হাইকোর্টের গঠন ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা করাে।

ভূমিকা: ভারত যুক্তরাষ্ট্রীয় হলেও এখানে অখণ্ড বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান। রাজ্যগুলির শীর্ষে সুপ্রিমকোর্ট গঠন না করে সংবিধানের ২১৪ নং ধারা অনুসারে প্রতিটি রাজ্যে একটি করে মহাধর্মাধিকরণ বা হাইকোর্ট গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য সংবিধানের ২৩১ (১) নং ধারা (সপ্তম সংশােধন, ১৯৫৬) অনুসারে পার্লামেন্ট আইন করে দুই বা ততােধিক রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য একটি হাইকোর্ট গঠন করতে পারে। বর্তমানে ২৯টি অঙ্গরাজ্যের জন্য ২১টি হাইকোর্ট রয়েছে।


হাইকোর্টের গঠন

সংবিধানে হাইকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়, তাও সংবিধানের ২১৬ নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতির পরামর্শক্রমে ১ জন প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য কয়েকজন বিচারপতি নিয়ে হাইকোর্ট গঠিত হয়। তবে, বর্তমানে সহকারী বিচারপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হাইকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা ৫০ জন হয়েছে। আবার সংবিধানের ২২৪ (১) নং ধারা অনুযায়ী প্রয়ােজনবােধে রাষ্ট্রপতি অতিরিক্ত বা অন্য কোনাে বিচারপতিদের অনুপস্থিতিতে দু-বছরের জন্য অস্থায়ী বা অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়ােগ করতে পারেন। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতিকে বিচারপতির দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রপতি অনুরােধ জানাতে পারেন।


বিচারপতিদের নিয়ােগ পদ্ধতি: হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতিগণ সংবিধানের ২১৭ নং ধারানুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। যদিও এই নিয়ােগের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যপালের সঙ্গে পরামর্শ করে থাকেন। সাধারণ বিচারপতিদের নিয়ােগ করার পূর্বে রাষ্ট্রপতি ওই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করে থাকেন। ভারত সরকারের এক সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুসারে হাইকোর্টের বিচারপতিদের এক-তৃতীয়াংশকে অন্য অঙ্গরাজ্য থেকে নিয়ােগের কথা বলা হয়েছে।


বিচারপতিদের যােগ্যতা: হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার জন্য নিম্নে আলােচিত যােগ্যতাগুলি থাকা প্রয়ােজন। যথা一

  • (a) বিচারপতিকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে,
  • (b) কোনাে রাজ্যের হাইকোর্টে তার অন্তত ১০ বছর অ্যাডভােকেটরূপে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে,
  • (c) অথবা ভারত ভূখণ্ডের অন্তর্গত যে-কোনাে আদালতে অন্তত ১০ বছর বিচারক রূপে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।


বিচারপতিদের কার্যকাল ও পদচ্যুতি: হাইকোর্টের বিচারপতিগণ ৬২ বছর বয়স পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকেন। কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কোনাে বিচারপতি পদত্যাগ করতে পারেন, বা অন্য কোনাে হাইকোর্টে বদলি হতে পারেন। অসদাচরণ বা প্রমাণিত অক্ষমতার অভিযােগের ভিত্তিতে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের মােট সদস্যদের অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভোট দানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের দ্বারা সেই মর্মে গৃহীত প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি অভিযুক্ত বিচারপতিকে পদচ্যুত করতে পারেন।


বিচারপতিদের বেতন ও ভাতা: হাইকোর্টের বিচারপতিগণ সংবিধানের দ্বিতীয় তপশিল অনুসারে বেতন ও ভাতা পান (২২১ নং ধারা)। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ২,৫০,০০০ টাকা ও অন্যান্য বিচারপতিরা যথাক্রমে ২,২৫,০০০ টাকা বেতন ও অন্যান্য ভাতা পেয়ে থাকেন। বিচার সভা বাজেট অনুমােদন ব্যতিরেকে রাজ্যের সঞ্চিত তহবিল থেকে তাদের প্রাপ্ত অর্থ প্রদান করা হয়।


হাইকোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি


ভারতীয় সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও হাইকোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করা নেই। সংবিধানের ২২৫ নং ধারায় বলা হয়েছে, হাইকোর্ট গুলি সংবিধানের চালু হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যেসকল ক্ষমতার অধিকারী ছিল বর্তমানেও সেই সমস্ত ক্ষমতা ভােগ করে থাকে। তবে সংবিধান এবং উপযুক্ত আইনসভা কর্তৃক রচিত আইনের সীমার মধ্যে থেকে হাইকোর্টকে তার ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে হয়। হাইকোর্ট যেসব গুরুদায়িত্ব পালন করে বাস্তবে সেগুলি তার ক্ষমতা বলে প্রতিপন্ন হয়। হাইকোর্টের ক্ষমতাগুলি নিম্নে আলােচনা করা হল一


(1) মূল এলাকা: হাইকোর্টের মূল এলাকায় মৌলিক অধিকার বলবৎকরণের মামলাগুলির বিচার হয়। রাজস্ব সংক্রান্ত বিরােধের বিচার হয় হাইকোর্টের মূল এলাকায়। যদিও সংবিধানের ৪২ তম সংশােধনের (১৯৭৬ খ্রিঃ.) ফলে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলার বিচারের ক্ষমতা হাইকোর্টের মূল এলাকা থেকে স্থানান্তরিত হয়, কিন্তু সংবিধানের ৪৪ তম সংশােধনের (১৯৭৮ খ্রি.) সাহায্যে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলার বিচারের ক্ষমতা পুনরায় হাইকোর্টের মূল এলাকায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে কলকাতা, মুম্বাই (মুম্বাই) ও চেন্নাই (মাদ্রাজ) হাইকোর্টের মূল এলাকা হিসেবে স্বীকৃত। তা ছাড়া এই হাইকোর্ট গুলির ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রেও আগে মূল এলাকা ছিল, এখন আর নেই।


(2) আপিল এলাকা: প্রত্যেক রাজ্যের হাইকোর্টগুলি হল সেই রাজ্যের সর্বোচ্চ আপিল আদালত। দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় প্রকার মামলার আপিল নিম্নতম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা যায়। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে বিষয়গুলি হলㅡ

  • (a) জেলা জজ এবং সহকারী জেলা জজের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে সরাসরি আপিল করা চলে, এই ধরনের আপিলকে প্রথম আপিল বলে।
  • (b) আবার নিম্নতম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিচার করতে গিয়ে হাইকোর্টের অধস্তন কোনাে বিচারালয় যে রায় দেয়, তার সঙ্গে যদি আইন পদ্ধতিগত কোনাে প্রশ্ন জড়িত থাকে, তবে সেই রায়ের বিরুদ্ধে পুনরায় হাইকোর্টে আপিল করা যায়। এই ধরনের আপিলকে বলে দ্বিতীয় আপিল।
  • (c) তা ছাড়া হাইকোর্টের কোনাে বিচারকের একক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও হাইকোর্টে আপিল করা যায়।


অপরদিকে, ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে যদি কোনাে দায়রা বা অতিরিক্ত দায়রা জজ বিচারে কোনাে অপরাধীকে ৭ বছরের অধিক কালের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে, তবে ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা চলে। তা ছাড়া যদি কোনাে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর রায়ে ৪ বছরের বেশি কারাদণ্ড দেন তাহলে সেই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা যায়।


(3) লেখ জারির ক্ষমতা: রাজ্যের ভূখণ্ডের মধ্যে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব সংবিধান হাইকোর্ট গুলির উপর ন্যস্ত করেছে। সংবিধানের ২২৬ (১) নং ধারা অনুযায়ী এরূপ গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য হাইকোর্ট কোনাে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি বন্দি-প্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ, প্রতিষেধ, অধিকার পৃচ্ছা, উৎপ্রেষণ প্রভৃতি লেখ, নির্দেশ বা আদেশ জারি করতে পারে। এ ছাড়াও হাইকোর্ট নাগরিকদের সাধারণ আইনগত অধিকারগুলি ক্ষুন্ন হলেও লেখ জারি করতে পারে। যদি হাইকোর্ট মনে করে তার মধ্যে প্রতিকার নিহিত রয়েছে তবেই সে এইরূপ লেখ জারি করতে পারে। যদিও সংবিধানের ৪২ তম সংশােধনের (১৯৭৬ খ্রি.) ফলে হাইকোর্টের এই লেখ জারির ক্ষমতা কিছুটা ক্ষুন্ন হয়েছে।


