ভারতের মুসলমানদের নবজাগরণে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের ভূমিকা। আলিগড় আন্দোলনের বিবরণ দাও।

সূচনা: সৈয়দ আহমেদ সমাজে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানাের জন্য যে সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেন তা ইতিহাসে আলিগড় আন্দোলন নামে পরিচিত।


আলিগড় আন্দোলনের পটভূমি

ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথমদিকে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক মােটেই ভালাে ছিল না। ব্রিটিশ সরকার মহাবিদ্রোহের জন্য মুসলিমদের বেশি দায়ী করেছিল। অপরদিকে, মুসলমানরা ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনকে সন্দেহের চোখে দেখত। আলিগড় কলেজের অধ্যক্ষ থিয়ােডাের বেকের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সৈয়দ আহমেদ খান পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের নিয়ে আলিগড় কলেজকে কেন্দ্র করে এক আন্দোলন গড়ে তােলার উদ্যোগ নেন।


আলিগড় আন্দোলনের প্রসার


[1] আলিগড় কলেজের ভূমিকা: আলিগড় কলেজের প্রথম তিন অধ্যক্ষ থিয়ােডাের বেক, টি. মরিসন, ডব্লিউ.এ.জে. আর্চিবল্ড প্রমুখ আলিগড় কলেজকে আন্দোলনের মূলকেন্দ্রে পরিণত করেন। অধ্যক্ষ থিয়ােডাের বেক সম্পাদক ইন্সটিটিউট গেজেট নামক কলেজ পত্রিকাটির দ্বারা বাঙালি, হিন্দু ও কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে প্রচার চালানাে হয়।


[2] বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা: জাতীয় কংগ্রেসের বিকল্প রূপে আলিগড়ে বেকের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান প্যাট্রিয়টিক অ্যাসােসিয়েশন (১৮৮৮ খ্রি.)। থিয়ােডাের বেক পরবর্তী সময়ে মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন মহামেডান অ্যাংলাে ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স অ্যাসােসিয়েশন অব আপার ইন্ডিয়া (১৮৯৩ খ্রি.)।


[3] সৈয়দ আহমেদ ও শিক্ষাসংস্কার: মুসলিমদের উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য উর্দু পত্রিকা 'তাহজিব-উল-আকলার্ক' ও ‘পাইওনিয়ার’ পত্রিকার মাধ্যমে মুসলিমদের প্রতি পাশ্চাত্য শিক্ষার ভাবধারা প্রচারিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বিজ্ঞান সমিতি (১৮৬৫ খ্রি.) ও অনুবাদ সমিতি (১৮৬৬ খ্রি.)। স্যার সৈয়দ আহমেদ গাজীপুরে প্রতিষ্ঠা করেন একটি ইংরেজি বিদ্যালয় (১৮৬৪ খ্রি.), সায়েন্টিফিক সােসাইটি (১৮৬৫ খ্রি.), কমিটি ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব লার্নিং অ্যামং দ্য মহামেডান অব ইন্ডিয়া (১৮৭০ খ্রি.), অ্যাংলাে ওরিয়েন্টাল কলেজ (১৮৭০ খ্রি.), যা পরবর্তীকালে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ পায় (১৯২০ খ্রি.)।


[4] সৈয়দ আহমেদ ও সমাজসংস্কার: সৈয়দ আহমেদ সে সময়কার মুসলিম সমাজে প্রচলিত তালাক প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বিভিন্ন কুপ্রথার বিরুদ্ধে মুসলিমদের সচেতনতা বাড়ানাের চেষ্টা করেন। তিনি বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও যুক্তিবাদের আলােকে মুসলিম সমাজের আধুনিকীকরণের চেষ্টা চালান। এমনকি তিনি আধুনিক চিন্তা ও যুক্তিবাদের আলােকে কোরানের ব্যাখ্যা দেন। মুসলমান সমাজের রক্ষনশীলতার বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘােষনা করেন।


আলিগড় আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য


[1] মুসলিম সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানাে। [2] এই আন্দোলনের প্রতি মুসলিম সমাজের গরিষ্ঠ সংখ্যক দরিদ্র শ্রেণির অংশগ্রহণ ঘটেনি। [3] উত্তরপ্রদেশের গুটিকয়েক জমিদার শ্রেণি ও শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়কেন্দ্রিক ছিল এই আন্দোলন। [4] এই আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের অবতারণা। অর্থাৎ এই আন্দোলনের সূত্রেই ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম দুটি আলাদা জাতি—এই ধারণার উদ্ভব ঘটে।


আলিগড় আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা


[1] ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য: আলিগড় আন্দোলনের নেতৃবর্গ সমগ্র মুসলিম সমাজকে ব্রিটিশের অনুগত থাকার পরামর্শ দেওয়ায় মুসলমান সমাজের এক গরিষ্ঠ অংশ ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা আন্দোলনে যােগ দেয়নি। ফলে পরবর্তীকালের জাতীয় আন্দোলনগুলি যতটা শক্তিশালী ও গতিশীল হওয়ার কথা তা হয়নি।


[2] জাতীয় স্বার্থে আঘাত: আলিগড় আন্দোলন সংকীর্ণ মুসলমান স্বার্থকেন্দ্রিক হওয়ায় জাতীয় আদর্শ ও ভারতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়। আলিগড় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তাদের আন্দোলনকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলির বিকল্প রূপে গড়ে তুলতে চাইলেও তা ব্যর্থ হয়।


[3] বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার জন্মদাতা: আলিগড় আন্দোলন ভারতের জাতীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বীজ রােপণ করে। যার পরিণতিরূপে আগামী দিনে ভারত বিভাজন হয়ে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম নেয়।


[4] উদ্দেশ্যপূরণে ব্যর্থ: গোঁড়া মৌলবি ও মােল্লাদের বিরােধিতার জন্য আলিগড় আন্দোলন শেষপর্যন্ত তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যপূরণে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছিল।


উপসংহার: হতাশার অন্ধকারে ডুবে থাকা মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য আলিগড় আন্দোলনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসার যােগ্য। এই আন্দোলনের সুফল হিসেবে মুসলিম সমাজ আগের থেকে অনেকটাই কুসংস্কার ও গোঁড়ামি মুক্ত হয়ে আধুনিক রূপ লাভ করে।