সরকারের আয় ব্যয়ের উপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আলােচনা করাে।

ভূমিকা: পার্লামেন্টের বা সংসদীয় সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সরকারের আয় ব্যয়ের উপর আইনসভা তথা পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ। ইংল্যান্ডের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ঐতিহ্য এবং দৃষ্টান্ত অনুসরণে ভারতের সংবিধানের প্রণেতাগণও সরকারি আয়ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের আইনসভার হাতে প্রয়ােজনীয় ক্ষমতা অর্পণ করেছেন। ভারতীয় সংবিধানে সরকারের আয় ব্যয়ের উপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব বিস্তারের জন্য সংবিধান সংশােধন করে প্রয়ােজনীয় সাংবিধানিক ক্ষমতা সংযােজন করা হয়েছে। সংবিধানের উল্লেখ করা হয়েছে যে, পার্লামেন্টের অনুমােদন ছাড়া কোনাে প্রকার কর আরােপ, করের হারের পরিবর্তন বা কোনাে করের বিলােপসাধন সম্ভব নয়। প্রতি বছর বাজেটে যে রাজস্ব এবং ব্যয় বরাদ্দ সম্পর্কিত দাবি উল্লিখিত থাকে, সেই দাবি পার্লামেন্ট কর্তৃক | অনুমােদিত এবং সংশােধিত হওয়ার পর সরকারি আয় ব্যয়ের বিষয় পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।


সরকারের আয় ব্যয়ের উপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজনীয়তা

গণতান্ত্রিক দেশে সরকার আইন সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আয় ব্যয়ের বিষয় পরিচালনা করে। আইনসভার অনুমােদন অনুযায়ী এবং আইনসভা কর্তৃক নির্ধারিত নীতি অনুযায়ী সরকার ব্যয় নির্বাহ করছে কি না সেই বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। পার্লামেন্টের অর্থ সম্পর্কিত কার্যাবলি এত জটিল ও সময়সাপেক্ষ যে উক্ত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এবং নিজ আর্থিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের হাতে বেশি সময় থাকে না। এরজন্যই ভারতীয়। সংবিধানে সরকারি আয় ব্যয়ের উপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে কতকগুলি মৌলিক নীতি রয়েছে। যেমন ২৬৬ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, পার্লামেন্টের অনুমােদন ব্যতীত সরকার কোনাে কর ধার্য বা সংগ্রহ করতে পারবে না। সংবিধানের ২৬৬ (৩) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, আইনের ক্ষমতা ব্যতিরেকে কোনাে অর্থ সঞ্চিত তহবিল থেকে ব্যয় করা যায় না। পার্লামেন্ট বিনিয়োগ আইনের ক্ষমতাবলেই সঞ্চিত তহবিলের অর্থ ব্যয় করতে পারে। ভারতে অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে পার্লামেন্টের এই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা একমাত্র লোকসভার ভোগ করে থাকে। লোকসভা সরকারি আয় ব্যয় ও রাজস্বের উপর কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ আরােপ করে। অপরদিকে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ বলে পরিচিত রাজ্যসভা এরূপ কোনো কার্যকর ক্ষমতা ভোগ করতে পারে না।


আর্থিক ব্যবস্থার (আয় ব্যয়ের) উপর পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ (লোকসভা) নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা


লোকসভা যে যে ক্ষেত্রে সরকারি আয় ব্যয়ের হিসাব নিয়ন্ত্রণ করে, সেই ক্ষেত্রগুলি হলㅡ


(1) রাজস্ব সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ: রাজস্বের ব্যাপারে সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ("No tax shall be levied or collected except by authority of law.) যে, পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের অনুমতি ছাড়া কোনাে কর ধার্য বা সংগ্রহ করা যাবে না। এরজন্যই নির্বাহিকবর্গ কোনাে কর আরােপ করতে পারে না। যদি পার্লামেন্ট-প্রণীত আইনের অনুমতি ছাড়া কোনাে কর আরােপ করা হয় তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তি আদালতে প্রতিকার চাইতে পারে।