(4) মামলা অধিগ্রহণের ক্ষমতা: সংবিধানের ২২৮ নং ধারা অনুসারে কোনাে নিম্ন আদালতে চলা কোনাে মামলার সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত কোনাে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত থাকলে হাইকোর্ট উক্ত মামলাটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে বিচার করতে পারে।


(5) তত্ত্বাবধানের ভূমিকা: রাজ্যের সকল আদালত ও ট্রাইবিউনালের উপর হাইকোর্টের প্রশাসনিক ও বিচার বিষয়ক তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা ন্যস্ত করা রয়েছে (২২৭ নং ধারা), অধস্তন আদালত গুলি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব হাইকোর্টের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। রাজ্যপাল জেলা জজের নিয়ােগ, পদোন্নতি, বদলি প্রভৃতি বিষয়ে হাইকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে থাকেন। অন্যান্য বিচারকদের নিয়ােগের ব্যাপারে রাজ্যের রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সুপারিশ ছাড়াও রাজ্যপালকে হাইকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়।


(6) অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারির ক্ষমতা: হাইকোর্ট কোনাে মামলার চূড়ান্ত বিচার সাপেক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ যথা ইনজাংশন ইত্যাদি জারি করতে পারে। সংবিধানের ৪২ তম সংশােধনের ফলে হাইকোর্টের এই ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পায়, কিন্তু সংবিধানের ৪৪ তম সংশােধনের মাধ্যমে পুনরায় এই ক্ষমতা হাইকোর্টের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।


(7) বৈধতা বিচারের ক্ষমতা: হাইকোর্ট সংবিধান-নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে আইনের বৈধতা বিচার করে। সে আইন কেন্দ্রীয় আইনসভা-প্রণীত হতে পারে অথবা রাজ্য আইনসভা-প্রণীত হতে পারে। সংবিধানের ৪২ তম সংশােধনের ফলে কেন্দ্রীয় আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষমতা হাইকোর্টের নিকট থেকে কেড়ে নেওয়া হলেও, সংবিধানের ৪৩ তম সংশােধনের দ্বারা এই ক্ষমতা হাইকোর্টকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।


(8) অন্যান্য ক্ষমতা: হাইকোর্ট অন্যান্য যে দায়িত্ব বা ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল─

  • হাইকোর্ট গুলি অভিলেখ বা নথি (Court of Record) আদালত হিসেবে কাজ করে।
  • আদালত অবমাননার জন্য অবমাননাকারীকে শাস্তিদানের ক্ষমতাও হাইকোর্টকে প্রদান করা হয়েছে।
  • সঠিকভাবে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য হাইকোর্ট নিজের হাতে প্রয়ােজনীয় কিছু নিয়মকানুন প্রণয়ন করে থাকে।

উপসংহার: হাইকোর্টের গঠন ও কার্যাবলি আলােচনা করে বলা যায় যে, এই আদালত রাজ্যের বিচারব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। যদিও হাইকোর্টের গঠন ও কার্যাবলি সম্পূর্ণরূপে ত্রুটিমুক্ত নয়, কারণ স্থায়ী বিচারপতি এবং অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়ােগের ক্ষেত্রে অযথা কালক্ষেপ করা হয়। অন্যদিকে মামলার সংখ্যা প্রতিনিয়িত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেই ন্যায়বিচার লাভ ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া বিচারপতিদের নিয়ােগ ও বদলির ব্যাপারে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতাকে ক্ষুণ্ন করেছে। উপরােক্ত আলােচনার দ্বারা এ কথা স্পষ্ট যে, হাইকোর্ট আসলে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থেকে তার বিচারকার্য সম্পূর্ণ করে থাকে।


সুপ্রিম কোর্টের প্রধান এলাকাগুলি কী কী? সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকাভুক্ত ও আপিল এলাকাভুক্ত ক্ষমতাগুলি আলােচনা করাে।


সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শদান এলাকা বলতে কী বােঝাে? ভারতীয় সামাজিক প্রগতিতে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা বিষয়ে একটি টীকা লেখো।


সুপ্রিমকোর্টের মর্যাদা | সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকার মূল্যায়ন | ভারতীয় সামাজিক প্রগতিতে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা | ভারতীয় সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যা কর্তা হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা