ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সমর্থনে লর্ড ব্যাবিংটন মেকলের দৃষ্টিভঙ্গি আলােচনা করাে।

সূচনা: লর্ড টমাস ব্যাবিংটন মেকলে (১৮०০-১৮৫৯ খ্রি.) ছিলেন একজন খ্যাতনামা ব্রিটিশ পণ্ডিত, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক এবং হুইগ দলের রাজনৈতিক নেতা। তার বিভিন্ন আলােচনা ও ক্ষুদ্র প্রবন্ধগুলিতে ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।


মেকলের দৃষ্টিভঙ্গি

[1] ব্রিটিশ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব: মেকলে বিশ্বসভ্যতাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন, যথা-সভ্য জাতিসমূহ ও অসভ্য জাতিসমূহ। তিনি ব্রিটিশ জাতিকে চূড়ান্ত সভ্য জাতি এবং ভারতীয় সভ্যতাকে চূড়ান্ত নিকৃষ্ট সভ্যতা বলেন। তার মতে, উন্নত ব্রিটিশ সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে নিকৃষ্ট ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নতি ঘটতে পারে।


[2] ভারতে মেকলে: লর্ড মেকলে ভারতের বড়ােলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের (১৮২৮-১৮৩৫ খ্রি.) আইন সচিব এবং কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন-এর সভাপতি নিযুক্ত হন। তিনি ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রসারে উল্লেখযােগ্য অবদান রাখেন।


[3] ভারতীয় শিক্ষার নিন্দা: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে শিক্ষাদানের মাধ্যম ছিল সংস্কৃত বা আরবি ভাষা। মেকলে ভারতীয় সভ্যতা ও চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থার তীব্র নিন্দা করে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে (২ ফেব্রুয়ারি) বেন্টিঙ্কের কাছে এক প্রস্তাব বা 'মিনিট পেশ করেন। এই প্রস্তাবে তিনি উল্লেখ করেন যে—

  • [i] প্রাচ্যের সভ্যতা হল 'দুর্নীতি, অপবিত্র ও নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ। 

  • [ii] প্রাচ্যের শিক্ষার কোনাে বৈজ্ঞানিক চেতনা নেই। এই শিক্ষা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে সম্পূর্ণ নিকৃষ্ট। 

  • [iii] তাঁর মতে, একটি ভালাে ইউরােপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক ভারত বা আরবের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ।


[4] ইংরেজি ভাষার প্রসার: মেকলে তৎকালীন বড়ােলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে বােঝাতে সক্ষম হন যে, বিদ্যালয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের ষষ্ঠ বর্ষ থেকে ইংরেজি ভাষাকে ভারতে উচ্চশিক্ষার প্রসারের ভাষা মাধ্যম হিসেবে চালু করা উচিত। এর ফলে এদেশে এমন ভারতীয় জনগােষ্ঠী তৈরি হবে 'যারা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মত, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ।'


[5] ক্রমনিম্ন পরিশুত নীতি: মেকলে মনে করেন যে, প্রথম পর্যায়ে ভারতের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। জল যেভাবে ওপর থেকে নীচের দিকে প্রবাহিত হয় তেমনি পরবর্তীকালে এই উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সহায়তায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ক্রমে ভারতের সাধারণ ও নিম্নমধ্যবিত্তদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। মেকলের এই নীতি 'ক্রমনিন্ন পরিশ্রত নীতি' বা ‘টুইয়ে পড়া নীতি’ (Downward Filtration Theory) নামে পরিচিত।


সমালোচনা: ভারতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে মেকলের বিশেষ ভূমিকা থাকলেও তার ইতিহাস চেতনা বিভিন্ন কারণে। সমালােচিত হয়েছে, যেমন—


  • [i] মেকলে তাঁর রচনায় প্রতিপক্ষকে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে এবং নিমর্মভাবে আক্রমণ করেছেন। 

  • [ii] মেকলে ইতিহাস রচনায় তথ্যের চেয়ে ব্যক্তিগত মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। 

  • [iii] মেকলে প্রদত্ত ঐতিহাসিক তথ্যাবলি সর্বদা নির্ভরযােগ্য নয়। 

  • [iv] হুইগ দলের একনিষ্ঠ সমর্থক মেকলের রচনায় সুস্পষ্ট রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ছিল। তাঁর বক্তব্য বহুক্ষেত্রে একপেশে এবং পক্ষপাতদুষ্ট। 

  • [v] ধ্রুপদি যুগ সম্পর্কে তাঁর যতটা জ্ঞান ছিল ততটা জ্ঞান মধ্যযুগের ইতিহাস সম্পর্কে ছিল না।

  • [vi] ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দিক ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে মেকলের জ্ঞান ছিল সীমিত।


ড. অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন যে, "সমসাময়িক কালের উচ্ছসিত অভিনন্দন লাভ করলেও মেকলের ঐতিহাসিক খ্যাতি আজ নিষ্প্রভ.. এক শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়নি, মেকলে স্তুতির সপ্তম স্বর্গ হতে নিন্দার পঙ্কশয্যায় নেমে এসেছেন।"