(2) সরকারি ব্যয়ের উপর সংসদীয় নিয়ন্ত্র: সরকারি ব্যয়ের ব্যাপারে সংসদীয় নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভারতের সঞ্চিত বিধি। এই বিধি হচ্ছে একটা ভাণ্ডার যেখানে ভারত সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত সমস্ত রাজস্ব ও সংগৃহীত সমস্ত ঋণের অর্থ' জমা রাখা হয়। সংবিধানে বলা হয়েছে যে, পার্লামেন্ট-প্রণীত আইনকে অনুসরণ না করে ভারতের সঞ্চিত ভাণ্ডার থেকে কোনাে অর্থ তােলা যাবে না। [অনুচ্ছেদ ২৬৬(৩)]। পার্লামেন্টের হাতে এই ধরনের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে বিশেষ রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত আইন বা 'Appropriation Act' [১১৪ (৩) নং ধারা] বলা হয়। ভারতের সঞ্চিত নিধির উপর প্রভাবিত ব্যয়ই হােক অথবা লােকসভা কর্তৃক ভােটে গৃহীত ব্যয় হােক, কোনাে অর্থই ভারতের সঞ্চিত নিধি (তহবিল) থেকে তােলা যায় না। অর্থাৎ পার্লামেন্টের অনুমােদন ছাড়া নির্বাহিকবর্গ সরকারি রাজস্ব থেকে কোনাে অর্থই ব্যয় করতে পারে না।


(3) বাজেট অনুমােদন: প্রত্যেক আর্থিক বছরের আরম্ভে রাষ্ট্রপতি ওই আর্থিক বছরে ভারত সরকারের সম্ভাব্য আয় ব্যয়ের হিসাবের একটা বিবরণ সংসদের উভয় কক্ষে পেশ করেন। একে বার্ষিক আর্থিক বিবরণ বা বাজেট বলা হয় (অনুচ্ছেদ ১১২)। এই বাজেট লােকসভায় পেশ করা হয়। বাজেটে মূলত সরকারি ব্যয় বরাদ্দ ও রাজস্ব সংক্রান্ত দাবি উল্লেখ করা থাকে। পার্লামেন্টে বাজেট অনুমােদন হওয়ার পরই সরকারের আয় ব্যয় পরিচালিত হয়ে থাকে।


(4) অনুদান মারফত সরকারি আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ: পার্লামেন্টের হাতে অনুদান অনুমােদনের ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে। এই অনুদান অনুমােদনের মাধ্যমেও পার্লামেন্ট সরকারি আয়ব্যয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অনুদানগুলির মধ্যে কয়েকটি হ'ল- Supplementary or Additional Grants (অনুপূরক অনুদান), Exceptional Grants (ব্যতিক্রমানুদান), Votes on Account (নানান) ইত্যাদি।


(5) সরকারি আয় ব্যয় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ: ভারতের মঞ্জুরিকৃত অর্থ সরকার সঠিক খাতে ব্যয় করছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব পার্লামেন্টের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। পার্লামেন্ট সরকারি খাতে ব্যয়িত অর্থের সব ধরনের অপচয় ও দুর্নীতিকে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিরােধ করে থাকে। কিন্তু পার্লামেন্টের একার পক্ষে সরকারের আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। এর জন্য সরকারি গাণিতিক কমিটি, (Public Accounts Committee), আনুমানিক ব্যয় হিসাব কমিটি (Estimates Committee) এবং ভারতের নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক (Comptroller and Auditor General of India)- এই তিনটি ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারের আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে।


লোকসভার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার কিছু সীমাবদ্ধতা


লোকসভার ক্ষমতা সরকারি আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ। এই সীমাবদ্ধতাগুলি নিম্নে আলােচনা করা হলㅡ


(1) কর হার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে লোকসভা অক্ষমতা: লোকসভা নিজস্ব উদ্যোগ ছাড়া কোনােপ্রকার কর ধার্য বা করের হার পরিবর্তন করতে পারে না, এরজন্য সরকারের প্রস্তাবের প্রয়ােজন হয়। সরকার কোনাে বিষয়ে ব্যয় বরাদ্দের দাবি পেশ না করা পর্যন্ত লােকসভা কোনাে ব্যয়বরাদ্দ করতে পারে না। এই কারণের জন্যই লােকসভা সরকারের ব্যয়বরাদ্দের দাবির পরিমাণ বাড়াতে পারে না, শুধুমাত্র প্রত্যাখ্যান করতে বা কমাতে পারে।


(2) সঞ্জিত তহবিলের প্রাধান্য: সংবিধানে উল্লেখ করা আছে যে, ব্যয় নির্বাহের জন্য ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে অর্থ প্রদান করা হবে। এই সমস্ত খাতে বিপুল অর্থ ব্যয়িত হওয়ার ব্যাপারে পার্লামেন্টের অনুমােদনের কোনাে প্রয়ােজন দেখা যায় না।


(3) ব্যয়বরাদ্দের দাবির ব্যাপারে স্বল্প সময়ের ব্যবহার: সরকারের ব্যয় বরাদ্দ দাবি আলােচনা করার জন্য, পার্লামেন্টে একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু ব্যয়বরাদ্দের সমস্ত দাবি এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আলােচনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না বলেই লোকসভার স্পিকার ধার্য সময়ের শেষ দিনে গিলােটিন পদ্ধতি প্রয়ােগ করে থাকেন। এই গিলােটিন পদ্ধতি প্রয়ােগ করার ফলে একই দিনে বিনা আলােচনায় ব্যয় বরাদ্দের দাবি দ্রুততার সঙ্গে পাস হয়ে যায়। এর ফলস্বরূপ বিনা আলােচনায় কোটি কোটি টাকার দাবি গৃহীত হয়।


(4) তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা: অনুমােদনসাপেক্ষ ব্যয় অর্থাৎ যে ব্যয় সম্পর্কে পার্লামেন্টে প্রতি বছর আলোচনা ও ভােটগ্রহণ করা হয়, সেই ব্যয়ের ব্যাপারেও পার্লামেন্টের ক্ষমতা সীমিত পার্লামেন্ট যে তিন ধরনের ব্যবস্থা (যথা আনুমানিক ব্যয় হিসাব কমিটি, সরকারি গাণিতিক কমিটি, ভারতের নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক) গ্রহণ করেছিল, সেই তিনটি ব্যবস্থাও সরকারের অপচয়মূলক ব্যয়ের সঠিক বিচারবিবেচনা করতে পারেনি।


(5) ক্যাবিনেটের নিয়ন্ত্রণ/প্রাধান্য: পার্লামেন্টীয় শাসন ব্যবস্থায় ক্যাবিনেটের প্রাধান্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হয়। মূলত পার্লামেন্টকে ক্যাবিনেটই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, কারণ পার্লামেন্টে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরকে নিয়ে ক্যাবিনেট গড়ে ওঠে। এরজন্যই ক্যাবিনেটে সরকারি আয় ব্যয়ের কোনো প্রস্তাব পেশ করা হলে পার্লামেন্টে তা সহজেই অনুমােদিত হতে পারে।


উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, পার্লামেন্টীয় শাসন ব্যবস্থায় দলীয় আনুগত্য ও নিয়মানুবর্তিতার নীতি কঠোরভাবে মেনে চলার কারণেই সরকার প্রকৃত ক্ষমতার অধিকার ভােগ করে থাকে। সরকার যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত, এই কারণেই যে-কোনাে ধরনের প্রস্তাব খুব সহজেই পাস হয়ে যায়। এরজন্য কোনােরকম অসুবিধার সৃষ্টি হয় না। বলা যেতে পারে, সরকারি আয় ব্যয়ের উপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ পুরােপুরি তত্ত্বগত বলে মনে না হলেও, এর একটি বিধিসম্মত বাস্তব দিক রয়েছে বলে মনে হয়।