেন一


  • শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন: গুপ্তযুগে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের অস্তিত্ব ছিল বলে তাঁরা মনে করেন তাদের মতে, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের অস্তিত্ব থাকায় গুপ্তযুগে। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক প্রভুদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কোনাে সম্ভাবনা ছিল না।


  • কৃষকের মালিকানা: হরবনস মুখিয়া মনে করেন যে, আলােচ্য সময়কালে ভারতে উৎপাদনের উপকরণের ওপর সামন্তপ্রভুর নয়, কৃষকের পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল।


  • সমূদ্ধ বাণিজ্য: ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় প্রমুখ বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে উত্তর ভারতে ‘মণ্ডপিকা’, দক্ষিণ ভারতে ‘নগরম’-গুলির উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা তারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, আলােচ্য সময়ে ভারতে বাণিজ্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল।


  • নগর সভ্যতার বিকাশ: ড. শর্মা প্রমুখের বক্তব্যকে খণ্ডন করে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিভিন্ন লেখমালার সাহায্যে প্রমাণ দিয়েছেন যে, আলোচ্য সময়কালে ভারতে। নগরায়ণের ধারা মােটেই সংকুচিত হয়নি।


উপসংহার: প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্র অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় থাকলেও তখন ভারতে সামন্ততান্ত্রিক ধাঁচের কিছু বৈশিষ্ট্য অবশ্যই উপস্থিত ছিল। তবে তা পশ্চিম ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের কাঠামাের মতাে এতটা সুস্পষ্ট সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো উপস্থিত ছিল না বলেই ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়ের সূত্রপাত ঘটেছে।


ম্যানর হাউস ও এখানকার অন্যান্য বাসগৃহের পরিচয় দাও। ম্যানরের কৃষকরা কীভাবে শােষিত হত তার বর্ণনা দাও।


সামন্ততান্ত্রিক সমাজ কয়টি স্তরে বিভক্ত ছিল? ম্যানরের কৃষকদের কী কী কর দিতে হত?


ম্যানরের দুর্গের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব উল্লেখ করাে। ম্যানরের দুর্গের জীবন কেমন ছিল?


মধ্যযুগের ইউরােপে সার্ফ বা ভূমিদাসদের অবস্থা কেমন ছিল? তারা কীভাবে মুক্তিলাভ করত?


সামন্ততন্ত্রের যুগে ইউরােপে কৃষক বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি উল্লেখ করাে।


ইউরােগে সামন্ততন্ত্রের গুরুত্ব বা তাৎপর্যগুলি উল্লেখ করাে। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের কী কী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল?


ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় বা পতনের কারণগুলি কী ছিল?